সিলেটটুডে ডেস্ক

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ১৬:৪৯

সিলেট বিভাগের বিপন্ন পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় নিউ ইয়র্কে প্রবাসীদের আলোচনা সভা

বর্তমান সময়ে সিলেট বিভাগের প্রধান সমস্যা প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপন্নতা। বিপন্ন পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় প্রবাসীদের মনোযোগ ও অংশগ্রহণ জরুরী। এ লক্ষে বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক (বেন) ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাঙ্গালীদের সর্ববৃহৎ সামাজিক সংগঠন জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা এক মতবিনিময় ও আলোচনা সভার আয়োজন করে।

রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর) বেলা ১২টায় নিউইয়র্কের জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন কার্যালয়ে 'সিলেট বিভাগের পরিবেশ বিপন্নতা, পরিবেশবাদীদের চলমান আন্দোলন ও প্রবাসীদের করনীয় নির্ধারণে সভা অনুষ্ঠিত হয়।

জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা ইনক-এর সভাপতি বদরুল ইসলাম খান-এর সভাপতিত্বে ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক (বেন)-এর নিউইয়র্ক কো-অর্ডিনেটর সৈয়দ ফজলুর রহমান এর সঞ্চালনায় এ আলোচনা সভায় বাংলাদেশ থেকে আগত পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক আব্দুল করিম কিম সিলেট বিভাগের প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপন্নতা, পরিবেশবাদীদের চলমান আন্দোলন সম্পর্কে ধারনাপত্র উপস্থাপন করেন।

সভায় মূল বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর সহ-সভাপতি এবং বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক (বেন)-এর গ্লোবাল কো-অর্ডিনেটর অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম।

অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম আলোচনা সভার মূল বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) গঠনের প্রেক্ষিত তুলে ধরে বলেন, ২০০০ সালে বাপা গঠনের মাধ্যমে দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষার লড়াই শুরু হয়। স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে নাগরিকদের সম্পৃক্ততায় বাপা বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় শক্তিশালী ভ্যানগার্ডে পরিণত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাপা'র ব্রাঞ্চ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে ২০০৬ সাল থেকে সিলেটে পরিবেশ আন্দোলন-এর সূচনা হয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল সিলেট বিভাগে পরিবেশ বিনষ্টের চলমান প্রক্রিয়া দুর্ভাগ্যজনক। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পরিবেশকর্মীরা ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার হয়েও আশাব্যঞ্জক কাজ করে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবামূলক ভাবে এ কাজ অব্যাহত রাখা কঠিন।  এ অবস্থায় সিলেটের পরিবেশগত বিপর্যয় প্রতিরোধে প্রবাসীদের সম্মিলিত উদ্যোগ ও সহযোগিতা জরুরী।

প্রফেসর নজরুল আরোও বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্রে থাকা প্রবাসী বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করছেন। তাঁদের বিভিন্ন উদ্যোগ জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। অনুরূপ অনুপ্রেরণা সিলেটের জন্যও প্রয়োজন। সিলেট বিভাগের প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী ব্যক্তিত্ব ও কমিউনিটি নেতাদের সিলেট বিভাগের সার্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশগত বিপর্যয়রোধে সম্পৃক্ত করতে পারে জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশনের মত স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার আব্দুল করিম কিম সিলেট বিভাগের প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপন্নতা ও পরিবেশবাদীদের চলমান আন্দোলন সম্পর্কে ধারনাপত্র তুলে ধরে বলেন, সুরমা-কুশিয়ারাকে কেন্দ্র করে এখানে শত নদী বহমান। শত শত বিল ও জলাশয়ের পাশাপাশি সমুদ্রসম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি এবং দ্বিতীয় রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওড় সিলেটের গৌরব। মায়াবী সবুজ পাহাড় ও দিগন্ত বিস্তৃত চা-বাগান নিয়ে শত-সহস্র ছোট-বড় টিলা সিলেটের পরিচয়। ক্রান্তীয় আর্দ্র চিরহরিৎ ও ক্রান্তীয় প্রায়-চিরহরিৎ লাউয়াছড়া, রেমা-কালেঙ্গা, সাতছড়ি, রাজকান্দি বনাঞ্চল'সহ বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলারবন রাতারগুল সিলেট বিভাগের সমৃদ্ধ প্রাণ-প্রকৃতির আধার। পাথরের রাজ্য জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণ। প্রকৃতির অশেষ দান সিলেট বিভাগকে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র করেছে।

সিলেটে পরিবেশ আন্দোলনের এক দশকের অভিজ্ঞতা ও অর্জন তুলে ধরে আব্দুল করিম কিম আরোও বলেন, সিলেটের প্রধান নদী সুরমার উৎসমুখ প্রায় এক দশক ধরে ভরাট হয়ে আছে । খোয়াই, মনু সহ সিলেটের অধিকাংশ নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে আছে। সিলেট বিভাগের প্রায় ৫০ ভাগ পাহাড় টিলা গত তিন দশকে কেটে সমতল করা হয়েছে । অসংখ্য জলাশয় ও পুকুর-দিঘি ভরাট হয়েছে । সর্বোচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সিলেটের প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে ভূগর্ভস্থ পাথর উত্তোলনে বোমা মেশিন নামের স্থানীয় প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রভাবশালী পাথরখেকো চক্রের লুটপাটতন্ত্রে সিলেটে বিভাগের পিয়াইন, সারি, ধলাই, লোভা, যাদুকাটা, চলতি, রাংপানি ইত্যাদি নদী ও নদী তীরবর্তী এলাকা গত দেড় দশকে বিপর্যস্ত হয়েছে। অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনের প্রভাবে ডাউকি নদী হারিয়ে গেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে সমাদৃত জাফলং, শ্রীপুর, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ, উৎমাছড়া, লোভাছড়া প্রতিনিয়ত রুপ হারিয়ে কদাকার হয়ে যাচ্ছে। লাউয়াছড়া, সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা ও রাজকান্দি বনাঞ্চল বৃক্ষশুন্য। রাতারগুল জলারবন অনিয়ন্ত্রিত পর্যটক ও অপরিকল্পিত প্রকল্পবাজীতে বিপন্ন।

জালালাবাদ বিশ্ব সিলেট সম্মেলন ২০১৭ এর আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, সিলেট বিভাগে বর্তমান সময়ের প্রধান সমস্যা প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপন্নতা। কিন্তু এখনো তা অনেকের বোধগম্যতার বাইরে। বিশেষ করে প্রবাসীদের সিলেটের পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারনা নেই। তাই উদ্বেগও নেই। যে কারণে বিলাসবহুল বাড়ি ও মসজিদ মাদ্রাসা তৈরিতে প্রবাসীদের আগ্রহ দেখা গেলেও সিলেটের নদ-নদী রক্ষায়, পাহাড়-টিলা রক্ষায়, বনাঞ্চল রক্ষায় এখনো তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি।

তিনি সদ্য সমাপ্ত জালালাবাদ বিশ্ব সিলেট সম্মেলন-এর মধ্য দিয়ে সিলেটের ভাষা-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির প্রতি সিলেটীদের যে ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে সে ধারাবাহিকতায় সিলেটের বিপন্ন পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব রাখেন।

বাংলাদেশ সোসাইটি ইনক'র সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপিকা রানা ফেরদৌস চৌধুরী বলেন, সিলেটের প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপন্নতা নিয়ে প্রবাসীদের নির্লিপ্ততা রয়েছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রবাসীদের এই নির্লিপ্ততার কারণ হতে পারে, এ সম্পর্কে যথাযথ ধারনার অভাব অথবা তাঁদের কাছে এটাই স্বাভাবিক যে, বাংলাদেশে নদী দখল হবে, পাহাড় কাটা পড়বে, জলাশয় ভরাট হবে, যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা হবে, উচ্চ শব্দে মাইক ও গাড়ির হর্ন বাজবে, গাড়ি ও কারখানার কালোধোঁয়া বাতাসে ভাসবে, বনাঞ্চল সাফ হয়ে নগরায়ন হবে। এভাবে নদী দখল ও দূষণ হতে হতে সব নদী শেষ হয়ে গেলে, পাহাড় কাটা চলতে চলতে সব পাহাড় শেষ হয়ে গেলে, বন বিনাশ হতে হতে সব বন ফুঁড়িয়ে গেলে, হাওড় ভরাট হতে হতে সব হাওড় ভরে গেলে কেমন হবে? ভয়াবহ দুর্যোগ হবে। সিলেট আর সিলেট থাকবে না। তাই এই নির্লিপ্ততার অবসান প্রয়োজন। সিলেটে পরিবেশ আন্দোলনের কাজে নিজেদের যুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।

জালালাবাদ বিশ্ব সিলেট সম্মেলন ২০১৭ এর সদস্য সচিব ও জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা-এর সাধারণ সম্পাদক জেড চৌধুরী জুয়েল বলেন, প্রবাসী সামাজিক সংগঠনগুলো দেশের শিক্ষা, চিকিৎসা, দারিদ্র্য বিমোচন সহ নানা ক্ষেত্রেই সহযোগিতা করে যাচ্ছে । প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার কাজেও প্রবাসীরা আগামীতে সম্পৃক্ত হবে।

জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা ইনক-এর সভাপতি বদরুল ইসলাম খান সভাপতির বক্তব্যে বলেন, তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তে আয়োজিত এ সভা সিলেটের পরিবেশ জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিলেটের নদ-নদী, হাওড়-বাওর, বনাঞ্চল ও পাহাড়-টিলা ধ্বংসের চিত্র দেখে মর্মাহত হয়েছি । সিলেটের প্রাকৃতিক পরিবেশ বাঁচাতে অবিলম্বে কাজ শুরু করা প্রয়োজন।

তিনি আরো বলেন, সিলেটকে বাঁচাতে হলে পরিবেশ রক্ষা করতে হবে । আর এ কাজ একা পরিবেশবাদীদের পক্ষে সম্ভব নয় । পরিবেশ আন্দোলনের সাথে জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন একযোগে কাজ করবে এ প্রতিশ্রুতি তিনি ব্যক্ত করেন।

আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বেন-এর ড. ফাতেমা আহমেদ, সামশাদ হুসাম, লেখিকা শাহানা বেগম, জালালাবাদ এ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা ইনক-এর উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য মোহাম্মদ একলিমুজ্জামান, সহ-সভাপতি মোশাররফ হোসেন ও শাহ আলাউদ্দদিন, আপ্যায়ন সম্পাদক মানিক আহমদ, ক্রিড়া সম্পাদক বুরহান আহমদ, কার্যকরী পরিষদ সদস্য সাব্বির হোসেইন, সৈয়দ লোকমান মিয়া, প্রাক্তন মহিলা সম্পাদিকা মুক্তা ধর, নাট্য সংগঠক সিতেশ ধর, সিলেটের সাংস্কৃতিক সংগঠক ফরিদা নাসরিন প্রমুখ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত