সিলেটটুডে ডেস্ক

০৩ নভেম্বর, ২০১৫ ১২:৪৫

আগে আঁধারে লুকিয়ে হামলা করত, এখন প্রকাশ্যে : জাতিসংঘ অনুষ্ঠানে বন্যা আহমেদ

সারাবিশ্বে সাংবাদিক নিগ্রহ ও এর বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসানে পদক্ষেপ নেবার আহবান জানিয়ে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে টু এন্ডিং ইমপিউনিটি ফর ক্রাইমস এগেইনস্ট জার্নালিস্টস’ বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্যানেলে বক্তৃতা করেছেন বাংলাদেশে জঙ্গিদের হামলায় নিহত ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বন্যা আহমেদ।

২০১৩ সাল থেকে জাতিসংঘ প্রতিবছর ২ নভেম্বর এ দিবসটি পালন করে আসছে। এই দিবসকে জাতিসংঘ আয়োজিত আলোচনা সভায় আলোচক ছিলেন বন্যা আহমেদ।

প্যানেল আলোচনায় বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হওয়া হামলার ঘটনাগুলোতে বিচারহীনতার বিষয়গুলো তুলে ধরেন মার্কিন প্রবাসী বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ ঢাকায় নিহত হওয়ার সময় চাপাতির কোপে গুরুতর আহত বন্যা।

বক্তব্যে তিনি বলেন, একুশ শতকের এই আধুনিককালেও সাংবাদিকদের ওপর হামলাগুলো দিনে-দুপুরে আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে।

বন্যা বলেন, আজ থেকে দু’দিন আগে, শনিবার বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জন্য একটি রক্তাক্ত দিন ছিলো। ফেব্রুয়ারির পর থেকে এটি ছিলো এ বছরের ষষ্ঠ ঘটনা, যেখানে ইসলামিক জঙ্গিরা দিনের বেলা ব্লগার বা লেখকদের এবং এবার এক প্রকাশকের ওপর হাজারো মানুষের সামনে হামলা চালালো।

‘এর আগে তারা আঁধারে লুকিয়ে হামলা করতো। কিন্তু হামলাকারীরা শাস্তি থেকে বারবার এতো সহজে বেঁচে যাচ্ছে যে, তারা এখন প্রকাশ্যে দিনের আলোতে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে, এমনকি অফিস বা বাসায় ঢুকে লেখক-প্রকাশকদের কোপাতে শুরু করেছে।’

‘এ বছর এখন পর্যন্ত তারা ৫ জন লেখক, ব্লগার ও প্রকাশককে হত্যা করেছে এবং আহত করেছে আরো অনেককে। আমার স্বামী ড. অভিজিত রায় এবং আমাকে ঢাকায় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ভরদুপুরে রাস্তার মাঝখানে কোপানো হয়। আমরা একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আমাদের জন্মভূমিতে গিয়েছিলাম। মাথায় ৪টি আঘাত নিয়ে আর একটি আঙ্গুল হারিয়ে আমি বেঁচে গেলেও অভিজিৎ আমার মতো ভাগ্যবান ছিলেন না; হাসপাতালে মারা যান তিনি,’ বলতে বলতে অশ্রুসজল হয়ে পড়েন বন্যা।

‘এর একমাস পর তারা আমাদের সহকর্মী লেখক, ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকেও সকালবেলা কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে মেরে ফেলে। রাস্তার মাঝে তাদের পরবর্তী শিকার হন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু। এমনকি তারা ব্লগার নিলয়ের বাসায় ঢুকে সহধর্মিণীর সামনে তাকে কুপিয়ে হত্যা করতেও একবার দ্বিধা করেনি।’

‘কিন্তু সেখানেই তারা থামবে কেনো? শুধু লেখক পর্যন্ত চাপাতির কোপ থামিয়ে রেখে কী হবে, যেখানে তারা জানে তারা যা-ই করুক না কেনো, বাংলাদেশ সরকার চুপ থাকবে। তাই এবার হামলাকারীরা দু’জন প্রকাশককে টার্গেট করলো যারা এসব লেখকদের মুক্তচিন্তা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাকস্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা বই প্রকাশ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।’

‘পরিস্থিতি বর্তমানে খুবই গুরুতর। এই রক্তাক্ত দিনগুলো যেনো একটা নিত্য বিষয়ে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদের কণ্ঠ আছে এমন মানুষদের কুপিয়ে হত্যা ইসলামিক সন্ত্রাসীদের জন্য এখন একটা মাসিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

‘এই শনিবার তারা জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করতে সফল হয়েছে। তার অপরাধ তিনি অভিজিত রায়ের দু’টি বই প্রকাশ করেছিলেন। আরেক প্রকাশক শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল নিজ অফিসে চাপাতির একাধিক কোপ খেয়েও ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান। লেখক ও ব্লগার রণদীপম বসু এবং কবি তারেক রহিম তখন টুটুলের সঙ্গে তার অফিসে ছিলেন। তারা দু’জনেই আহত হন। তারেক রহিমের অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। একাধিক চাপাতির আঘাতের ক্ষত এবং পেটে বুলেট নিয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তিনি।’

বন্যা বলেন, আমরা জানি তারা আহমেদুর রশীদ টুটুলের জন্য আবার আসবে। আমি এই অনুষ্ঠানের ঠিক আগেই তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বললাম। দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কাঁধ, ঘাড় ও চেহারায় কোপের আঘাত পাওয়ার কারণে টুটুল শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন।

‘আপনারা যদি মনে করেন আমরা শুধু এসব ধর্মীয় মৌলবাদী হত্যাকারীদের কাছ থেকেই হামলার শিকার হচ্ছি, তবে তা আপনাদের ভুল ধারণা। পরিস্থিতির ‘উন্নতি’ করতে আমাদের নিজেদের সরকারই তথাকথিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করেছে। এই আইসিটি আইন অনুসারে যেকোনো তথাকথিত ‘মিথ্যা’ ও ‘অশ্লীল’ প্রকাশনা, সম্প্রচার বা ওয়েবসাইট এবং ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করে বা করতে পারে এমন যেকোনো যোগাযোগকে বেআইনী ঘোষণা করতে পারে। আপনারা বুঝতেই পারছেন, এগুলো খুবই অস্পষ্ট ধারণা; এদের সংজ্ঞায়িত করা খুবই কঠিন।’

‘নতুন আইসিটি আইন অনুসারে, ইন্টারনেটে ধর্মীয় সমালোচনা করলে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। এবং হ্যাঁ, বাংলাদেশ সরকার বেশ কয়েকজনকে এই আইনের আওতায় গ্রেফতার করেছে।’

তিনি বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন সরকার অবশ্যই ব্লগার হত্যাকারীদের গ্রেফতার করেছে, তাই না? না। বরং লেখার মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে আইসিটি আইনের আওতায় তারা উল্টো কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে। বর্তমান সরকারকে অপমান করার অভিযোগে একজন সাংবাদিককে কয়েক সপ্তাহ আগে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়।

‘এ বছর প্রথম তিনটি হত্যাকাণ্ড হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার একেবারে চুপ হয়ে থাকে। আর চতুর্থ হত্যাকাণ্ডের পর যখন সরকারকে কিছু বলতে চাপ দেওয়া হয়, তারা আমাদের সতর্ক করে যেনো আমরা কী বিষয়ে লিখছি সে বিষয়ে সচেতন থাকি। সরকার খোলাখুলিই বলেছে, নির্বাচনী রাজনীতির কারণে খুব তারা সাবধানে চলছে। ধর্মনিরপেক্ষ লেখকদের পক্ষ নিয়ে সরকার ধর্মীয় দলগুলোর সমর্থন হারানোর ঝুঁকি নিতে পারবে না।’

অভিজিতের সঙ্গে ‘মুক্তমনা’ ব্লগ পরিচালনা করা বন্যা বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো প্রকৃত খুনীই গ্রেফতার বা বিচারের সম্মুখীন হয়নি। কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে, তবে তাদের বিচারের আওতায় আনতে আমরা এখনও দেখিনি। এদের কেউ কেউ আবার জামিনে মুক্ত হয়ে গেছে।

‘ব্লগাররা যখন তাদের কাছে সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে আসা হুমকির বিষয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন, পুলিশ তখন তাদের চুপচাপ এবং নিষ্ক্রিয় থাকার পরামর্শ দিয়েছে। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ পরামর্শ পেয়েছেন, দেশে নিরাপদ বোধ না করলে বিদেশে চলে যাওয়ার। এভাবে অপরাধীদের পরোক্ষ সমর্থন দেওয়ার জন্য তারা সামান্যও লজ্জিত বা বিব্রত না।’

বন্যা হতাশা নিয়ে বলেন, আমরা এমন এক দেশে বাস করি, যেখানে লেখক, ব্লগার, সাংবাদিকরা নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে এখন আর নিরাপদ অনুভব করেন না। ‘অন্য কিছু দেশের মতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই’ তিনি ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ ব্যাপারে সচেতন হতে অনুরোধ’ জানান।

‘বাংলাদেশের সাহসী সাংবাদিক, ব্লগার, লেখক, প্রকাশকরা তাদের দেশকে ভালোবাসেন এবং মাতৃভূমির অবস্থায় পরিবর্তন আনতে চান। আমরা এখানে কথা বলার মুহূর্তেও তারা ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তাঘাটে এসব হত্যা, হত্যার বিচারহীনতা এবং বাংলাদেশ সরকারের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। হুমকির মুখে থেকেও আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের মুক্তকণ্ঠ, বাকস্বাধীনতা এবং একটি স্বাস্থ্যকর ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকে রক্ষা করতে সাহায্য করার জন্য আমরা আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত