আনোয়ার আকাশ, মেলবোর্ন থেকে

১৩ এপ্রিল, ২০১৬ ০২:৪৪

মেলবোর্নে চাঞ্চল্যকর শিশু শানায়ার হত্যাকারী মা সফিনা নিকেট

সম্প্রতি পৃথিবীর সেরা বাসযোগ্য শহর মেলবোর্নে ঘটে গেছে এক নারকীয় ঘটনা। যে ঘটনা আলোড়িত হবে সৃষ্টির অমোঘ নিময়ের চুলচেরা বিশ্লেষণে।  আপন শিশুকে হত্যা করেছে তারই জন্মদাত্রী মা। অবশ্য এ জাতীয় ঘটনা ইদানীং ঘটছে হরহামেশা। পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের মত বাংলাদেশেও এক মা নিজেই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন কি করে অবিশ্বাস্য মনে নিজ হাতেই খুন করেছেন নিজের দুই সন্তানকে।

অস্ট্রেলিয়ার অনিন্দ্য শহর মেলবোর্নে গত ৯ই এপ্রিল, শনিবার নিজের কন্যা সন্তানকে হত্যার অভিযোগ করেছিল এক মা। সাফিনা নিকেট নামের এ মা আদালতে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে নিজ শিশুর এ হত্যাকারী তিনি নিজেই। অস্ট্রেলিয়ার বার্তা সংস্থা এবিসি সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে গত ক’দিন ধরে জোর চেষ্টা চালানো হয় হত্যাকারীকে সনাক্ত করার। অবশ্য পুলিশের কাছে এ অভিযোগ করেছিল শানায়ার মা আরবিয় বংশোদ্ভূত সফিনা নিকেট নিজেই।

পাড়া পড়শিরা হতভম্ব হয়ে গেছেন এ সংবাদে। মাত্র কিছুদিন আগেও মা তার মেয়ের ছবি আপলোড করেছিল ফেসবুকে। মাত্র ১৪ মাসের ফুটফুটে শিশু শানায়া চমৎকার হাসিখুশি একটি শিশু। এ শিশুর আশ্রয় হবার কথা ছিল মায়ের কোলে। নিরাপদ একটি দেশে, নিরাপদে সুন্দর আঙ্গিকে বেড়ে উঠবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু শিশুটির হত্যাকারী যখন মা নিজেই তখন স্বাভাবিকতায় ম্লান হয়ে যায় মাতৃকুল। সব চিন্তা চেতনা ওলট পালট হয়ে যায়।

মা সফিনা নিকেট মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় ওয়েস্ট মেলবোর্ন পুলিশ স্টেশনে ঘটনার আদ্যোপান্ত স্বীকার করেছে।  হত্যাকাণ্ড অনুসন্ধানী দলের উচ্চ পদস্থ সার্জেন্ট স্টুয়ার্ট বেইলি পুরো তদন্ত শেষে ‘বেইল জাস্টিস’কে জানায় যে মিসেস নিকেট হত্যার দায়ভার সম্পূর্ণভাবে নিজের সম্পৃক্ততার কথা বলেছে। গত শনিবার ৯ই এপ্রিল এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল।

মা নিকেট কালো রঙের টপস ও প্যান্ট এবং চপ্পল পরা অবস্থায়, আনত চোখে হাত দিয়ে মুখ ঢাকছিলেন। অন্যহাতে পবিত্র কুরআন বহন করছিলেন। যিনি বেলের কোন আবেদন করেননি। শানায়ার মৃতদেহ গত রোববার ১০ই এপ্রিল ভোর ২টা ৪৫মিনিটে স্থানীয় ডেবেরিন ক্রিকে সনাক্ত করা হয়। অবশ্য এর আগে মিসেস নিকেট পুলিশের কাছে অভিযোগ করছিল যে তার মেয়েকে নিয়ে শনিবার ৯ই এপ্রিল সকাল ১০টায় অলিম্পিক পার্কে হাঁটার সময় একজন ছিনতাইকারী প্রেম থেকে তাকে নিয়ে গেছে।  সে সময়ে সেই ছিনতাইকারীর বর্ণনাও দিয়েছিল। মিথ্যা নিখুঁত বর্ণনায় উঠে এসেছিল কি করে আফ্রিকান একজন মদ্যপ জুতাবিহিন অবস্থায় তার শিশুকন্যাকে ছিনতাই করেছিল।

এর পর পুরো এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে যায়। পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবক দল চুলচেরা অনুসন্ধান চালান পুরো এলাকায়।  সম্ভাব্য সকল প্রকার চেষ্টা চালিয়েছে পুলিশ। সম্ভাব্য সকল জায়গা থেকে অনুসন্ধানে সাহায্য চাওয়া হয়।  শানাইয়ার এ করুন পরিণতিতে ছোট্ট এ শিশুর সম্মানে অলিম্পিক পার্কে হাইডলবারগ ফুটবল ক্লাবের সমন্বয়ে একমিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ উদযাপনে শানাইয়ার দিদিমা এবং পরিবারের অন্য দুজন ক্ষুদে সদস্যও যুক্ত হয়।

তবে মঙ্গলবার সংবাদ মাধ্যম চ্যানেল সেভেন এর বরাতে পুলিশ সিসিটিভির ফুটেজে দেখতে পায় একজন মহিলা শনিবার সকালে একটি ‘প্রেম’ ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে একটি শিশুর অবয়ব ফুটে উঠেছে, অতঃপর মহিলা স্বাভাবিক গতিতে শূন্য প্রেম ঠেলে নিয়ে সেই ক্রীক থেকে ফিরে যাচ্ছেন গন্তব্যে।

হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত ঘটনার পর থেকেই স্থানীয়রা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। মেলবোর্ন সহ সারা অস্ট্রেলিয়ায় এই অস্বাভাবিক মৃত্যু খুবই নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আসে পাশের মানুষ ভীষণ উৎকণ্ঠায় দিনগুলো পার করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই সন্দেহের তির্যক দৃষ্টি পড়ছিল যাদের ওপর তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এ খবর প্রকাশের পরপরই। তাদের অভিযুক্তদের গাড়ী বাড়ী লক্ষ্য করে ডিম ছুড়ে মারতে এবং ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

এলেক্স সেলোনিকিডিস নামে একজন প্রতিবেশী অন্তত একজন মানুষ গ্রেফতারে নিজের হৃদয়ভার লাঘবের কথা জানিয়েছেন। তিনি মত প্রকাশ করে বলেন এর চেয়ে আর জঘন্য কি ঘটতে পারে তা আমি অনুমান করতে পারিনা। এটা সত্যি দুঃখজনক।  শানাইয়ার মত একটি ফুটফুটে শিশুকে কেউ হত্যা করতে পারে এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে স্থানীয়ে আলির বৃদ্ধ পিতার। এ বিষয়কে ভেবেই একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা অসুস্থ বোধ করেছেন। এর পরপরই আলি নামের একজন সম্ভবত আরবি ভাষায় গালি দিয়ে বাসায় কপাট লাগান।

মঙ্গলবার অপরাহ্ণে কোর্ট ভবন থেকে বের হবার পরপরই অভিযুক্ত বাইশ বছরের মা সাফিনা নিকেটকে প্যারামেডিক এবং স্বাস্থ্য কর্মী সমন্বয়ে পুলিশ নিরাপদ এবং গোপনীয় স্থানে স্থানান্তর করেছে। এর পর চ্যানেল সেভেনে আলোচিত ভিডিও প্রদর্শনের পর জনমনের নানা বিভ্রান্তি দুর হয়ে সকল আলোচনা একটি জায়গায় গিয়ে থেমেছে। অবিশ্বাস মানুষকে নাড়া দিয়ে চলেছে একজন মা কি করে এমন কাজ করতে পারে। এ হত্যা মামলা হয়তো আরও বহুদূর গড়াবে।

বিষয়টির নিষ্পত্তির আগে সংবাদ মাধ্যম, আইন বিভাগের বিচারক, পুলিশ সহ সকল যট খুলবে। একবিংশ শতাব্দীর এ লগ্নে এসে অস্ট্রেলিয়ার মানুষ হয়তো অবাক হয়ে ভাববে মা কি করে তার চমৎকার একটি শিশু সন্তানকে মেরে ফেলতে পারে।  বিশেষত যাকে তিনি নিজের গর্ভে ১০ মাস দশ দিন লালন পালন করেছেন। নিজের নাড়ির সাথে যার আজন্ম সম্পর্ক।

স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং রাষ্ট্রীয় মানব সেবা সংস্থা বিশ্বাস করছে যে, মৃত্যুর আগে প্রায় একমাস যাবত মা ও শিশু নানা সমস্যায় সময় কাটিয়েছে।  পুলিশ এখনো বিষয়টি নিষ্পত্তি করেনি তবে পোস্টমর্টেম এর প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে শানায়া শ্বাসরোধে মারা গিয়ে থাকতে পারে।

শিশু সহ অসংখ্য মানুষ নিধন চলছে আমাদের ভদ্র সমাজে। আমরা অবাক হয়ে দেখছি মানুষের মনুষ্যত্ব লোপ পেয়েছে। এখন খুব ছোট কারণেই একজন মানুষ আর একজন মানুষকে আঘাত করে, মেরে ফেলে। ছোটখাটো কারণেই পরিবার গুলো ভেঙ্গে যায়। জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেনা। কেন করেনা জানিনা। নিজের কল্যাণেই মানুষ কেবল ছুটছে, অপরের কল্যাণ যেন তার দেখার বিষয় নয়। পরিস্থিতি দিন দিন যেভাবে সঙ্কীর্ণ আর ঘোলা হচ্ছে তাতে অস্ট্রেলিয়া সহ গোটা পৃথিবীর মানুষ শঙ্কিত।

আমরা চাই মানুষের বিবেক জাগ্রত হোক। নিজের জন্য নয়, পরের কল্যাণে তার হৃদয় কাঁদুক। শুধু নিজের বা নিজের পরিবার নয়, অপেক্ষাকৃত দুঃস্থ আর সঙ্কটে পড়া মানুষ গুলোর কল্যাণে তারা এগিয়ে আসুক। বিশ্বজুড়ে যে বিভাজন বাড়ছে তার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে একমাত্র মানুষই। চাই শুধু মানবতা। একারণেই জীবনমুখী শিক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।

একথা ভাববার সময় এসেছে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। প্রত্যেককে ভাবতে হবে যে, ‘আমার সৃষ্টি আমার জন্য নয়’। অন্য মানুষের কল্যাণে।  একটি জীবনের কাছে আর কোন বিষয়ই প্রণিধান যোগ্য হতে পারেনা।  কারণ আমরা সবাই জানি ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’। মানুষের জয় হোক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত