সিলেটটুডে ডেস্ক

২১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ১৭:৫০

নিউ ইয়র্কে জেনোসাইড বিষয়ক সেমিনার

৯ ডিসেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক জেনোসাইড ও প্রতিরোধ দিবস। দিবসটি স্মরণে নিউ ইয়র্কের বাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকা জ্যাকসন হাইটস এর ডাইভারসিটি প্লাজায় জেনোসাইডে নিহতদের স্মরণ, সম্মান ও শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে মোমবাতি প্রজ্বলন, র‌্যালি এবং বাংলাদেশ প্লাজার কনফারেন্স রুমে 'বাংলাদেশে একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির করণীয়' শীর্ষক সেমিনার ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

সেমিনারে কি নোট স্পিকার ছিলেন আয়োজক সংগঠনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ড. প্রদীপ রঞ্জন কর। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের উপ স্থায়ী প্রতিনিধি (দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত) তারেক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, নিউইয়র্ক বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসা ও জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের প্রথম প্রেস সচিব নূর এলাহি মিনা উপস্থিত ছিলেন।

সঞ্চালকের দায়িত্বে ছিলেন-আয়োজক সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মঞ্জুর চৌধুরী। অনুষ্ঠানটির আয়োজক 'জেনোসাইড '৭১ ফাউন্ডেশন, যুক্তরাষ্ট্র।

সেমিনারে আলোচনা ও অন্যান্য কর্মসূচিতে যারা অংশগ্রহণ ও উপস্থিত ছিলেন সৈয়দ মোহাম্মদউল্লা, হাকিকুল ইসলাম খোকন, রমেশ নাথ, মূলধারার রাজনৈতিক মোর্শেদ আলম, মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা এম এ আওয়াল, মুক্তিযোদ্ধা খুরশীদ আনোয়ার বাবলু, মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন (অব.) ওয়াজিউল্ল্যা, মুক্তিযোদ্ধা অবিনাশ আচার্য, মুক্তিযোদ্ধা জাহিদুল, মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিশ্বাস, কমিউনিটি এ্যাকটিভি ডা. টমাস দুলু রায়, আবদুর রহিম বাদশা, শাহ মো. বকতিয়ার, মোহম্মদ আলী সিদ্দিকী, শরীফ কামরুল আলম হিরা, মো. কায়কোবাদ খান, মিথুন আহমেদ, শাহানাজ মমতাজ, রুমানা আকতার, ওবায়দুল্লা মামুন, আল আমীন বাবু, আশরাফ আলম, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রবিণী ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ার অধ্যাপক সব্যসাচি দস্তিদার, এডভোকেট মোহম্মদ আলী বাবুল, এডভোকেট জাকির হোসেন, জলি কর, মো. জামাল, খন্দকার জাহিদুল ইসলাম, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের শুভ রায়, একে চৌধুরী, প্রবিণী ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সচিব শুভ জি দস্তিদার, মো. কামাল ও মিসেস কামাল ও দেলোয়ার মোল্লা।

সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণী পড়ে শোনান জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের উপস্থায়ী প্রতিনিধি (দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত) তারেক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম। তিনি জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের পক্ষ থেকে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং কি ডিপ্লোমেটিক এ্যাকশন গ্রহণ করা হয়েছে বা অব্যাহত কাজের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

নিউ ইয়র্কস্থ বাংলাদেশের কনস্যাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসা বলেন, তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে নিজে কর্মরত ছিলেন, মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর রয়েছে উল্লেখ করেন। এছাড়াও তিনি জানান, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি আদায়ে বিভিন্ন  ডিপ্লোম্যাটিক কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের প্রথম প্রেস সচিব নূর এলাহি মিনা উল্লেখ করেন ইতিমধ্যেই জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশন ও জেনোসাইড ’৭১ ফাউন্ডেশন, যুক্তরাষ্ট্র এর যৌথ প্রচেষ্টায় জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে জনমত গঠনে উদ্দেশ্যে ২৫শে মার্চে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিশনের কর্মকর্তা, এ্যামবাসেডরবৃন্দ, আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন প্রথিতযশা ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের সমন্বয়ে একটা বড় ধরনের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথ কিছুটা হলেও প্রশস্ত হবে। এ জাতীয় প্রোগ্রাম ভবিষ্যতে আরো অনুষ্ঠিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

কি নোট পেপার উপস্থাপনায় মুক্তিযোদ্ধা ড. প্রদীপ রঞ্জন কর বলেন, জেনোসাইড কোনো হালকা বিষয় নয়। এর স্বীকৃতি চাওয়ার আগে ঠিক করতে হবে, কিভাবে এই স্বীকৃতি আদায় করা যায়? এই স্বীকৃতি আদায় করতে গিয়ে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে? কারণ গত ৪৭ বছরে পৃথিবী বদলেছে, বদলেছে আমাদের বাংলাদেশও। হালকা উদ্যোগে একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় কঠিন হবে।

কোনো জাতি/নৃতাত্ত্বিক/গোত্র/ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার প্রয়াসকে জেনোসাইড বলা হয়ে থাকে। এই সংজ্ঞা ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশনে গৃহীত হয়েছে। জেনোসাইড এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই সংজ্ঞায় বাংলাদেশে একাত্তরের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা ও ২ থেকে ৪ লাখের বেশি নারীকে নির্যাতন-ধর্ষণ, শারীরিক ও মানসিক আঘাত, জোরপূর্বক ক্যাম্পে আটকে রেখে পাঞ্জাবি বংশধর জন্মদানের প্রয়াস, সম্পদ লুট, ১ কোটি মানুষকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে বিতাড়ন এবং ধর্মীয় মাইনরিটি ক্লিলিঞ্চিং একাত্তরে এ সব কিছুই হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংগঠিত হয়েছে এবং এগুলো সবই জেনোসাইড হিসাবেই চিহ্নিত। একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা শুধু গণহত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আরো অনেক বর্বরতা সংঘটিত হয়েছে এবং এসব কিছু মিলেই জেনোসাইড।

ড. প্রদীপ রঞ্জন কর আরো উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একাত্তরের জেনোসাইডের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও জেনোসাইড সম্পর্কে নানা সংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল। এমনকি টাইম ম্যাগাজিনেও ‘জেনোসাইড’ নামে মূল রচনা ছাপা হয়েছে। এছাড়াও একাত্তরের জেনোসাইড এমন ধরনের জেনোসাইড ছিল, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বা সংবাদ সংস্থা যেমন, সেন্ট লুইস পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, সোভিয়েত সংবাদ সংস্থা তাস, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। এমনকি জাতিসংঘের ভাষ্যেও উঠে এসেছিল। এ ছাড়া এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকা থেকে শুরু করে আমেরিকান জুরিস্ট কমিশন ১৯৭২, ১৯৭৬ সালে একাত্তরের এই হত্যাকাণ্ডকে জেনোসাইড হিসেবে চিহ্নিত করে।

এছাড়াও একাত্তরে যেসব বিদেশী সংবাদকর্মী ও বিভিন্ন বিদেশী সেবাদানকারী এখানে কাজ করেছেন, তাদের ভাষ্যেও জেনোসাইডের কথা উঠে এসেছে। জেনোসাইডের বিষয়টিতে উপমহাদেশের বাইরে বেশ কিছু প্রকাশনা সংস্থা উল্লেখ করেছে। গিনেস বিশ্ব রেকর্ডে বাঙালিদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতার বিষয়টিকে বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত পাঁচটি বৃহৎ জেনোসাইডের অন্যতম রূপে তুলে ধরা হয়।
 
মার্কিন সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন। তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সরাসরি জেনোসাইড চালানোর অভিযোগ করেন।

২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ’ তাদের অবমুক্তকৃত দলিল প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে 'সিলেকটিভ জেনোসাইড' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
 
ঢাকায় অবস্থিত তৎকালীন আমেরিকান কনস্যুল জেনারেল আর্চার ব্লাড ওয়াশিংটনে ওয়াশিংটনে যে জরুরি ব্লাড টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তার শিরোনাম ছিলো 'সিলেকটিভ জেনোসাইড' আর অ্যান্থনি মাসকারেন্স এর সেই বিখ্যাত রিপোর্টটিরও শিরোনাম ছিলো ‘জেনোসাইড’।

১৯৮১ সালে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়, মাত্র নয় মাসে এবং যে দ্রুততায় বাংলাদেশে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দৈনিক গড়ে ৬০০০-১২০০০ মানুষ খুন করা হয়েছে মাত্র ২৬০ দিনে। অথচ কম্বোডিয়ায় এই হার ছিল ১২০০।
 
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত নির্মম গণহত্যার বিষয়টি ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো ও গবেষণা হচ্ছে। কানাডা ও আর্জেন্টিনা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি ও ডিপল ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ম্যাকোরি, ইউনিভার্সিটি অব হংকং ও পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লজে একাত্তরের জেনোসাইডের বিষয়টি পড়ানো হচ্ছে। তাই সংজ্ঞাগত ও তাত্ত্বিকভাবেই বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডকে স্বীকৃতি না দেওয়ার কোনো কারণ নেই।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত