একুশ তাপাদার

১২ জানুয়ারি, ২০১৬ ০১:৩১

শব আশ্রয়কেন্দ্র

"কেবল বেঁচে থাকাই কোন জীবন নয়, সৃজনশীলতায় বেঁচে না থাকলে শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকার কোন মূল্যই নেই"।

নিজের ৮২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে সম্প্রতি এমনটাই বলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর এই কথারই প্রতিফলন পাওয়া গেল এই সপ্তাহেই মুক্তি পাওয়া তাঁরই অভিনীত  'পিস হ্যাভেন' চলচ্চিত্রে।

পরিচালক সুমন ঘোষ তাঁর চলচ্চিত্রের নামের মধ্যে শুরুতেই একটি ভ্রান্তিতে পড়ার সুযোগ রেখেছেন। ইংরেজি হ্যাভেন (Heaven) শব্দের অর্থ স্বর্গ কিন্তু তাঁর চলচ্চিত্রটির নামে Heaven নয় আছে Haven যার মানে আশ্রয়স্থল। 'পিস হ্যাভেন' অর্থাৎ 'শান্তিপূর্ণ আশ্রয়স্থল'।

এই আশ্রয়স্থলটি বেঁচে থাকা মানুষের নয়, মানুষের শবদেহের।

ছবির শুরুতেই দেখা যায় সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ মারা গেছেন যার একমাত্র ছেলে বিদেশে। কাজের লোক ছাড়া আত্মীয়স্বজনও কেউ নেই যারা কিনা ধর্মীয় ভাবে সৎকার করতে পারেন। ছেলে বিদেশ থেকে আসা পর্যন্ত লাশ সংরক্ষণেরও কোন ব্যবস্থা পাওয়া যায় না কারণ বিশাল শহরের একটি মাত্র মরদেহ রাখার জায়গায় যথারীতি ঠাঁই নেই। শেষে ছেলের বন্ধুকে দিয়েই দায়সারাভাবে সে কাজ সম্পন্ন হয়।

এই পরিস্থিতিতেই ছবির গল্প বেড়ে উঠে প্রয়াত বৃদ্ধের সত্তরোর্ধ্ব তিন বন্ধুকে নিয়ে। এই তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের তিন শক্তিমান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায় এবং পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

এদের কেউ নিঃসন্তান। কারো সন্তান থাকেন দেশের বাইরে। এমন অবস্থায় মৃত্যুর পরে তাদের দেহগুলোর কি সংস্থান হবে সেই ভাবনা পেয়ে বসে তাদের। জীবনের অমোঘ সত্য মৃত্যুকে তারা গ্রহণ করতে চান স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু মৃত্যু ভাবনা তাদেরও বিষণ্ণ করে, নস্টালজিক করে সেই সাথে চলে নিজেদের শবদেহের সংস্থান ভাবনা। ‘পিস হ্যাভেন’ ছবির অন্যতম কাঠামো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রটা মৃত্যুকে পাত্তাই দেয় না। মৃত্যু যেন বায়োলজিক্যাল ক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয় কিন্তু অন্য দুই চরিত্র অতটা দার্শনিক দৃষ্টিকোণে দেখে না। নিজেদের শবদেহের সংস্থান ভাবনার অতি কঠোর একটি পরিস্থিতিতেও হাসি ঠাট্টায় এগোতে থাকে ছবির গতি।

বৃদ্ধ মানেই বাতিল। তিনজনই বুঝতে পারেন এই সমাজ এমনকি নিজেদের পরিবারের কাছেও তাদের উপস্থিতি মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। তাঁরা বেঁচে আছেন কেবল একটি শরীর হয়ে। অথচ যারা মূল্যহীনতার নিরব রায় দিচ্ছেন তাদের প্রত্যকেই এই পরিণতিতে আসতে হবে।

পরাণ বন্দ্যোপাধ্যয়ের সহজাত ঠাট্টার মেজাজে বলা ডায়লগ - 'শালা মরবি তো তোরা সকলেই' দিয়ে যেন পরিচালক সে কথাই বলবার চেষ্টা করেছেন।

চলচ্চিত্রে পিস হ্যাভেন একটি শব আশ্রয়কেন্দ্র। যেখানে একসাথে তিনটি মরদেহ সংরক্ষণ করা যায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। তিন বন্ধু ঠিক করেন নিজেরাই এরচেয়ে ভাল একটি শব সংস্থানকেন্দ্র গড়ে তুলবেন।

বাজেট ঠিক করে একদিন সকালে তাই অদ্ভুত এক যাত্রা শুরু করেন তারা। ছবিটা বাস্তব থেকে পরাবাস্তবের দিকে চলে যায়। তাঁরা নষ্টালজিয়ায় পড়ে ফেলে আসা জীবনের কিছু চরিত্র, কিছু ঘটনার ফের মুখোমুখি হন, মেলাতে চান হিসাব নিকাশ, করতে চান আত্মপক্ষ সমর্থন।

এখানে পরিচালকের কাছে দর্শকের প্রত্যাশা যখন নতুন কোন জীবনবোধ পাওয়ার মাত্রা পায় তখনি ঠাস করে চলচ্চিত্রটি শেষ হয়ে যায়। যেন সুন্দর গতি নিয়ে এগোনো যাত্রীবাহী কোন গাড়ির হঠাৎ হার্ডব্রেক কষে চালক বলল - নাহ্‌ আর যাব না, নেমে পড়ুন আপনারা!

সম্ভবত পরিচালক এই চলচ্চিত্রের শেষটা নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। সমুদ্র সৈকতের শেষ দৃশ্যটি তাই নতুন কোন দোত্যনা তৈরি করতে পারেনি।

মৈনাক ভৌমিকের সংগিতায়োজন চলচ্চিত্রের মেজাজের সাথে মাননসই হলেও আলোকচিত্রে প্রত্যাশা না মেটার কথা বলা অমূলক হবে না।

সুমন ঘোষ পরিচালিত 'পিস হ্যাভেন' চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন - সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায়, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নীল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত