নিউজ ডেস্ক

১২ জুন, ২০১৫ ২০:৩১

বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের নতুন মেয়র জন বিগস

বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসে ‘জালিয়াত’ লুৎফুর রহমান যুগের অবসানের পর ভোটে জিতে নতুন নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন লেবার পার্টির প্রার্থী জন বিগস।

আগের নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি ও কারচুপি প্রমাণিত হওয়ায় বৃহস্পতিবার কড়া পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা এই কাউন্সিল নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়।

শুক্রবার সকালে রিটার্নিং কর্মকর্তা জন বিগসকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। টাওয়ার হ্যামলেটসের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে ফলাফল ঘোষণার তথ্য ও ছবিও প্রকাশ করা হয়।

ফল প্রকাশের পর স্থানীয় সময় শুক্রবার ভোরে লন্ডনের এক্সসেল কনফারেন্স সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন মেয়র বলেন, “গত এক বছরের ঘটনাপ্রবাহে আমাদের এই বরোতে যথেষ্ট উত্তেজনা বিভাজন তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের সব আবার ঠিকঠাক করতে হবে।”

বিগত দিনের ‘অসদাচরণের’ ইতিহাস পেরিয়ে এসে টাওয়ার হ্যামলেটসকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় জানান ৫৮ বছর বয়সী এই লেবার নেতা।

লেবার পার্টির হয়ে লন্ডনের তিন আসন থেকে সম্প্রতি এমপি নির্বাচিত বাংলদেশি সংশোদ্ভূত রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপা হক টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাচনে লন্ডন অ্যাসেম্বলির সদস্য জন বিগসের পক্ষে প্রচারে অংশ নেন।

গত বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিতর্কিত বাংলাদেশি লুৎফুর রহমানের কাছে হেরেছিলেন বিগস। ওই ভোটে জালিয়াতির জন্য আদালতের আদেশে মেয়র পদ হারাতে হয় লুৎফুরকে। তার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

নিজে ভোটে দাঁড়াতে না পেরে লুৎফুর এবার মেয়র পদে সমর্থন দেন রাবিনা খান নামে আরেক বাংলাদেশিকে, যিনি লুৎফুরের সময়ের কাউন্সিলর। নির্বাচনে রাবিনা পরাজিত হয়েছেন প্রায় ৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে।

টাওয়ার হ্যামলেটসে মোট ১ লাখ ৮৪ হাজার ৫৬৩ ভোটারের মধ্যে মেয়র নির্বাচনে ভোট দেন ৬৯ হাজার ৭৬৩ জন, মোট ৩৭.৭৩ শতাংশ। ব্যালট পেপারে ভোটারদের প্রথম ও দ্বিতীয় পছন্দ উল্লেখ করা সুযোগ ছিল।

প্রথম দফা গণনায় জন বিগস পান ২৭ হাজার ২৫৫ ভোট। আর রাবিনা খান পান ২৫ হাজার ৭৬৩ ভোট।

কোন প্রার্থীই ৫১ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় ভোটারদের দ্বিতীয় পছন্দের ভোট বিবেচনায় নেওয়া হয়। এতে জন বিগস পান আরও ৫ হাজার ৪৯৯ ভোট। রাবিনা খানের ভাগে পড়ে ৬২১ ভোট।

আদালত লুৎফুরের পাশাপাশি টাওয়ার হ্যামলেটসের কাউন্সিলর আলিবর চৌধুরীর পদও শূন্য ঘোষণা করেছিল।

বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে ওই পদে লুৎফুর সমর্থিত প্রার্থী আবু তালহা চৌধুরীকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন লেবার পার্টির প্রার্থী সাবিনা আখাতার।

১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া লুৎফুর শৈশবেই যুক্তরাজ্যে যান। আইন পেশায় যুক্ত হওয়ার পর ১৯৮৯ সালে তিনি ব্রিটেনের লেবার পার্টিতে যোগ দেন।

লুৎফুর কাউন্সিলে লেবার পার্টির লিডার থাকা অবস্থায় গণভোটের মাধ্যমে টাওয়ার হ্যামলেটসে নির্বাহী মেয়র ব্যবস্থা চালু হয়। এতে মেয়র কার্যত একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হন।

সে সময় জর্জ গ্যালওয়ের রেসপেক্ট পার্টির সঙ্গে ‘আতাঁত করে’ লুৎফর এ পদ্ধতি চালুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন বলে অভিযোগ ওঠে।

লেবার পার্টির অবস্থান সে সময় নির্বাহী মেয়র পদ্ধতির বিরুদ্ধে ছিল। দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় লেবার পার্টি ২০১০ সালের নির্বাচনে লুৎফুরের মনোনয়নের আবেদন ফিরিয়ে দেয়।

কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে অংশ নিয়ে সহজেই ৩২ শতাংশ বাঙালি অধ্যুষিত এ কাউন্সিলের মেয়র নির্বাচিত হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লুৎফুর।

মেয়র হওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অভিযোগ ওঠে। স্থানীয় কমিউনিটির মধ্যে প্রভাব ধরে রাখতে তিনি স্থানীয় মসজিদ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মওলানা শামসুল হকের সঙ্গে বন্ধুত্বের বিষয়টি কাজে লাগান।

এরপর সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে ২০১৪ সালে লুৎফুর দ্বিতীয় দফায় মেয়র নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনের আগের শুক্রবার ১০১ জন ইমাম ও মুসলিম নেতা স্থানীয় বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলোতে একটি চিঠি পাঠান, যাতে বলা হয়, লুৎফুরকে ভোট দেওয়া ‘মুসলমানদের ইমানী দায়িত্ব’।

ওই নির্বাচনে প্রথম দফা ভোটে লুৎফুর রহমান পেয়েছিলেন ৪৩ শতাংশ ভোট। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জন বিগস পান ৩৩ শতাংশ ভোট।

কেউ ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফা ভোটে বিগসের ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশের বিপরীতে ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেলে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় লুৎফুরকে।

ভোটের পর চারজন ভোটার নির্বাচন কমিশনে ভোটে প্রভাব সৃষ্টিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ করেন। রয়াল কোর্টস অফ জাস্টিস সেই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করে গত ২৪ এপ্রিল রায় দেয়।

ভোট জালিয়াতি, ইমামদের দিয়ে ভোটে প্রভাব বিস্তার, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষের অপপ্রচার এবং সরকারি অর্থ দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ওই রায়ে লুৎফুরের মেয়র পদ শূন্য ঘোষণা করে নতুন নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়া হয়। লুৎফুরের নির্বাচন করার ওপর দেওয়া হয় পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা। সেইসঙ্গে আড়াই লাখ পাউন্ড জরিমানাও করা হয় তাকে।

অনিয়ম ও স্বচ্ছতা না থাকার কারণে লুৎফুর রহমানের টাওয়ার হ্যামলেটস ভিত্তিক দল টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট এর রেজিস্ট্রেশনও বাতিল করে দেয় নির্বাচন কমিশন।

বিচারক রায়ে বলেন, নির্বাচনী প্রচারে ‘ধর্ম’ ও ‘বর্ণবাদ’কে কাজে লাগিয়েছেন লুৎফুর রহমান। নির্বাচনের পুরো সময় ‘রেইস ও ইসলামফোবিয়া কার্ড’ খেলেছেন তিনি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত