নিজস্ব প্রতিবেদক

১৫ ফেব্রুয়ারি , ২০১৬ ২২:৫৯

গানের শুদ্ধতা বলে কিছু নেই : করিম উৎসবে মৌসুমী ভৌমিক

"একটা কথা প্রায় শোনা যায়- শুদ্ধভাবে গান গাওয়া, আর ভুলভাবে গাওয়া। গানের শুদ্ধতা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। কোনটা যে ঠিক শুদ্ধ তা আমি ঠিক বুঝি না। কোনভাবে গাওয়াকে আমরা শুদ্ধ বলবো। কতোটা সরে গেলে তাকে বিচ্যুত বলবো। অনেক রকমভাবে মানুষ গান গায়। একেকজন একেককভাবে গায়। তাতে তো অসুবিধার কিছু নেই।"

সোমবার রাতে সিলেট নগরীর কবি নজরুল মিলনায়তনে আয়োজিত শাহ আবদুল করিম জন্মশতবার্ষিকী উৎসবে এসব কথা বলেন শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক।

এর আগে আলোচনা পর্বে আলোচকরা করিমের গান শুদ্ধভাবে গাওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন।

মৌসুমী বলেন, "রবীঠাকুরেরও গানে তো কোনটা বিশুদ্ধ তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। বাউল পদকর্তাদের গানের ক্ষেত্রে তো সেটা আরো অসম্ভব। বাউলরাও তো অনেকসময় একটা গান অনেকভাবে গেয়ে থাকে। একটা গানের ৪/৫টা ভার্সন থাকে। যে যেমন করেই গাক এই গানগুলো টিকে থাক।"

উৎসবে তিনি প্রায় ৪৫ মিনিট করিমের গান ও সিলেট অঞ্চলের গান নিয়ে কথা বলেন। বক্তৃতার পাশাপাশি গানও শোনান পশ্চিমবাংলার এই বিখ্যাত শিল্পী। যিনি দীর্ঘদিন ধরে সিলেট অঞ্চলের গান নিয়ে গবেষণা করছেন।

বক্তৃতার শুরুতেই লোকগান নিয়ে গবেষনা করা এই শিল্পী বলেন, "এই অনুষ্ঠানে বলার মতো যোগ্য আমি নই। আপনারা আমার থেকে আবদুল করিম সম্পর্কে অনেক ভালো জানেন। আমি পশ্চিম বাংলা থেকে এসেছি। আমার উচ্চারণও ভিন্ন। এখানে আমি কিছু বললে তা আরোপিত শোনাবে। তাছাড়া পূর্ববাংলা ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে একটা দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কও রয়েছে।"

ভিন্ন গায়কীর কারণে দুই বাংলাতেই সমাদৃত এই শিল্পী বলেন, "আমার কোনো দেশ নেই। আমার কোনো ঘর নেই। সিলেটে আসলে এখানকার অনেকের ঘরই আমার নিজের ঘর মনে হয়।"

এই সঙ্গীত গবেষক বলেন, "গান শুধু গাওয়া ও শোনা দিয়ে বোঝা যায় না। গান হলো একটা মূহূর্ত। অনেক উপাদানে এটি নির্মিত হয়। গানকে বুঝতে হলে সেই মূহূর্তটাকে বুঝতে হবে।

পশ্চিম বাংলার অনেক শিল্পী করিমের গান গাইলেও গানের ভণিতা ব্যবহার করেন না এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে মৌসুমী ভৌমিক বলেন, অনেক গান লেখককে ছাপিয়ে যায়। যে গান শিল্পীকে ছাপিয়ে যায় সেটাই স্থায়িত্ব পায়। রবী ঠাকুরের গানে তো কোনো ভণিতা নেই। তাই বলে কি রবী ঠাকুরের গান টিকে থাকেনি। আমার মা শাহ আবদুল করিমের 'আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম' এই গানটা জানেন। কিন্তু গানটি কে লিখেছেন তা জানেন না। কিন্তু করিমের গান তো তাঁর কাছেও পৌঁছেছে।"

করিমের এই গান সম্পর্কে তিনি বলেন, "আমরাও অনেক সময় বলি, আগে খুব ভালো ছিলাম। আগেকার দিন অনেক ভালো ছিলো। কোন আগে তে আমরা ভালো ছিলাম? আমার তো বিশ্বাস হয় না কোনো একটা আগে তে আমরা বিশেষ ভালো ছিলাম। দেশভাগের আগে কী আমরা খুব ভালো ছিলাম? তাহলে দেশ ভাগ হলো কেনো?"

"করিম শাহকে বুঝতে হলে তাঁর সময়, তাঁর সমসাময়িক শিল্পী, সাহিত্যিক, কবিদেরও জানতে হবে, বুঝতে হবে। তাদের প্রেক্ষিতে করিম শাহকে চিনতে হবে।"- বলেন মৌসুমী ভৌমিক।

তিনি সিলেটের লোকসঙ্গীত শিল্পী চন্দ্রবর্তী রায়বর্মন ও সুষমা দাশের কথা উল্লেখ করে বলেন, "একদিন আমি চন্দ্রাবতী মাসিমা ও সুষমা মাসিমার সাথে দেখা করতে গেছি। তাদের বললাম, আগের দিনই আমি করিম শাহর সাথে দেখা করে এসেছি।

একথা শুনেই সুষমা মাসিমা বললেন- করিম ভাই কেমন আছেন?"

মৌসুমী বলেন, "আমার মনে হয় দেশ যদি ভাগ না হতো তা হলে সুষমা মাসিমা এমনটি বলতেন না। করিম ভাইকে হয়তো চিনতেনই না।"

তিনি আগের দিনের সিলেট শহরের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, "কাল (রোববার) সরস্বতী পূজার শোভাযাত্রা হচ্ছে। হঠাৎ একজন অম্বরিশ দাকে (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অম্বরিশ দত্ত) এসে জিজ্ঞেস করলেন- এখানে কী হচ্ছে?"

তিনি বলেন, "আমাদের এখানে মাইনোরিটিকে না জানলেও চলে। মাইনোরিটির সংস্কৃতি সম্পর্কে না জানলেও চলে। এরকম কোনো সময়ের কথা বলতে পারবো না যে- আমরা পরষ্পরকে চিনি। এই যে ‌'আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম', আগে আসলে অনেককিছু না জেনে আমরা সুন্দর দিন কাটাতাম।"

বক্তৃতায় এ পর্যায়ে প্রয়াত চন্দ্রবতী রায় স্মরণে তাঁর শিখিয়ে দেওয়া গোষ্টের গান- 'আমি যাবো না আর গো চারণে, শ্রীধামরে তো বিনয় কেনে' গেয়ে শোনান মৌসুমী ভৌমিক। এরআগে তিনি শাহ আবদুল করিমের 'বন্দে মায়া লাগাইছে' গানটি পরিবেশন করেন।

মৌসুমী ভৌমিক বলেন, "করিম বাউল ছিলেন কী না, বাউল সাধক ছিলেন কী না সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু আমার মনে হয় একই মানুষ গৃহি এবং ত্যাগী হতে পারে। করিম ছিলেন সেরকমেরই একজন মানুষ। বৈষয়িক কোনো বিষয়ে তাঁর কোনো মোহ ছিলো না।"

জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে শাহ আবদুল করিমের শিষ‌্য এবং এই অঞ্চলের বাউল ও লোকগানের শিল্পীরা করিমের গান পরিবেশন করেন।

এর আগে আলোচনা পর্বে শাহ আবদুল করিম জন্মশতবর্ষ উদযাপন পর্ষদের আহবায়ক কবি শুভেন্দু ইমামের সভাপতিত্বে ও আবৃত্তিশিল্পী নাজমা পারভীনের পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক উপাচার্য ড. তপোধীর ভট্টাচার্য, সিলেট মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ উদ্দিন, লেখিকা স্বপ্না ভট্টাচার্য, কবি তুষার কর, লেখক আনিসুল হক, বাউল তনয় শাহ নুর জালাল ও উৎসব কমিটির সদস্য সচিব সুমনকুমার দাশ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত