জুয়েল রাজ, লন্ডন থেকে

০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ১৯:৩৯

বিশ্বজুড়ে ছন্দপ্রভা ছড়িয়ে দিলো ‘ছান্দসিক’

"ছন্দপ্রভা ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বপ্রাণে" এই স্লোগান নিয়ে রোববার (১ সেপ্টেম্বর) লন্ডনের ব্রাডি আর্ট সেন্টারে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক আবৃত্তি উৎসব ২০১৯। শুধু আবৃত্তি নিয়ে আবৃত্তি সংগঠন ছান্দসিকের এমন আয়োজন মুগ্ধ করেছে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের।

কিংবদন্তি সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অনলাইনে উৎসবের উদ্বোধনী ঘোষণা করেন। দুপুর সাড়ে তিনটা থেকে শুরু হওয়া উৎসব চলে রাত ১১টা পর্যন্ত।

যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সুলতান মোহাম্মদ শরীফ, মুক্তিযোদ্ধা খলিল কাজী এমবিই, লোকমান হোসেন এবং বাংলাদেশ হাইকমিশনের কমার্শিয়াল সেক্রেটারি এস এম জাকারিয়া হক প্রদীপ প্রজ্বলন করে আবৃত্তি উৎসবের শুভ সূচনা করেন।

ছান্দসিক সম্মাননা ২০১৯ প্রদান করা হয় আবৃত্তি শিল্পী সাংবাদিক উদয় শংকর দাশকে।

যুক্তরাজ্যের আবৃত্তি শিল্পীদের পাশাপাশি উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দেন মুনমুন মুখার্জী। ছিলেন কলকাতার আরেক গুণী শিল্পী সুজাতা চৌধুরী, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ, আমেরিকা থেকে এসে যোগ দিয়েছিলেন নজরুল কবীর।

প্রেম বিরহ দ্রোহের কবিতার পাশাপাশি কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ও আবৃত্তি শিল্পীরা বাংলাদেশকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। সতত সুপ্রিয় যখন ভারতের বাবরী মসজিদ ভাঙা পরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে যখন আবৃত্তি করেন তখন পুরো গ্যালারি নিস্তব্ধ হয়ে যায়। মুনমুন মূখার্জী যখন আশীষ মুখোপাধ্যায়ের ভাগ মানি না দাগ মানি না, কবিতাটি আবৃত্তি করেন তখন মনে হয় কাঁটাতারে দেশ ভাগ হলেও আসলেই তো আকাশ মেঘ, পাখিদের কি দেশ হয়? ভাষার কি কোন দেশ হয়?
কলকাতার আমন্ত্রিত আরেক গুণী আবৃত্তি শিল্পী সুজাতা চৌধুরী একে একে শোনান রবীন্দ্রনাথের আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে। তার নিজের লেখা বরাকের কোলে জন্ম আমারসহ বেশ কিছু কবিতা।

নজরুল কবীর শহীদ কাদরীর প্রবাস জীবনের হাহাকার নিয়ে যখন চড়ুই দেখে কবির বাংলাদেশের আকুলতা বিলাপ করেন প্রবাসী দর্শকদের বুকটা কেমন মোচড়ে উঠে সেই চড়ুইয়ের জন্য।

মুনিরা পারভীন পাঠ করেন অপূর্ব শর্মার বীরাঙ্গনা কথা থেকে আমি প্রভা রানী বলছি। আমাকে গ্রামের লোক এখনো পাঞ্জাবির বউ বলে, আমার ছেলে কাজলকে বলে পাঞ্জাবির ছেলে... নাম ধরে ধরে ঠিকানা পরিচয় দিয়ে যখন ধর্ষক রাজাকারদের বিচার না হওয়ার, অপবাদ লাঞ্ছনার কষ্টের বর্ণনা করেন সেই ব্যর্থতা দর্শকদের পোড়ায়। অনুষ্ঠানের লাইভ দেখে এক দর্শক মন্তব্য করেন- এই আবৃত্তির পর অনুষ্ঠানটি বিরতি দেয়া উচিত ছিল কিছু সময়। চোখের পানি মোছার সময়টুকু অন্তত দরকার ছিল।

উদ্বোধনে সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী বলেন, বিলেতে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক আবৃত্তি উৎসব নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। অস্থির সময়ে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধই বলা যায় এই উদ্যোগকে। কবিতা প্রেমের কথা বলে, সাম্যের কথা বলে, আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা বলে। আবৃত্তিশিল্পীরা তাদের কণ্ঠশৈলীতে তা হৃদয়গ্রাহী করে তোলেন। কবিতার প্রসারে এবং প্রচারে এই ধরণের উৎসব আমাদেরকে আশাবাদী করে। নতুন প্রজন্মের ইতিহাস বিমুখতা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি যে উদাসীনতা নিয়ে আমারা ভীত। সেই ভীতিকে দূর করবে এই উৎসব। বিলেতে এমন বৃহৎ আয়োজন, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষী আবৃত্তি শিল্পীদের এক মঞ্চে নিয়ে আসার মত দুঃসাহসী কর্মটি জনপ্রিয় আবৃত্তিশিল্পী মুনিরা পারভীনের নেতৃত্বে সম্পাদন করছে ‘ছান্দসিক’ তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা ও আশীর্বাদ রইল। বাংলাকে, বাংলা ভাষাকে প্রবাসে বাঁচিয়ে রাখবে এমন আয়োজন। তাদের এমন শৈল্পিক প্রয়াস দীর্ঘস্থায়ী হউক। এই শুভকামনা।

আহাকাম উল্লাহ বলেন, আমাদের হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারাকে প্রবহমান রাখতে প্রবাসীদের ভূমিকা কোনও অংশেই কম নয়। চেতনার স্বপ্নিল আকাশকে বহুবর্ণিল করতে তাদের সময় উপযোগী বিভিন্ন উদ্যোগ বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের স্বাতন্ত্র্যকে উদ্ভাসিত করে চলেছে। বাঙালিয়ানার গর্ব ও গৌরবকে ব্রিটেনে বসবাসকারী বাঙালিরা ঠিক যেভাবে ধারণ ও লালন এবং প্রচার করে চলেছেন তা এক কথায় অনন্য। এখানে দেশের মতোই প্রতিটি উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় অত্যন্ত নান্দনিকতায়। বাঙালির প্রতিটি দিবসই পালন করা হয়ে থাকে সাড়ম্বরে। নাট্য উৎসব যেমন হয়, তেমনিভাবে আয়োজন করা হয় সংগীত উৎসবের, হয় বইমেলা। সাহিত্য সভা এবং আবৃত্তিচর্চাও হয় নিয়মিত। আলোচনা অনুষ্ঠান আর নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সারা বছরই মুখর থাকেন বিলেত প্রবাসীরা। যুক্তরাজ্যে সব ধরণের উৎসবের আয়োজন হলেও আবৃত্তি উৎসব হয়নি কখনও। এই বন্ধ্যত্ব দূর করতে আবৃত্তি সংগঠন ছান্দসিক এগিয়ে এসেছে। ছন্দপ্রভাকে বিশ্বপ্রাণে ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয় নিয়ে সংগঠনটি প্রথমবারের মতো আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক বাংলা আবৃত্তি উৎসবের। যা অনেক আগেই হতে পারতো। দেরিতে হলেও এই উদ্যোগ গ্রহণ করায় ছান্দসিককে আমি মুগ্ধচিত্তে সাধুবাদ জানাচ্ছি। এমন আয়োজনে আমি গভীরভাবে আপ্লুত।

বাঙালিয়ানাকে বিশ্বময় উদ্ভাসিত করতে এ ধরণের উদ্যোগের কোনও বিকল্প নেই। এমন একটি সময়ের প্রাক্কালে এই উৎসবটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যে সময়টা নানা কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ। এ অনুষ্ঠানের তিনমাস পর আমরা পালন করবো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে আমরা উদযাপন করবো স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ এ দু’য়ের সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ব্রিটেন। একাত্তরে জাতির পিতাকে গ্রেপ্তারের পর করাচিতে দীর্ঘ কারাভোগ শেষে প্রথম তিনি জনসমক্ষে আসেন এই ব্রিটেনেই। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিরা যে ভূমিকা রেখেছেন তা এক কথায় অতুলনীয়। সেই ভূমিতে ছান্দসিকের এই আয়োজন একদিক থেকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই ঐতিহাসিকও বটে।

চতুর্থত প্রজন্মের প্রতিনিধি শিশু শিল্পী তাজরিয়া রহমান, নাশিতা নূর আফরা খন্দকার আবৃত্তি দিয়ে শুরু হয় আবৃত্তি পর্বের মূল অনুষ্ঠান। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে আবৃত্তি করেন উদয় শংকর দাশ, তানজীনা নূর ই সিদ্দিকী, সৈয়দ রুম্মান, সোমা দাশ, মিছবাহ জামাল, মহুয়া চৌধুরী, মঈনুল হোসেন মুকুল, সুস্মিতা সাবরিনা এনি, জেবতিক রাজীব, ড. আনোয়ারুল হক, কাজী রাহনুমা আক্তার, হাসিনা আক্তার, ফকরুল আম্বিয়া, পপি শাহনাজ, রাজ দাশ, সোমাভা বিশ্বাস, বুলবুল হাসান, সাঈদা সায়মা আহমেদ, লুৎফুন নাহান বেবী, সতত সুপ্রিয় রায়, নজরুল ইসলাম অকিব, রওশন সিমি, প্রিয়জ্যোতি বাবু, তাহেরা চৌধুরী লিপি, স্মৃতি আজাদ, ফয়জুল ইসলাম ফয়েজ নূর, শহীদুল ইসলাম সাগর, উর্মি মাজহার, সমর সাহা, আরফুমান চৌধুরী, শতরূপা চৌধুরী, জিয়াউর রহমান সাকলাইন, রিজওয়ান মারুফ, মুনিরা পারভীন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন রেজোয়ান মারুফ।

উৎসবের আহবায়ক মুনিরা পারভীন ব্রিটেনের দর্শক, শুভাকাঙ্ক্ষী স্পন্সর, গণমাধ্যমকে অনুষ্ঠানের সাফল্যের কৃতিত্ব দেন। তিনি বলেন, আমরা হয়তো সাহস করে উদ্যোগ নিয়েছি, কিন্তু সার্বজনীন যে সহযোগিতা পেয়েছি সবার কাছ থেকে। তিনি ছান্দসিক পরিবারের বাইরে আন্তর্জাতিক সমন্বয়ক অপূর্ব শর্মাকেও বিশেষ ধন্যবাদ দেন, বাংলাদেশে বসে যিনি যাবতীয় প্রকাশনা সহ দেশে বিদেশে যোগাযোগ ও সমন্বয় ঘটিয়ে উৎসবকে সফল করেছেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত