সিডনি, অস্ট্রেলিয়া সংবাদদাতা

২০ জুন, ২০১৬ ১৯:৫১

সিডনিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়

অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে।

রোববার (১৯ জুন) সন্ধ্যায় সিডনির লাকেম্বা লাইব্রেরি হলে ‘মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং আজকের বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা এ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

আল-নোমান শামীমের সঞ্চালনায় গোলটেবিলে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন সাহিত্যিক ড. শাখাওয়াৎ নয়ন। প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী লেখক ড. তরুণ চক্রবর্তী।

‘মাসিক মুক্তমঞ্চ’ এর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এবং ‘পেন অ্যান্ড পেপার’ এর সহযোগিতায় গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়।

“মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং আজকের বাংলাদেশ” শীর্ষক মূল প্রবন্ধে ড. শাখাওয়াৎ নয়ন মূলত সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে সংগঠিত ‘টার্গেটেড কিলিং’ এর উপর আলোকপাত করেন। প্রসঙ্গত তিনি মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রেক্ষিতে আজকের বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিশ্লেষণ করেছেন; উক্ত প্রবন্ধে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ‘টার্গেটেড কিলিং’ এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাসসহ সাম্প্রদায়িক সমস্যার ভয়াবহতা এবং সমাধানের উপায়সমুহ উপস্থাপন করেন।   

মুখ্য আলোচক যুক্তরাজ্য প্রবাসী একাডেমিক, লেখক ড. তরুণ চক্রবর্তী সাম্প্রদায়িকতা-অসাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি নিজেকে একজন নাস্তিক হিসেবে পরিচয় দেন।  মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক দর্শনের উদাহরণ দিয়ে তিনি আরো বলেন- বাংলাদেশের মানুষ ঈশ্বরকে সামনে রেখে মানুষকে পিছনে রাখে।  সেটা মসজিদেই হোক আর মন্দিরেই হোক, ঘটনা একই।  তিনি মনে করেন, যতদিন পর্যন্ত মানুষকে সামনে রাখা যাবে না, ততদিন পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না। হেফাজত ইসলামকে নানা রকমের সুবিধাসহ ৫০ বিঘা রেলের জমি প্রদানের ঘটনাকে উল্লেখ করে বলেন, মৌলবাদীরা মতিঝিলে পাঁচ লাখ লোকের সমাবেশ করেছে, আমরা যারা প্রগতিশীল, মুক্তমনা’রা যদি দশ লাখ লোকের সমাবেশ করতে পারি; তাহলে আমাদেরকে ১০০ বিঘা জমি দিবে শেখ হাসিনা সরকার; নয়তো আমাদের এভাবেই একদিন শেষ হয়ে যেতে হবে।  সুতরাং আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সংগঠন গড়ে তুলতে হবে; সংগঠন ছাড়া কিছুই করা যাবে না।  আমরা যে যেখানে আছি, যে যা পারি, তা করেই প্রতিবাদ করতে হবে।    

লেখক, প্রাবন্ধিক এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদ রনৈশ মৈত্র সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদেরকে টার্গেট করে হত্যা করার জন্য মূলত জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের নেতিবাচক রাজনীতিকে দায়ী করেন; তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন-বর্তমান সরকারের কাজ-কর্ম দেখে মনে হচ্ছে এদেশে হিন্দুরা থাকলে ভোট পাবে, চলে গেলে জমি-জমা সম্পত্তি পাবে, দুই দিকেই লাভ।  তাই সরকার প্রধানসহ সরকারের সকল পর্যায়ে এক ধরনের রহস্যজনক নীরবতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।  কলামিস্ট, ছড়াকার, কবি অজয় দাশ গুপ্ত অত্যন্ত জোরালো ভাবে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশ কোনো ভাবেই তুলনা করা যাবে না; যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল তা এখন শুধুই অতীত।  তিনি আরো বলেন-কেউ স্বীকার করুক আর না-ই করুক বাংলাদেশ এখন একটি পরিপূর্ণ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র।   

বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল, অস্ট্রেলিয়ার সভাপতি শেখ শামীমুল হক প্রাবন্ধিকের সাথে অনেকটাই একমত পোষণ করে বলেন- বাংলাদেশে রাজনীতিবিদরা যে খেলা শুরু করেছেন, তার পরিণতি হবে ভয়ংকর। তিনি বর্তমান সরকারের তথ্যমন্ত্রী এবং সংস্কৃতিমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রীর সাম্প্রদায়িক বক্তব্য-বিবৃতির বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, অস্ট্রেলিয়া শাখার সভাপতি ব্যারিস্টার সিরাজুল হক মূল প্রবন্ধের সাথে অনেকখানি দ্বিমত পোষণ করে বলেন- বাংলাদেশের হিন্দুরা বলে তারা ভালো নেই, রানা দাশগুপ্তের মতো একজন প্রভাবশালী আইনজীবী ভারতের কাছে সাহায্য চাচ্ছেন; আবার অন্যদিকে বিএনপি জামায়াতের লোকেরা বলে দেশ নাকি হিন্দুরা চালাচ্ছে, প্রশাসনে নাকি হিন্দুতে ভরে গেছে; তাহলে আওয়ামীলীগ এখন কোন দিকে যাবে? তিনি দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেন- বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ এখনও মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করে এবং তার চর্চা করে।   

অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টির নেতা, প্যারাম্যাটা সিটি কাউন্সিলের সাবেক কাউন্সিলর প্রবীর মৈত্র প্রাবন্ধিকের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই একমত পোষণ করেন এবং একই সাথে সরকারের করনীয় সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করেন।  তিনি আরো বলেন, পৃথিবীতে এখন দুই ধরনের রাষ্ট্র আছে (১) সেকুলার রাষ্ট্র (২) ইসলামী রাষ্ট্র।  এখন আর সমাজতন্ত্র-মন্ত্র কিছু নাই।  বাংলাদেশ এখন ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, ওখানে অন্য কোনো ধর্মের লোকেরা নিরাপদে বাস করতে পারছে না।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি
অধ্যাপক ড. সোমা দে বলেন, একটা সময় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতো, এখন ক্লাসে পড়ানোর সময়ও সচেতনভাবে কথা বলতে হয়, না জানি কারো কোনো অনুভূতিতে আঘাত লেগে যায়।  তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেন, জেন্ডার রিলেশনস এর এমন অনেক নারীবাদী বই-পুস্তক আছে; যেগুলো হয়তো একদিন আর পড়ানো যাবে না।   

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠক সুরজিৎ রায় বলেন, এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বন্ধুটিকে মোহসীন হল থেকে জগন্নাথ হলে নিয়মিত খেতে আসতো, সেই বন্ধুটি এখন হালাল-হারাম নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করে, হালাল ছাড়া খায় না।  গত বিশ বছরে বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে।  ব্যক্তিগত ভাবে অনেকেই হিন্দুদেরকে বন্ধু বলে গ্রহণ করে কিন্তু সামস্টিকভাবে হিন্দুদেরকে ঘৃণা করে।  হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নে কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না।  এটা ভয়ংকর।  বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা পলাশ বসাক বলেন, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেই তুলে ধরেছিল; দেশের মানুষের মনে আশা জাগিয়েছিল।  কিন্তু সেই ইতিবাচক শক্তিকে কাজে না লাগিয়ে বরং নানা কায়দায় ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।  

লেখক, সংগঠক সালেহ জামী বলেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমাদের দেশে ধর্ম কিভাবে এলো? এবং কিভাবে এদেশের মানুষকে নানা কায়দায় পরিবর্তন করে ফেললো? তা জানতে হবে।  বাংলাদেশ এরকম ছিল না।  আমাদের পরিবার ব্যবস্থাসহ, সামাজিক কাঠামোকে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।  সমাজের প্রতিরোধ শক্তি বলে আর কিছু নেই।  যার খেসারত এখন আমরা দিচ্ছি।  আরো মূল্য দিতে হবে। ফয়সাল খান অনিক বলেন, আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমস্যা চিহ্নিত করার কাজে ব্যস্ত থাকি কিন্তু সমাধানের চিন্তা করি না।  আজকের বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সমস্যা কিংবা টার্গেটেড কিলিং হচ্ছে, যা কিছুই হোক না কেন, সব কিছুরই সমাধান আছে। আমাদেরকেই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।  

আওয়ামীলীগের প্রবীণ নেতা গামা আব্দুল কাদির বলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষে সংগঠনের কোনো বিকল্প নাই। তিনি আরো বলেন, সংগঠন ছাড়া কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন কিংবা সামাজিক আন্দোলন করা যায় না।  গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠেছিল ঠিকই কিন্তু তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল না, তাই তারা এত বড় একটি আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। এছাড়াও উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে মোহসীনা পারভীন সুবর্না, অনীলা পারভীন এবং দিদারুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।   

আপনার মন্তব্য

আলোচিত