গোলাম সাদত জুয়েল, যুক্তরাষ্ট্র

০১ জানুয়ারি, ২০১৬ ২১:৩০

আনন্দে ভাসছে আমেরিকা, হলিডেতে দেশ বিদেশ ছুটছেন প্রবাসীরা

কাজ পাগল আমেরিকানরা কাজ ছাড়া থাকতে পারে না। আমেরিকার জীবন ব্যবস্থা ঘড়ির কাটার সাথে লেপ্টে থাকে। বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর চাইতে এখানেই আমেরিকার বৈশিষ্ট্য। তারপরও সেই গতিশীল আমেরিকার ডিসেম্বর এর শেষ দুসপ্তাহ ভাসে আনন্দের বন্যায়। ক্রিসমাস ও নববর্ষকে বরণ করার জন্য কাজ পাগল আমেরিকানরাও কিছুটা জিরিয়ে নেয়।

স্কুলগুলো ছুটি হয়ে যায় দু' সপ্তাহের জন্য, কেনাকাটার ধুম পড়ে। রিটেল ব্যবসায়ীরা সেল দিয়ে আকৃষ্ট করে কেনাকাটার জন্য। দুসপ্তাহের বিক্রি বছরের অর্ধেক বেচাকানার সম পর্যায়ে চলে যায়। আমেরিকা ইমিগ্রান্ট রাষ্ট্র বিশ্বের ২৫৭ দেশের মধ্যে সোয়া দুই শ' দেশের নাগরিকরা আমেরিকায় বসবাস করেন নিজের স্বকীয় স্বাধীনতায়, ধর্ম পালন করেন যার যার মত।

শত শত চার্চের সাথে রয়েছে শত শত মসজিদ, মাদ্রাসা মন্দির ও নানা রংয়ের উপশনালয়। কেউ কাউকে বাঁধা দেয় না তার ধর্ম পালনে, আমেরিকার রেডিও টিভি চ্যানেলগুলোতে যদিও সস্তা রাজনীতির জন্য ইসলাম, মুসলিম ও টেররিষ্ট নিয়ে নানা কথাাবার্তা চললেও বাস্তবতার সাথে তার মিল খুজে পাওয়া যায় না। ক্রিসমাসের ছুটিতে পুরো আমেরিকা আনন্দে মেতে উঠে , বাচ্চাদের ছুটি থাকায় প্রবাসী বাংলাদেশীরাও এই ফাঁকে বাংলাদেশসহ দেশে বিদেশ বা নুন্যতম হলেও আমেরিকার ভেতরটা দেখার চেষ্টা করেন।

বিশ্বের অন্যতম সুন্দর দেশ আমেরিকা ৫০ টি স্টেট হল ৫২ টি বাংলাদেশের সমান। তাই প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য আমেরিকার প্রধান প্রধান শহর ঘুরে দেখাও সম্ভব হয় না, তারপর রয়েছে বাংলাদেশীদের জন্য পছন্দের ও খুব কাছের কানাডা (নায়াগ্রা ফলস), ব্রাজিল, কলম্বিয়া, পুটোরিকো, জামাইকা , হাইতি, পানামা, ডমিনিকান রিপাবলিক সহ শত শত আইল্যান্ড।

আমেরিকার ভেতর প্রধান প্রধান প্রবাসী অধ্যুষিত বাংলাদেশী শহর গুলো বা ষ্টেট মিশিগান যেখানে ৫০ হাজার বাংলাদেশী বসবাস করেন রয়েছেন তিন জন নির্বাচিত কাউন্সিলম্যান , নিই ইয়র্ক যেখানে ৩ লক্ষ বাংলাদেশী বসবাস করেন, বোষ্টন, আটলান্টা, নিউজার্সি, মায়ামী, ফ্লোরিডা, কানেকটিকাট , ওয়েষ্ট পাম বিচ ( ফ্লোরিডা ) যেখানে ২০ হাজার বাংলাদেশি থাকেন। পুরো আমেরিকার ৫০ টি স্টেটের মধ্যে ২৫ টি স্টেটে বাংলাদেশীরা রয়েছেন এবং কয়েক শত ছোট বড় শহরে বাংলাদেশিদের অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়।

ক্রিসমাসের হলিডেতে প্রবাসীরা ছুটে বেড়ান এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। এ সময়টাতে বিয়ের ধুম পড়ে যায়, লম্বা ছুটি থাকায় অনেকে বিয়ের জন্য উপযুক্ত সময় হিসাবে এ সময়টাকে বেছে নেন। প্রফেশনাল ডাক্তারদের তাদের চেম্বার স্লো হয়ে যায় এ সময়টায় তাই তারা ছুটেন বাংলাদেশসহ আশেপাশের দেশগুলোতে। অনেকে ছুটে আসেন আমেরিকার স্বর্গ খ্যাত ফ্লোরিডার ডিজনি ওয়ার্ল্ডে পুরো পরিবারসহ।

আমেরিকায় দ্বিতীয় প্রজন্ম চলছে, প্রবাসী বাংলাদেশি যারা আশির দশকে আমেরিকায় এসেছিলেন তাদের বেশিরভাগের ছেলে মেয়েরা বর্তমান সময়ে পড়ালেখা শেষ করে নতুন জীবন শুরু করেছে। আবার যারা ভা্ই বোনদের জন্য এপ্লাই করেছিলেন তারা ১৪ /১৫ বছর পর বর্তমানে সপরিবারে আমেরিকায় আসছেন, সব স্টেটে নতুন বাংলাদেশি ইমিগ্রান্টদের এক জোয়ার বইছে। পাশাপাশি ভিজিট ভিসায় বাংলাদেশিরা আসছেন ৬ মাস ঘুরে আবার ফিরে যাচেছন, আবার অনেকে চেষ্টা করছেন থেকে যাবার । নতুন টুরিস্ট ইমিগ্রান্টদের নিয়ে হলিডেতে প্রবাসী বাংলাদেশি পরিবারগুলো ঘুরে বেড়াচেছন।

ফ্লোরডার ডেন্টিস্ট ডা : কাশেম গোপালগঞ্জের বাসিন্দা, বাংলা সাহিত্যের অতিব পন্ডিত । তার সাহিত্যের চর্চা আমাকে মুগ্ধ করে । ৪৫ মিনিট ড্রাইভ করে তার ব্যস্ততম চেম্বারে যাই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বিষয়ে জানতে। গান্ধী মুভির বিমুগ্ধ শুভাকাঙ্খি, সপ্তাহে ৬ দিন রোগী দেখেন ডেনচার এর পন্ডিত ৩৫ বছর থেকে ডেন্চার করেন। এখন তাঁর বয়স ৬৭ বছর। এই বয়সে জার্মান -ফ্রান্স ঘুরে বেড়ান চিকিৎসার আধুনিক বিষয়কে জানার জন্য । যত দেখী মুগ্ধ হয়ে যাই, একজন লেখক সাংবাদিক হিসাবে আমাকে খুব মুল্যায়ন করেন। এত ব্যস্ত ডাক্তার আমি ১৪ বছরে দেখিনি দুটো চেম্বার, ৭ বছর পর দেশে গেলেন ৯ দিনের জন্য।

ওরলান্ডোর বিশিষ্ট ব্যাবসায় প্রকৌশলী আরিফ সপরিবারে আর্জেন্টিনা গেলেন, প্রকৌশলী নিপুন পরিবার নিয়ে ছুটলেন বাংলাদেশে। কিসিমির জনাব আশিক ছেলে বিয়ে দিতে ফ্লোরিডা থেকে ছুটলেন পরিবার পরিজন নিয়ে মিশিগান। আমেরিকানদের ক্রিসমাস পালন অনেক ব্যয়বহুল । বাড়িতে বাড়িতে লাইটিং, মার্কেটে উপচে পড়া ভিড়।

অনেকদিন পর নতুন আমেরিকা দেখলাম। আমার প্রতিবেশী ব্রাজিলিয়ান এভেলিন তার বোন ব্রাজিল থেকে এসেছে বোনের সাথে হলিডে করতে। প্রতিবেশী হিসাবে আমার ছেলে মেয়েরা প্রতিবছরের মত এবার ৮ বক্স গিফট উপহার দিল , এভেলিন খুব খুশি । আমি ছাড়া তার বন্ধু বলতে বা গিফট দেবার কেউ নেই।

আমার কাজ ছিল, আমরা যারা ক্রিসমাস সেলিব্রেট করি না তারা ক্রিসমাসে ইভ ও ক্রিসমাসের দিন কাজ করি। আমেরিকায় হলিডেতে কাজ করলে ডাবল টাকা পাওয়া যায়। তা্ই অনেকে ডাবল টাকার জন্য কাজ করতে চেষ্টা করে। আবার অনেক হলিডে করার জন্য রিকোয়েস্ট অফ চায় । যদি কেউ ৯ ডলারে কাজ করে তাহলে ক্রিসমাসে সে ১৮ ডলার ঘন্টায় কাজ করবে, এটা অনেকে ছাড়তে চায় না ।

আমি কাজ করি ডিজনি ওয়ার্ল্ডে আমাদের কাজের জায়গায় ক্রিসমাসে ছিল অনেক খাবার আমাদের জন্য। পুরো রিসোর্টে ছিল না কোন ব্যস্ততা তাই টিভি দেখে সময় কাটালাম। নতুন বছর আসছে বছরের শেষ দিন কে আমেরিকানরা সেলিব্রেট করে । শ্যাম্পেনের বোতল খুলে রাত ১২ টায় ২০১৬ কে স্বাগত জানায় । হাজার হাজার ডলার ব্যায় করে নতুন বছরক স্বাগত জানায়।

শুরু হলো নতুন বছর, কাজ পাগল আমেরিকানরা আবার ঝাপিয়ে পড়বে জীব্ন যুদ্ধে। চলবে ক্রেডিট কার্ডে জড়িয়ে পড়া তাদের জীবনের বিল পরিশোধের টানাটানিতে। তবে তারা আনন্দ করে, ফুর্তি করে, ট্রেস থেকে তারা থাকে অনেক দুরে। আমরা ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশিরা সঞ্চয় ও পরবর্তি প্রজন্মদের জন্য চিন্তা করতে করতে শেষ হয়ে যাই। তাই অকাল বয়সে আমাদের পড়তে হয় বুকের মধ্যে রিং।

আমরা ঠিক মত আনন্দ করতে পারি না। তাই আমরা বেশী দিন বাঁচতেও পারি না। আমেরিকানরা কখনও আগামীকালের জন্য চিন্তা করে না, তারা ভাবে আজ আমার এবং আমি আজকের দিনকে সেলিব্রেট করব।

গোলাম সাদত জুয়েল: সাংবাদিক, কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য

আলোচিত