ধ্রুব গৌতম

২৬ জুন, ২০১৭ ০২:২৫

হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য : মুকুটটা পড়ে আছে, রাজাই শুধু নেই

হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য। সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের যুগযুগ কিংবদন্তী। শুদ্ধ উচ্চারণ, শৈল্পিক বাচন ও সুনিপুণ অভিনয়কারীর নাম। ডাক নাম বাবুল। সর্বমহলে পরিচিত 'বাবুল ভট' নামে। ১৯৪০ সালের ১৮ অক্টোবর সিলেট জেলার কাষ্টঘরে সংস্কৃতিপূর্ণ এক সম্ভ্রান্ত ব্রাম্মণ পরিবারে হৃদয় রঞ্জন ভট্টাচার্য্য ও কুমদিনী ভট্টাচার্য্য’র সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। গায়ের রং কাঁচা হলুদের মত হওয়ায় তাঁর নাম হয় 'হেমচন্দ্র'।

হেমচন্দ্র পিতৃহারা হন মাত্র ছয় বছর বয়সে এবং তাঁর সরলা মা বিধবা হন পঁচিশ বছর বয়সে। শুরু হয় মাতা-পুত্রের জীবনযুদ্ধ। প্রকৃত অভিভাবকের অভাবে মুখোমুখি হতে হয় জীবনের কঠিন বাস্তবতার। স্বপ্ন প্রতিনিয়ত মৃত্যুবরণ করে সাধ্যের অক্ষমতায়।

ছোটবেলা থেকে পারিবারিক প্রভাবে সংস্কৃতিচর্চার হাতেখড়ি। কাকা হিরন্ময় ভট্টাচার্য্যও ছিলেন নাট্য জগতের লোক। শিলংয়ে পড়াকালে সমগ্র আসামের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংস্কৃতির জগতে পদার্পণ। কাষ্টঘরে সরস্বতী পূজায় মঞ্চনাটকে অংশগ্রহণ তাঁর জীবনের মাইলফলক।

চালিবন্দর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে পড়ালেখা শুরু, চতুর্থ থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত শিলং, সিলেটের রাজা জি.সি হাই স্কুল থেকে এন্ট্রেন্স, এম.সি থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও মদন মোহন কলেজ থেকে বি.কম পাশ করেন। একজন নিখাদ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি শুধু সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন তা নয়। তিনি বিষয়গুলো নিয়ে রীতিমত পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। নাটক নির্দেশনা, নাটক মঞ্চায়নের বই, নাটক, কবিতা, আবৃত্তির ছন্দ, বাংলা উচ্চারণের কৌশল নিয়ে তাঁর ছিলো অগাধ জ্ঞান ও চর্চা। এছাড়াও তিনি একজন কবি, তবলাবাদক ও নাট্যকার।

১৯৬১ সালে সারা পৃথিবীতে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী পালনের উদ্যোগে সিলেটের চারদিনব্যাপী বিশাল আয়োজনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। সাংস্কৃতিক পর্বে ডাকঘর নাটকে অংশগ্রহণ করেন। এম.সি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় বিধায়ক ভট্টাচার্য্য রচিত 'বিশ বছর আগে' নাটকে অভিনয় করেন। মদনমোহন কলেজে বি.কম পড়াকালে 'ভাড়াটে চাই' ও 'কেদারদা' নাটক দুটি পরিচালনা করেন এবং 'সীতাহরণ' ও 'কান্না' নৃত্যনাট্যে অভিনয় করেন। সিলেট রামকৃষ্ণ মিশনেও 'সীতাহরণ' নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে কবি দিলওয়ারকে নিয়ে সমস্বর লেখক শিল্পী সংস্থা গঠিত হলে সত্তরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থদের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন।

১৯৬৩ সালে তিনি মদন মোহন কলেজের সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৬ সালে ঢাকা শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত প্রথম জাতীয় নাট্যোৎসবে তাঁর লেখা 'একুশের নাম বাংলাদেশ' ও কবি দিলওয়ার রচিত 'রুধিরাক্ষকাল' নাটক দুটি তাঁর নির্দেশনায় বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চস্থ করে। সম্মিলিত নাট্য পরিষদের গঠনতন্ত্র প্রনয়ণকারীদের অন্যতম তিনি। সিলেট কেন্দ্রিয় শহিদ মিনার বাস্তবায়ন পরিষদের অন্যতম সদস্য ও উদ্যোক্তাও তিনি। ২০০৮ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ, সিলেট শাখা ও সম্মিলিত নাট্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাচিত হয়ে প্রধান পরিচালকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন এবং সিলেট জেলা শিল্পকলা একাডেমীর কার্যকরী পরিষদের সদস্য ছিলেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সিলেট এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, সিলেট এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে কার্যকরী পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন। লিটল থিয়েটারের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন দীর্ঘ বছর।

১৯৬৩ সালে বেতারে যোগ দিয়ে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তাঁর রচিত 'একুশের নাম বাংলাদেশ', 'জীবন মানেই তৃষ্ণা', রবীন্দ্রনাথের লেখা 'ডাকঘর', 'পোস্ট মাস্টার' নির্দেশনা দেন ও অভিনয় করেন। বেতারের প্রথম নাটকেও তিনি অভিনয় করেন। সিলেট শিশু একাডেমীর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পঁচিশ বছর অবৈতনিক আবৃত্তি বিভাগের সিনিয়র প্রশিক্ষক ছিলেন। শিশুতোষ নাটকেরও নির্দেশনা দিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য নাটক 'ডাকঘর', 'তাসের দেশ', 'কাকাজু', 'জনরব'। সিলেট শিল্পকলা একাডেমীরও আবৃত্তি প্রশিক্ষক ছিলেন। সিলেটের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সংগঠনে আবৃত্তি, অভিনয় ও শুদ্ধ উচ্চারণ নিয়ে কাজ করেছেন বহু বছর।

১৯৭১ সালে সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থার মাধ্যমে 'কলম-তুলি-কন্ঠ সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করেন। ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ কবি দিলওয়ার রচিত “দূর্জয় বাংলা” শীর্ষক গীতি আলেখ্য করেন। অনুষ্ঠানের ধারাভাষ্যকার ও আয়োজকের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতায় তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো। পরে ভারতের করিমগঞ্জ-হাইলাকান্দি-কৈলাশহর-শিলচর এলাকায় কলম-তুলি-কন্ঠ সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে দেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত গঠন ও অর্থ সংগ্রহ করেন। তাঁর এ অসামান্য অবদানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে 'মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক' উপাধি গ্রহণ করার মর্যাদা পেয়েও তিনি সেই সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে রাজি হননি।

১৯৯১ সালে লিটল থিয়েটার গুণিজন হিসেবে তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের আয়োজনে জাতীয় আবৃত্তি উৎসবে প্রধান অতিথি বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি সুফিয়া কামালের সাথে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হন ১৯৯৩ সালে। ঢাকার আবৃত্তি সংগঠন 'স্বনন' ১৯৯৫ সালে, ঢাকার থিয়েটার আর্ট ইউনিট এর যুগপূর্তি উৎসবে অভিনেতা নির্দেশক ও সংগঠক হিসেবে ২০০৪ সালে, সিলেটের সাংস্কৃতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'সোপান' ২০০৮ সালে ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী জেলা পর্যায়ে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে।

হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য’র মত যারা সিলেটের নাটককে বিনোদনের পূর্ণমাত্রা দিয়েছিলেন, কিন্তু আজ পৃথিবীতে নেই, তারা হলেন, নির্মল চৌধুরী, বিরেন সোম, বিনয় কৃষ্ণ দাস, খলিলউল্লাহ খান, শিবু ভট্টাচার্য্য, নিতীষ সমাদ্দার, সন্দ্বীপ চক্রবর্ত্তী, সুবোধ সাহা, মাহমুদ হোসেন, হিটলার দাস সিন্টু, ইয়ার বক্স হীরা, বিদ্যুৎ কর, মোস্তফা কামাল, নিখিল কান্তি দাশ, বাবুল ঘোষ, নবীন কুমার সিংহ, ম. শমশের হোসেইন, শফিক আহমদ জুয়েল প্রমুখ।

সম্ভবত ১৯৮৩ সালের দিকে শিশু একাডেমীতে ভর্তি হই। এখনকার মত তেমন ধরাবাঁধা নিয়ম ছিলো না। প্রতিটা বিষয়েই ভর্তি হওয়া যেত। তখন দুই বোন শিল্পকলায়, তিন ভাই শিশু একাডেমীতে। আবৃত্তি ও অভিনয়ে সঙ্গীতে রামকানাই দাশ, নাচে রুপুদি, তবলায় কানু দাস ও পান্না দাস, ছবি আঁকায় অরবিন্দু দাশ। সব শিক্ষকদের সাথে পারিবারিক পরিচয় সুদৃঢ় থাকায় বাড়তি সুবিধা পেতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি। সে সময় ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে বেতন নেয়া হত বলে আমার মনে পড়ে না। বাবুল স্যারের শেখানো ছড়া/কবিতা পড়ে প্রথম একটি কবিতা লিখেছিলাম, যা সে সময় শিশু একাডেমীর দেয়ালিকায় স্থান পায়।

শুক্রবার সকাল বেলা হত আবৃত্তির ক্লাস। ক্লাস নিতেন বাবুল স্যার। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি, কালো প্যান্ট, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে আসতেন। পানে রাঙানো ঠোঁট। তিনি যখন হেলেদুলে শিখাতেন, তখন বই দেখে আর কবিতা/ছড়া মুখস্ত করতে হয়নি। তাঁর স্বরে স্বরে সুর তুলে তাঁর সুস্থকালীন সময় পর্যন্ত শিখিয়েছেন জ্ঞাঁনদাসের 'আক্ষেপ', রবীন্দ্রনাথের 'বর এসেছে বিয়ের ছাদে', 'বিয়ের লগ্ন আট্টা', 'ভোলানাথ লিখেছিলো, তিন চারে নব্বই' থেকে শুরু করে 'ছোট নদী', 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ', 'সোনার তরী', 'বিচিত্র সাধ', 'পুরাতন ভৃত্য', 'ইচ্ছে', 'দুই বিঘা জমি', 'হাট', '১৪০০ সাল', 'জুতা আবিস্কার', 'লুকোচুরি', 'বীরপুরুষ', 'ভারততীর্থ', 'বাঁশিওয়ালা', 'বাঁশি', 'হঠাৎ দেখা', 'বিসর্জন', 'দেবতার গ্রাস', 'গান্ধারীর আবেদন', 'কর্ণকুন্তি সংবাদ', কাজী নজরুল ইসলামের 'প্রভাতী', 'বিদ্রোহী', 'সংকল্প', 'বাংলাদেশ', 'ঘুম জাগানো পাখি', 'আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে', 'কান্ডারী হুশিয়ার', 'ছাত্রদলের গান', 'এক বৃন্তে দুটি কুসুম', 'সাম্যবাদী', 'ঈশ্বর', 'মানুষ', 'পাপ', 'নারী', 'দারিদ্র্য', 'কুলি-মজুর', 'আমার কৈফিয়ৎ', 'ঝিঙে ফুল', 'প্রভাতী', 'খুকী ও কাঠবিড়ালী', 'খাঁদু-দাদু', 'লিচু চোর', '১৪০০ সাল', সুকুমার রায়’র 'ভয় পেয়ো না', 'শব্দকল্পদ্রুম' ইত্যাদি। ডায়েরীতে তোলা ও বইয়ের কবিতাগুলোয় পেন্সিলে আঁকানো বিরামচিহ্ন। পানের লালাভ ক্ষুদে সুপারীর দানা পড়ে বইয়ে, ডাইরীতে লাল দাগ পড়ে থাকতো। সেগুলো আজও স্মৃতি।

শিল্পী অরবিন্দ দাশকে দিয়ে উচ্চারণের মুখের আকৃতি ও জিহ্বার অবস্থান অঙ্কন করে আমাদের দিয়েছিলেন। নরেন বিশ্বাস স্যারের বই ছিলো অনুকরণীয় পাঠ্যপুস্তক। স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, পয়ার, ইত্যাদি ছন্দের মাত্রা শেখাতেন আঙ্গুলের রেখা গুণে গুণে। প্রতিটি শব্দের উপরে প্রথম মাত্রা নৌকা আকৃতি করে এবং পরের মাত্রাগুলো নৌকার উপর দাড়ি দিয়ে দিতেন। আবৃত্তি ছাড়াও সে শিক্ষাটি কবিতা বা ছড়া লিখতে আজও কাজে লাগছে।

নীরার হার্ডবোর্ডের চিলে কোঠায় বসতেন কবি দিলওয়ার, কবি অরুণভূষণ দাশ, কবি মোয়াজ্জেম হোসেন, আবৃত্তি ও নাট্যশিল্পী মানবেন্দ্র গোস্বামী। কবি দিলওয়ার পা ভাঁজ করে টেবিলে ভর দিয়ে বসতেন। দু’চোখ বন্ধ করে থুতনীতে করজোড় ঠেকিয়ে গুরুগম্ভীর আলাপ চালিয়ে যেতেন। কথায় কথা মেলানোর সাহস করতেন অরুনভূষণ, মোয়াজ্জেম হোসেন। মানবেন্দ্র গোস্বামী তখনো সুস্থ। দেখা-শোনার চেয়ে আমার বেশী কিছু করার ছিলো না। শিশু একাডেমী থেকে সান্নিধ্য পাওয়ায় পাইলট স্কুল থেকে বের হয়ে একটা ঢুঁ দিতাম। কলেজ-চাকুরী জীবনেও এ ছিলো নিয়মিত। নীরায় আরও যে সব গুণীজন আসতেন তারা হলেন, সুবল দত্ত, মৃদুলকান্তি চক্রবর্ত্তী, পান্না দাস, শাহ আব্দুল করিম, শিল্পী রামকানাই দাশ, মাহমুদ হক, আবুহেনা, সাগর সিংহ, রাসবিহারী চক্রবর্ত্তী, শ্যামল ভৌমিক, ভবতোষ চৌধুরী, দিনাজ দেব, শ্রীহরি দাস, কানু দাস, লুৎফুল মজিদ লিলু, অরবিন্দু দাশ, ভবতোষ রায় বর্মণ রানা প্রমূখরা ছিলেন তাঁর সুহৃদ স্বজ্জ্বন। তখন ম্যানেজার বিপ্রদাস রায় বাচ্চু, সনৎ বৈশ্য, কমরেড বাদল কর যথেষ্ট স্নেহ করতেন।

শিশু একাডেমীতে নাটক, অভিনয় করার কারণে প্রিয়জ্যোতি দাস বাবু ও উত্তম সিংহ রতন বাসায় এসে একটি নাট্য সংগঠন গড়ার বিষয়ে আলাপ করেন। নাম জানান 'সন্ধানী নাট্যচক্র'। সংগঠনের সাথে যুক্ত হই। নাটক, আবৃত্তি, গান চলে সমানতালে। ১৯৮৫ সালের এপ্রিল মাসে সন্ধানী নাট্যচক্রের হয়ে আনন্দমেলায় অংশ গ্রহণ করে পুরস্কৃত হই। সে সময়ে সংগঠনের সভাপতি ছিলেন দিলীপ কুমার দাস ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন উত্তম সিংহ রতন। ১৩৯৮ বাংলার কার্ত্তিক মাসে মিরাবাজারস্থ শ্রী শ্রী বলরাম আখড়ায় সন্ধানী নাট্য চক্রের হয়ে শারদীয় দূর্গা পূজায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দূর্গা পূজার নাটক করে শান্তনু কায়সার’র কাব্য নাটক বইটি উপহার হিসেবে লাভ করি। সিলেট তথ্য অফিসের ডায়রেক্টরীতে তখন সন্ধানীর শিশুশিল্পী হিসেবে নাম প্রকাশিত হয়।

হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য তাঁর সুহৃদ নাট্যানুরাগীদের নিয়ে ১৯৬৩/৬৪ সালে 'বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠী' গঠন করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন পান্না দাস, সাগর সিংহ, দিনাজ দেব, বিপ্রদাস রায় বাচ্চু, আশফাক আহমদ আশু, আজাদ, পঙ্কজ দেব, আশুতোষ ভৌমিক বিমল, ডা. নয়ন, হিটলার দাস সিন্টু, রঘুমণি সিংহ, বিধান চক্রবর্ত্তী, এডভোকেট লুৎফুল মজিদ লিলু, রিনা চক্রবর্ত্তী, রাবেয়া খাতুন দুলু, রুস্তুম, মকসুদ বক্ত প্রমুখ। বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠীর ডিস্ট্রিক কাউন্সিলে মিউজিক্যাল ড্রামা 'ভোলা ময়রার বায়েস্কোপ' মঞ্চস্থ করে। নাটকে অভিনয় করেন অনেকের সাথে আশুতোষ ভৌমিক বিমল। তার সংলাপ ছিলো 'সুমি সুমি লক্ষী সুমি, রাগ করো না রাগ করো না'। এটা ছিলো আমার জীবনের প্রথম মঞ্চ নাটক দর্শন। বৈশাখীর আরও প্রযোজনা ছিলো বিসর্জন, এখন দুঃসময়, স্পার্টাকার্স বিষয়ক জটিলতা, সুবচন নির্বাসনে, রজনিগন্ধা, পলাতক পালিয়ে গেছে, জীবন্ত স্ট্যাচু, ভোলা ময়নার বায়োস্কোপ। এক সময় সন্ধানী নাট্য চক্র ভেঙ্গে যায়। এক অংশের নাম হয় সন্ধানী নাট্যদল, কিন্তু সেটি বেশিদিন টিকতে পারেনি। কিছু দিন অপেক্ষা করে বৈশাখী নাট্য গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয়ে পুনর্জাগরণের কাজ হাতে নিই। বাবুল স্যারের নীরা হোটেল আর হাসান মার্কেটের সামনে পার্টসের দোকান অটোমোবাইলে বসে কাজ করেছি। ম্যানেজার ছিলেন মণিপুরী সম্প্রদায়ের।

প্রতি শুক্রবার শিশু একাডেমীর আবৃত্তির ক্লাস শেষে বৈশাখীর মহড়া হত শিশু একাডেমীর দোতলায়, মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'প্রহসন', 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ', 'একেই বলে সভ্যতা', 'বৌদির বিয়ে', রবীন্দ্রনাথের 'কর্ণকুন্তি সংবাদ', 'দেবতার গ্রাস', 'পোষ্ট মাস্টার' ইত্যাদি। সে সময়ে সংগঠনে কাজ করে শিমুল চক্রবর্ত্তী, পিনুসেন দাশ, রাজীব দাস রাজু, রজত, চন্দনা, মণি, আফসানা সালাম আরও অনেকে। তবে বেশ ক’দিন জেলা ক্রীড়া সংস্থার দোতলায় নাটকের মহড়া করি। মহড়া শেষে বাসায় ফিরতাম বাবুল স্যারের সাথে কখনোবা রিক্সায়, আবার কখনো কার চড়ে। সমিলিত নাট্য পরিষদের ১৯৯৬ সালের ৭ জুলাই থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত এবং ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে ১৯৯৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তিন মাসব্যাপী অভিনয় বিষয়ক কর্মশালায় আমরা ক’জন বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করি। সে সময় কবি শামসুর রাহমান সিলেট আসার আয়োজন হয়। আমার লেখা 'তুমি আসবে বলে' শিরোনামে কবিতাটি সে অনুষ্ঠানে আবৃত্তির জন্য আমাকে অনুশীলন করান। দূর্ভাগ্যের কারণে সে অনুষ্ঠান পণ্ড হয়।

১৯৮৪ সনের ২০ সেপ্টেম্বর সম্মিলিত নাট্য পরিষদের জন্ম হয়। হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য ছিলেন উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম। সম্ভবত প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন অম্বরিষ দত্ত, সাধারণ সম্পাদক মালিক আকতার। ৩০ অক্টোবর ১৯৯২ বাংলা সনে ১৪০০-১৪০১ বাংলা সনের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করে ৩ তিন দিনব্যাপী সিলেট প্রান্তিক চত্বরে শিল্পকলা একাডেমীর যৌথ উদ্যোগে বর্ষবরণ ১৪০০ সাল পালন করা হয়। সারা প্রান্তিক জুড়ে বৈশাখী মেলার স্টল দেয়া হয়। বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠী খাবারের স্টল দেয়। তখন দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার সিলেট প্রতিনিধি ইব্রাহিম চৌধুরী খোকনের সার্বিক সহযোগিতায় আমরা ভোরের কাগজ পাঠক ফোরাম সিলেট জেলা শাখার পক্ষ থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১৪০০ সাল কবিতা দিয়ে কার্ড কবিতা প্রকাশ করি। তিনি সিলেটের নাট্য পরিষদ ও সাংস্কৃতিক জোট দুটির প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। তবে এ দুটি সংগঠনকে প্রতিষ্ঠা করতে, রূপরেখা প্রণয়ন করতে, গঠনতন্ত্র তৈরী করতে তিনি নিঃস্বার্থভাবে যে মেধা, সময়, শ্রম বিনিয়োগ করেছেন, তার যথাযথ মূল্যায়ন তিনি পাননি। সংগঠনের কারণে নানাজনের অভদ্র আচরণের শিকারও হন। টেলিফোনে তিনি অনেকের কটুক্তি, তাচ্ছিল্যতা হজম করেন।

২৬ এপ্রিল ১৯৯৬ ইং, ১৩ বৈশাখ ১৪০৩ বাংলা শুক্রবার প্রান্তিক মিলনায়তনে 'অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্ত-মাঝে' শ্লোগানে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেট এর দ্বিতীয় দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন প্রস্তুতি পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন শ্রী হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য। যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন আশরাফুল ইসলাম চৌধুরী ও মালিক আকতার। সদস্যবৃন্দ ছিলেন মোঃ নুরুজ্জামান, বাবুল আহমদ, আব্দুল কাইয়ূম মুকুল, রাকেশ ভট্টাচার্য্য, এজাজ আলম ও প্রিয়জ্যোতি দাস বাবু। নীতিনির্ধারণী কমিটির প্রধান পরিচালক শ্রী হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, পরিচালক শ্রী ভবতোষ রায় বর্মণ ও ম. শমশের হোসেইন। কার্য নির্বাহী কমিটিতে ছিলেন আশরাফুল ইসলাম চৌধুরী, অরিন্দম দত্ত চন্দন, মালিক আকতার, চম্পক সরকার, মোঃ নূরুজ্জামান, বাবুল আহমদ, বেলাল আহমদ, জামাল আহমদ বাবুল ও প্রিয়জ্যোতি দাস বাবু।

সম্মেলনে সমিলিত নাট্য পরিষদে সদস্য সংগঠন ছিলো বৈশাখী নাট্য গোষ্ঠী সিলেট, বর্ণালী নাট্য সংঘ সিলেট, নাট্যালোক সিলেট, লিটল থিয়েটার সিলেট, নাট্যায়ণ সিলেট, কথাকলি সিলেট, সুরমা থিয়েটার সিলেট, দর্পণ থিয়েটার সিলেট, উদীচী জেলা সংসদ সিলেট, চেতনা থিয়েটার সিলেট, প্রতিবেশী নাট্য গোষ্ঠী সিলেট, গণনাট্য সিলেট, সিলেট থিয়েটার সিলেট, কম্পাস থিয়েটার সিলেট, নান্দিক নাট্যদল সিলেট ও নাট্যমঞ্চ সিলেট।

প্রথম পর্বের আলোচনা সভায় স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, শামসুল বাসিত শেরো ভাই বৈশাখী নাট্য গোষ্ঠীর কার্যক্রম না থাকায় সম্মিলিত নাট্য পরিষদ থেকে সদস্যপদ বাতিলের প্রস্তাব করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা মতামতের কারণে শেরো ভাইয়ের প্রস্তাব গৃহীত হয় ও বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠী সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সদস্যপদ হারায়। যদিও সেদিন সুরমা থিয়েটারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ কর ও চেতনা থিয়েটারের পক্ষ থেকে চন্দন রায় বৈশাখী নাট্য গোষ্ঠীকে পুনরুজ্জীবিত করার সার্বিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। থমকে যায় বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠীর পুনঃযাত্রা।

তারপরও বাবুল স্যারের সাথে আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিলো। নানা অনুষ্ঠান বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আগে তাঁর বাসায় গিয়ে তালিম নিতাম। যাবার আগে টেলিফোনে কুশল জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, 'মার কৃপা'। আমার পারিবারিক সকল আয়োজনে তিনি সর্বাগ্রে আমন্ত্রিত। সকল অনুষ্ঠানে তিনি যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছেন। আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তিনি উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছেন পিতার আবেগ নিয়ে। আমার একটা দুঃখ ছিলো খুব। বহু বছর ধরে আমি দূর্গাপূজায় তাঁকে সাদা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া অর্ঘ্য দিতাম। কিন্তু সে কাপড় তাকে কখনো পরিধান করতে দেখিনি। শুনেছি তাঁর স্ত্রী সেগুলো অন্যের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। তবুও মৃত্যু অবধি আমি দিয়ে চলেছি।

কাষ্টঘর থেকে তিনি চলে যান শাহজালাল উপশহর এলাকায়। বি ব্লকের ১৬ নং সড়কের ১৩ বাসাটি তৈরি করে নাম দেন 'আশীর্ব্বাদ'। আমার সকল অনুষ্ঠানে তিনি বিশেষ অতিথি ছিলেন। এরকম একটি অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ দিতে কমরেড বাদল করকে সাথে নিয়ে যাই তাঁর বাসায়। তিনি ভিতরের বারান্দায় বসে আছেন উদাস হয়ে। দাঁড়িগুলো সেভ করা থাকলেও আনাচে কানাচে রয়ে গেছে। নমস্কার বিনিময় করেন। আপনি সম্বোধন করে যখন নাম জানতে চান, তখন আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে! বাবার মত যিনি ছায়া হয়ে ছিলেন মাথার উপর, তিনি আজ অসুস্থ। চোখের জল সংবরণ করতে পারিনি। কি এক অশনী সংকেতে বুকের মাঝে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হলো। ফিরে আসি।

১৯ জুন ২০১৫ শুক্রবার মাউন্ট এডোরায় বাবুল স্যারকে শেষ দেখা দেখে আসি। তিনি লাইফ সাপোর্টে। একমাত্র মেয়ে ডা. অচিরা ভট্টাচার্য্য সুমি ছিলো উপস্থিত। গোপনে মোবাইল দিয়ে একটা ছবি তুললাম। তাঁকে দেখে মান্না দে’র সেই বিখ্যাত গানটা মনে পড়ে গেলো, 'সারাটা জীবন পালংকে শুয়ে কাটালাম/ তোরা এবার আমার মাটিতে বিছানা কর/ শ্বেত পাথরের ঘর দালানটা ছেড়ে/ এবার মাটি যে হবে আমার শোবার ঘর. . . / সারাটা জীবন একটু ঘুমাতে চেয়ে/ আসেনিতো ঘুম ঘুমের ওষুধ খেয়ে/ এবার ঘুমালে সে ঘুম যদি না ভাঙে/ সে মরণঘুম অভিশাপ নয় গো . . .।

২৭ জুন ২০১৫ সালে বিকালে নবশিখার সভাপতি নাট্যশিল্পী ধ্রুবজ্যোতি দে বাবুল স্যারের মুত্যু সংবাদ জানালে তাড়াহুড়ো করে শ্মশানে যাই। মারা গিয়েছিলেন সকাল সাড়ে ১১টায়। শেষবারের জন্য আপোষহীন অবয়বের শক্ত চোয়াল দেখতে পারিনি, চিতা জ্বলতে দেখি। যারা বিভিন্ন সময় তাঁকে সহযোগিতার নামে তিরস্কার করেছে, তাদের ভনিতা দেখে হতবিহ্বল হই। সেদিন আশির দশকের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা উমাপদ আচার্য্য দাদার বাবা ও খাদিমে পঞ্চাশোর্ধ নিঃসন্তান পিতা আত্মহত্যা করে মারা গেলে পাশে তাদেরও চিতা জ্বলতে দেখি।
ভাবি আজ তিনি সব কিছুর ঊর্দ্ধে। সিলেটের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সূঁতিকাগার নীরা হোটেল নেই, তিনি নেই। তবু তাঁর 'আশীর্ব্বাদ' নামের সাজানো রাজাপ্রাসাদ ও সিলেট জুড়ে তাঁর কর্মের মুকুটটাতো পড়ে আছে। রাজাই শুধু নেই।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত