নিজস্ব প্রতিবেদক

৩০ মে, ২০১৫ ১৩:২৬

অপ্রতিম ঋতুপর্ণ ঘোষ

২০১৩ সালের ৩০ মে মাত্র ৪৯ বছর বয়সেই আচমকা থেমে গিয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রের নবযুগের অগ্রপথিক ঋতুপর্নের শারীরিক জীবন। শত কাজের ভীড়ে হঠাৎ করেই অখণ্ড অবসরে চলে গিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ঋতুরাজ। হয়তবা বেশ কিছুটা অভিমান নিয়ে।

কিন্তু এই অল্প সময়েও বাংলা চলচ্চিত্রকে ঋতু টেনে নিয়ে গেছেন অনেক দূর। দিয়েছেন নতুন অনেক উপস্থাপন ভাষা।  বাংলা সিনেমার  দর্শক যখন ছবিঘর থেকে মুখ ফিরিয়েছে, তখন নতুন করে তাঁদের হলে টেনে এনেছিলেন তিনি৷ নাগরিক জীবনের আলোছায়া, সংকট, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এমন শিল্পিত উপস্থাপনা দেখে দর্শক স্বাদ পেয়েছিলেন এক নতুন ঘরানার৷ তিনি যেমন ধরিয়ে দেন বাঙালি জীবনের ‘উৎসব’, তেমন তিনিই চিনিয়ে দেন বাঙালির ‘অসুখ’৷ বাংলা ছবিতে  সেই যে ‘হীরের আংটি’ তিনি তুলে দিয়েছিলেন বাঙালির হাতে, তারপর থেকে একের পর এক ছবিতে হয়েছে তাঁর নিজস্ব সিনেমা ভাবনার ‘শুভ মহরত’৷ বাঙালির ‘আবহমান’ ‘অন্তরমহল’কে তিনি চিনেছিলেন তাঁর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে৷ আর তা চিনিয়ে দিয়েছিলেন নান্দনিক উপস্থাপনায়৷

কেবল পরিচালনাই নয়, নিজের সিনেমায় দারুন সব অভিনয় করে চিনিয়েছিলেন নিজের জাত।

কর্মজীবন (১৯৯২-২০০৩):

ঋতুপর্ণ ঘোষের কর্মজীবন শুরু হয় বিজ্ঞাপনী দুনিয়ায়। তাঁর পরিচালনায় প্রথম ছবি হিরের আংটি ১৯৯২ সালে মুক্তি পায়। এটি ছিল ছোটোদের ছবি। ছবিটি তৈরি হয়েছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাস অবলম্বনে। এতে অভিনয় করেছিলেন বসন্ত চৌধুরী, মুনমুন সেন প্রমুখেরা।

১৯৯৪ সালে তাঁর দ্বিতীয় ছবি উনিশে এপ্রিল মুক্তি পায়। এই ছবিতে এক মা ও তাঁর মেয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের কাহিনি দেখানো হয়েছে। ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়। ১৯৯৫ সালে এই ছবি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পায়। এরপর দহন মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে। ১৯৯৮ সালে এই ছবি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায় এবং এই ছবির দুই অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও ইন্দ্রাণী হালদার একসঙ্গে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান। দহন ছবির বিষয়বস্তু কলকাতার রাস্তায় এক মহিলার ধর্ষিত হওয়ার কাহিনি। অপর একটি মেয়ে সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সে এগিয়ে আসে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু সমাজ ও ধর্ষিতার পরিবার পরিজনের ঔদাসিন্যে সে হতাশ হয়।

১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া অসুখ ছবিতে এক অভিনেত্রী ও তাঁর আয়ের উপর অনিচ্ছুকভাবে নির্ভরশীল বাবার সম্পর্ক দেখানো হয়। এটি শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। বাড়িওয়ালি মুক্তি পায় ২০০০ সালে। এই ছবিতে এক নিঃসঙ্গ বিধবা (কিরণ খের) নিজের বাড়িটি এক ফিল্ম প্রোডাকশনকে ভাড়া দেন। তাঁর অবদমিত কামনাবাসনাগুলি ছবির সুদর্শন পরিচালককে নিয়ে কল্পনার ডানা মেলে। এই ছবির জন্য কিরণ খের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পান।

২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত উৎসব শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। এই ছবির বিষয়বস্তু এক একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন। এই পরিবারের সদস্যরা তাদের পারিবারিক বাড়ি থেকে বেশি দূরে না থাকলেও বছরে শুধু একবার দুর্গাপূজার সময় একত্রিত হয়। ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি তিতলি-র গল্প এক অভিনেত্রীর মেয়েকে কেন্দ্র করে। মেয়েটির প্রিয় ফিল্মস্টারের সঙ্গে এক সময় তার মায়ের প্রণয় সম্পর্ক ছিল।

২০০৩ সালে আগাথা ক্রিস্টির দ্য মিরর ক্র্যাকড ফ্রম সাইড টু সাইড অবলম্বনে ঋতুপর্ণ তৈরি করেন একটি "হুডানইট" রহস্য ছবি শুভ মহরত। এই ছবিতে বিশিষ্ট অভিনেত্রী রাখী গুলজার ও শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে অভিনয় করেন নন্দিতা দাস। এই বছরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ঋতুপর্ণ তৈরি করেন চোখের বালি। এই ছবিতেই তিনি প্রথম বলিউড অভিনেত্রী ঐশ্বর্যা রাইকে নিয়ে কাজ করেন।

ঋতুপর্ণ ভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্র:

২০০৪ সালে ঋতুপর্ণের প্রথম হিন্দি ছবি রেনকোট মুক্তি পায়। এই ছবিটি ও. হেনরির ছোটোগল্প "দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই" (১৯০৬) অবলম্বনে নির্মিত। এই ছবিতেও ঐশ্বর্যা রাই অভিনয় করেছিলেন। এই ছবির শ্যুটিং শেষ হয়েছিল ১৭ দিনে। ছবিটি শ্রেষ্ঠ হিন্দি ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।২০০৫ সালে তাঁর বাংলা ছবি অন্তরমহল মুক্তি পায়। এটি ব্রিটিশ আমলের এক জমিদার পরিবারের গল্প। জ্যাকি শ্রফ জমিদার চরিত্রট করেন; আর তাঁর দুই স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন সোহা আলি খান ও রূপা গাঙ্গুলি।

২০০৭ সালে দ্য লাস্ট লিয়ার মুক্তি পায়। এটি একটি প্রাক্তন শেক্সপিয়ারিয়ান থিয়েটার অভিনেতার জীবনের গল্প। অমিতাভ বচ্চন কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন।এছাড়া প্রীতি জিন্টা ও অর্জুন রামপালও এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।

২০০৮ সালে মুক্তি পায় খেলা। এটি মানব সম্পর্কের গল্প। এটি মণীষা কৈরালার প্রথম বাংলা ছবি।এই বছরই মুক্তি পায় তাঁর সব চরিত্র কাল্পনিক। প্রসেনজিৎ ও বিপাশা বসু অভিনীত এই ছবিটি শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।

২০০৯ সালে যিশু সেনগুপ্ত, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, দীপংকর দে ও মমতা শঙ্কর অভিনীত ছবি আবহমান মুক্তি পায়। এটি শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।

মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পরবর্তী ছবি সত্যান্বেষী-র শ্যুটিং শেষ করেছিলেন। এই ছবিটি গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনি অবলম্বনে তৈরি হচ্ছিল।

অভিনয় জীবন:

ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রথম অভিনয় করেন ওড়িয়া ছবি কথা দেইথিল্লি মা কু-তে। হিমাংশু পারিজা পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তি পায় ২০০৩ সালে।২০১১ সালে তিনি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের আরেকটি প্রেমের গল্প এবং সঞ্জয় নাগের মেমরিজ ইন মার্চ ছবিতে অভিনয় করেন। আরেকটি প্রেমের গল্প ছবির বিষয় ছিল সমকামিতা।

ঋতুপর্ণের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি চিত্রাঙ্গদা। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার কাঠামো অবলম্বনে নির্মিত।এটি ৬০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিশেষ জুরি পুরস্কার পায়।

মৃত্যু:
ঋতুপর্ণ ঘোষ দশ বছর ধরে ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিস মেটিলাস টাইপ ২) রোগে এবং পাঁচ বছর ধরে প্যানক্রিটিটিস রোগে ভুগছিলেন। এছাড়াও তাঁর অনিদ্রা রোগ ছিল এবং সেই জন্য তিনি ঘুমের ওষুধ খেতেন। ডাক্তারদের রিপোর্ট অনুযায়ী, অ্যাবডোমিনোপ্ল্যাস্টি ও ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পর প্রয়োজনীয় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করাতে গিয়ে তাঁর শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। আরেকটি প্রেমের গল্প ছবিতে এক সমকামী চিত্রপরিচালকের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য তাঁকে এগুলি করাতে হয়েছিল।

২০১৩ সালের ৩০ মে তাঁর কলকাতার বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যু ঘটে। তাঁর দুই পরিচারক দিলীপ ও বিষ্ণু তাকে বিছানায় অচৈতন্য অবস্থায় দেখতে পান। প্রতিবেশী নীলাঞ্জনা সেনগুপ্ত ডাক্তার নিরূপ রায়কে খবর দেন। তিনি এসে ঋতুপর্ণ ঘোষকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে ঋতুপর্ণের বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৯ বছর।

তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়া


আপনার মন্তব্য

আলোচিত