অপূর্ব শর্মা

২১ নভেম্বর, ২০১৭ ০১:৪৪

কালিকাপ্রসাদ সীমান্তহীন বাঙালিত্বের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ

সাক্ষাৎ-কথায় শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার

বাংলা লোকগানের ইতিহাস দীর্ঘ হলেও পান্থজনের এ সংগীতকে বিশ্বলোকে পৌছে দিতে যারা অনন্য ভূমিকা রেখেছেন তাদের সংখ্যা একেবারেই নগন্য। হেমাঙ্গ বিশ্বাস এবং নির্মলেন্দু চৌধুরীর প্রয়াণের পর দীর্ঘ একটা সময় সেই প্রচেষ্টা বলতে গেলে ঝিমিয়ে পড়েছিল। এপার বাংলা, ওপার বাংলায় যখন ব্যান্ডের দাপট, তখনই ডপকি হাতে তুলে নেন কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য (১৯৭০-২০১৭)। ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরে সাংগীতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া এ শিল্পী-গবেষক বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন গানের দল ‘দোহার’। ১৯৯৯ সালের ৭ আগস্ট যাত্রা শুরু করা ‘দোহার’ খুব কম সময়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দুই বাংলায়।

লোকসংগীতের অসাধারণ পরিবেশনা ও বুদ্ধিভিত্তিক ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণের মাধ্যমে কালিকাপ্রসাদ এতদাঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় আলোড়ন তুলতে সক্ষম হন। মেধা, প্রজ্ঞা, প্রকাশ ও পরিবেশনা দিয়ে বাণী ও সুরের কারুকার্যে ব্যক্তি থেকে তিনি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হন। বিশেষ করে প্রতিটি লোকগানের উৎস, স্রষ্টা এবং পরিপ্রেক্ষিত বর্ননা করে গানকে তিনি আরও উপভোগ্য ও নান্দনিক করে তুলতেন। ২৫ রকম লোক বাদ্যযন্ত্র ও ৩৫ রকমের লোকসংগীত পদ্ধতি তিনি প্রয়োগ করেন দলীয় সংগীতে। তাঁর মত প্যাশন নিয়ে লোকগানকে শ্রুতিমধুর করার গুন বা কৌশল সমকালে ঠিক এভাবে আর কেউ দেখাতে পারেন নি। যা লোকগানকে এক ভিন্ন উচ্চতায় আসীন করে। শুধু লোকগানই নয়, ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতেও ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। লোকগানকে কালিকা কখনও বাণিজ্যের মোড়কে বাঁধেননি। লোকায়ত বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বরাবরই প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর গানে। কালিকার হাত ধরে সংগীতের আঙিনায় পা রেখেছেন অনেকে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অসংখ্য গান ও শিল্পীকে তুলে এনে পরিচর্যা করেছেন তিনি।

লোকসংগীতকে নতুন আঙ্গিকে মানুষের সামনে তুলে ধরার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত থাকা ছিল তাঁর অদম্য নেশা ও প্রত্যয়। পাশাপাশি তিনি লিখেছেন বেশকিছু কালজয়ী গান। সুরও করেছেন গানে। চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনায় রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। নিজেকে একাত্তরের সন্তান পরিচয় দেওয়া কালিকা বাংলাদেশের লোককবিদের গানকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে পালন করেন এক অনন্য ভূমিকা। যার মাধ্যমে বাংলা লোকগান চলে আসে সংগীতের মূল স্রোতধারায়। গত ৭ মার্চ ভারতের সিউরিতে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রয়াত হন বাংলা লোকগানের এই কিংবদন্তি। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তাঁর অকাল প্রয়াণে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয় পান্থজনের, গানের।    
    
কালিকাপ্রসাদের সফল্যের পেছনে যে-কজন মানুষের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো, শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার তাদেরই একজন। প্রখ্যাত এ গণসংগীত শিল্পী কালিকার কালিকা হয়ে ওঠা প্রত্যক্ষ করেছেন কাছ থেকে। দিয়েছেন সঙ্গ। দেখিয়েছেন পথ। বলা যায়, কালিকার গানযাত্রার শুরু থেকে শেষঅবদি তিনি ছিলেন ‘দোসর’ হয়ে। শুভপ্রসাদের ভাষ্য অনুযায়ি, কালিকাপ্রসাদ ছিলেন তাঁর সত্তার অভিভাজ্য অংশ। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন গুনী এই শিল্পী। কালিকা প্রসঙ্গে কথা হয় তাঁর সাথে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় ওঠে আসে শুভপ্রসাদ ও কালিকাপ্রসাদের ব্যক্তিক সম্পর্কের নানা দিক। তারই নির্বাচিত অংশ দিয়ে সাজানো হয়েছে এই সাক্ষাৎকথন।

স্মৃতিময় দিনগুলো

কালিকাপ্রসাদ এবং শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার ছিলেন হরিহর আত্মা! শুভপ্রসাদের ভাষায়, ‘কালিকা ছিলো আমার মনের মানুষ। তাঁর সাথে আমার সম্পর্কটা ছিলো মায়ার! এই সম্পর্কটি ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। আত্মীয়তার চেয়েও বেশি, ঘনিষ্টতার চেয়েও অধিক। ও ‘আমার আপনার চেয়েও আপন’ ছিলো! সে ছিলো আমার সত্তার অভিভাজ্য অংশ।’

তাঁর সাথে কত কত স্মৃতি! আজ যখন ও নেই, সেগুলো স্বভাবতই ভেসে উঠছে মনের মনিকোঠায়। এমন একটা সময় ছিলো, যখন নাওয়া নেই খাওয়া নেই, দিন নেই, রাত নেই একসাথে কাটিয়েছি আমরা অফুরন্ত সময়। শিলচরে প্রচলিত ছিলো, আমাকে যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানেই পাওয়া যাবে কালিকাকে। কিংবা সে যেখানে থাকবে, সেখানে থাকবো আমি! বলার কারণ একটাই, সকল সম্পর্কের উর্ধে ওঠে সে এবং আমি নতুন একটি সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম। যেটা আসলে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ঐযে বললাম না সত্তার অভিভাজ্য অংশ। ঐটাই, ও আমার সব ছিল, সব!
মনে পড়ে, পড়ন্ত দুপুর কিংবা বিকেল-কখনো ওর স্কুটারের পেছনে আমি, কখনো আমার স্কুটারের পেছনে ও। প্রচ- বৃষ্টি হয়েছে, ফুটপাতে বসে চা খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে, কালিকাকে ফোন দিতেই ইচ্ছে আর বাস্তবায়ন না হয়ে যায় কোথায়। চা পর্ব শেষে আবার আড্ডা। এভাবেই কেটেছে আমাদের শিলচরের দিনগুলো।  
 
আমি এমএসসি পাশ করে বর্ধমান থেকে শিলচরে ফিরে আসি- সেও তখন কলেজে পড়ে। সালটা ১৯৮৭ কিংবা ১৯৮৮ হবে। তখন থেকে ধীরে ধীরে আমার দিবারাত্রি সঙ্গী হয়ে গেল সে। শুধু গান বাজনাই না, সাহিত্য রাজনীতিসহ জীবনের নানান দিক নিয়ে আমরা কথা বলতাম, আড্ডা দিতাম। শুধু কালিকা আর আমিই না, আমাদের ১০/১২ জনের একটি গ্রুপ ছিল। গননাট্যের কাজের পাশাপাশি সকলে মিলে হই হুল্লোর দিয়ে কাটাতাম সারাবেলা।  

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার

জীবনের বাকবদল
কর্মসূত্রে আমি চলে আসি কলকাতায়। অন্যদিকে কালিকা জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই শহরে আবাস হলেও জীবনের প্রয়োজন আমাদের মধ্যে অবস্থানগত দুরত্ব তৈরি করে। কিন্তু কখনো মনের দুরত্ব এতটুকু বাড়েনি!

আমি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরিটাকে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে নিলেও কালিকা অনিশ্চয়তা সত্বেও গানকেই বেছে নিল।

শিশুকালে ও যখন বেবিস্যুাট পড়ত আমি তাঁর পিশি আনন্দময়ী ভট্টাচার্য্যরে কাছে গান শিখতে যেতাম। কালিকা তাঁর বাবার হাত ধরে সেখানে আসতো। তার দিদির সাথে একসঙ্গে গান শিখতাম। তাঁর খুব আহ্লাদী চেহারা ছিল। আদর করে কোলে নিতাম, মায়া করতাম। ঐ সময় থেকে তাঁর সাথে আমার একটা মায়ার সম্পর্ক তৈরি হয়। মায়া শব্দের বাংলা কিংবা ইংরেজি কোনও প্রতিশব্দ নেই। ঐ যে- ‘মায়া লাগাইছে দিওয়ানা বানাইছে’- ঐ বয়স থেকেই তাঁর প্রতি যে প্রাণের সম্পর্ক তৈরি হয় সেটা সময়ের সাথে সাথে বদলে যেতে থাকে। ছোট ভাই থেকে বন্ধু, সহকর্মী থেকে সহযোদ্ধা হয়ে যায় কালিকা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, মায়াটাই ‘রই গেল’ গান ধরেন শুভপ্রসাদ, ‘উইরা যায়রে চখুয়ার পঙখি পইরা রইল ছায়া।’ চোখের কোনে জল জমে, অলক্ষে মুছতে মুছতে বলেন, ‘কায়া মায়া সব পইরা রইছে, কালিকা চলে গেছে। আর ফিরিয়া আইতো নায়!

পারিবারিক উত্তরাধিকার
হঠাৎ করে কালিকা সংগীতে আসেনি। পারিবারিক উত্তরাধিকার ছিল তাঁর রক্তে। তাদের বাড়িটা- আমাদের বরাক উপত্যকার ঠাকুর বাড়ি। এখানে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত, মাতৃসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত, নৃত্যচর্চা- গান বাজনা সবই হয়, নানাদিকে তারা পথিকৃৎ। চর্চা, শিখানোÑ ছেলে মেয়েদের মধ্যে গান বাজনার আগ্রহ তৈরি করা- সবই তারা করে থাকেন। ঐ পরিমণ্ডলে যে বড় হয়েছে, সে  কি সংগীতে আবিষ্ট না হয়ে থাকতে পারে? কালিকাও পারেনি।

ছোট্ট বেলায় সে খুব বেশি গান গাইত না। তবে সব বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল। কৈশরে সে তবলা বাজাতো।  তবে, সংগীতের সাথে এমন নিবিড় সম্পর্কের পেছনে তাঁর কাকার ভূমিকা অনেকখানি। লোকসংগীতের প্রতি তাঁর কাকা অনন্ত ভট্টাচার্যের গভীর অনুরাগ ছিলো। তার সংগ্রহে প্রায় ৫ হাজার লোকগান ছিল। লোকসংগীতের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে তিনি ‘লোকবিচিত্রা’ নামে একটি গানের দল গঠন করেছিলেন। অনন্ত ভট্টাচার্যের অকাল প্রয়ানে তাঁর সেই প্রচেষ্টা থমকে দাঁড়ায়। কাকার অকাল প্রয়ানের পর শিলচর থেকে কলকাতায় চলে আসে কালিকা। অনন্ত ভট্টাচার্য যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্নকে স্বার্থক করতে উদ্যোগী হয় সে। তাঁর মনে হল কাকার অপূর্ণ কাজগুলো পূর্ণ করার জন্য গানের দল করা প্রয়োজন। করলও। তার শিক্ষক অভীক মজুমদার দলের নাম দিলেন দোহার। আজও মনে আছে, তার সে কি তীব্র বাসনা, উল্লাস। একটা গান লিখলো- ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা মধ্যে জলধী নদী/নির্বাসিত নদীর বুকে বাংলায় গান বাঁধি’ গানের সুর যখন করলাম, কালিকা বলল, ‘বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদদের সমস্ত অনুষ্ঠানে এই গান আমরা গাইবো। গানটি এতটাই জনপ্রিয় হলো যে, শিলচরে ১৯ মে’র প্রতিটি অনুষ্ঠানেই এখন গীত হয় এটি। তাঁর মৃত্যুর পর শিলচরের মানুষ এই গান গেয়ে কেঁদে কেঁদে মিছিল করেছে।


অনুধাবনে অনন্য
যেকোন কিছু মুহূর্তের মধ্যে বুঝে ফেলার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার? হারমোনিয়ামের কড ধরলে সে বুঝে ফেলত আমি কোন গান গাইব। অথবা আমি মন খারাপ করে বসে আছি, সে আন্দাজ করে ফেলতে পারতো আমার মন খারাপ কেন? বা তুমি আমাকে একটি প্রশ্ন করলে, আমি কি উত্তর দেব সে এটা বলে দিতে পারতো। একবার-একজন সম্পাদক একটি বড় সাক্ষাৎকার ছাপার জন্য আমার সাথে যোগাযোগ করে বলেছিলেন আমার ইন্টারভিউ কে ভালো নিতে পারবে? আমি উত্তরে বলেছিলাম প্রসাদই ভালো পারবে? তবে এটাও সত্যি আমার সঙ্গে দেখা না করেও সে ইন্টারভিউ লিখে ফেলতে পারতো। কারণ আমি কোন প্রশ্নের উত্তরে কি বলব, কি উদাহরণ দেব, কোনটায় আমি কম বলব কোনটা বেশি বলব সে সব জানতো। সে আমার সব জানতো।

আমি কোন গান গাওয়ার আগে কোন কথা বলি, কোন গানের মাঝখানের আগে ভাঙি। ভেঙে একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করতে পারি, কোন জায়গার গানটা আমার মধ্যে দারুণভাবে ছুয়ে যায়। তাঁর মতো করে আর কেউ বুঝতো না। দু’জনের সম্পর্কটাকে একটা ম্যাজিকের সম্পর্ক বলতে পার। দুটি আত্মার মধ্যে ম্যাজিক। মায়ার সম্পর্ক, মায়ার বন্ধন। সত্যি কথা বলতে কি আগে এত হিসাব-নিকাশ করতাম না। এখন সে নেই, সবাই এটা সেটা জিজ্ঞেস করে, আর আমি ভাবি। মাঝে মাঝে মনে হয়, সে দূর থেকে সবই বোধহয় দেখছে। আর হাসছে। বলছে, এবার বুঝ ঠেলা! আমিতো তোমার সব বুঝি, দেখি তুমি আমায় কতটা বুঝতে পেরেছ? গানের মতোই বোধহয় সে ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশের মেঘের ভেলায়!  


ফিরে আসবে বারে বারে
তাঁর স্বপ্নের পরিধি ছিল বিশাল। বলতো, আরও অনেক কিছু করার আছে। সে একটা চ্যানেল করতে চেয়েছিল; চব্বিশ ঘণ্টার চ্যানেল, যেটি হবে ওয়েব বেইজড, শুধুমাত্র ফোক নিয়ে। নাম দিয়েছিল দোহার ফোক স্টেশন। বলতো, জিটিভিতে সপ্তাহে দুঘণ্টার ফোক দিয়ে হবেনা, পৃথিবীর যেকোনও প্রান্থ থেকে আমাদের ফোক যেন চব্বিশ ঘন্টা শুনতে পারে মানুষ সেই ব্যবস্থাই করতে হবে। কাজও শুরু করেছিল। এই চ্যানেলের জন্য পার্বতী বাউলের গান রেকর্ডিং করেছিল, সাতই মার্চ সকালে শিউরিতে এক সাপুরিয়ার বাদ্যকারের রেকর্ডিং করতে গিয়ে সে মারা গেল। চলে গেল না ফেরার দেশে। তবে একটা ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত ভাগ্নে সৌম্য রাজিবসহ তার দলের সদস্যরা তাঁর সকল অপূর্ণ স্বপ্নগুলোকে পূরণ করবে। তাদের কিন্তু সে ক্ষমতা আছে। দোহারের মধ্যে তাঁর উত্তরাধিকার সে তৈরি করে গেছে। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন, সব সময় নতুন মানুষ দিয়ে করতে হয়। পুরনো মানুষকে ফিরিয়ে এনে ভালো কিছু হয় না। প্রসাদের প্রয়াণের পর দোহারে সবাই মিলে প্রসাদ হয়ে গেছে।

একটা উদাহরণ দিই, শহরে জ্বল জ্বল করে যে বিদ্যুতের আলো জ্বলে, সেই বিদ্যুতের পাওয়ার স্টেশন কিন্তু শহরে থাকে না। অনেক দূরে থাকে। সেটাকে শহরের মাঝখানে বসানোর প্রয়োজন নেই। তাকে দূরে বসালেও চলে। দেখা যায় না; আমিও তেমন। দোহারের সাথে ছিলাম, আছি, থাকবো সেই পাওয়ার স্টেশনের মত।

মৃত্যু শুধু দেহের পরিসমাপ্তি ঘটায়। চেতনা বিনাশ করতে পারেনা। প্রখ্যাত শিল্পী সাবদার যখন মারা যান তখন তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনিতো সব হারালেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন সাবদার নেই কিন্তু সাবদার তার রাস্তাটা রেখে গেছেÑ ঐ রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে সাবদারকে খুঁজে পাবো। প্রসাদ নেই। প্রসাদের প্রচুর স্বপ্ন ছিল, একটা রাস্তা ছিল, সে যে রাস্তা দিয়ে হাটতো সংস্কৃতির ঐ রাস্তাটা কিন্তু রয়েছেÑ কারণ স্বপ্নেরতো মৃত্যু নেই। ঐ রাস্তা ধরে হাটলে তাঁর স্বপ্নের পথে হাটলে সে বারে বারে জীবিত হবে, বারে বারে ফিরে আসবে আমাদের মাঝে।


স্বপ্নের সহযাত্রী
সে ছিল আমার স্বপ্নের সহযাত্রী। বাম হাত যেমন অনেক কাজ করতে পারে না। সে, ভাবে ডান হাত করবে। মনে অনেক কিছু থাকে, মুখ অনেক কিছু পারে না। মন স্বপ্ন দেখে, মুখ একদিন তার সব কথা বলবে। বাম হাত আর ডান হাতের যে সম্পর্ক, মন আর মুখের যে সম্পর্ক, তার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল ঠিক তেমনই।

আমার জীবনের সমস্ত অপূর্ণতার পূর্ণতা আমি তার মধ্যে দেখতাম। আমরাতো অভিন্ন স্বপ্নের শরীক ছিলাম, সমস্ত দিক দিয়ে। আমি ভাবতাম যে, আমি জীবনে যা যা পারিনি তা সে পূরণ করবে।

আমাদের লোকসংস্কৃতিকে একটা সম্মানের জায়গায় নিয়ে যাওয়া, আজ নাগরিক মানুষকে কুর্নিশ করে কথা বলতে হয়, একজন কুমার সানু, শান্তনু মৌত্র সারাদিন বসে থাকেন একজন মনসুর ফকির একজন তুলিকার গান শোনার জন্য। একজন তীর্থের গান শোনার জন্য। এই যে সম্মানটা তাদের কাছ থেকে আদায় করা, তারা দিতে বাধ্য হয়েছে এটা কিন্তু কালিকার সুবাদেই হয়েছে।

সত্তরের দশকে একদল যুবক স্বপ্ন দেখেছিলেন গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার রাজনীতির। সে স্বপ্ন ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কালিকা গান দিয়ে শহর ঘেরার সংস্কৃতির লড়াইয়ে সফল হয়েছে। পান্থজনের সংস্কৃতির কাছে নতমস্ত হয়েছে অভিজাত সমাজ! জিটিভির মত একটা চ্যানের বাংলা লোকসংস্কৃতি মানে লোকসংস্কৃতির গেরিলা যোদ্ধাদের নিয়ে সে ঘেরাও করতে সক্ষম হয়েছে। এটা ভেবে বিস্মিত না হয়ে পাড়া যায়না, জিটিভির প্রোগামে সে কিন্তু বিচারক ছিলনা, আবার প্রতিদ্বন্দিও না। সে যোগসূত্র স্থাপন করে দিত, প্রতিটি গানের আগে বা পড়ে মিনিট দুয়েকের উপস্থিতি থাকতো তাঁর। কিন্তু সব আলো সে-ই কেড়ে নিত। তাকে ঘিরেই আবর্তিত হতো বিশাল এই আয়োজন।
সে নিজেকে নিজেই রাজ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। এটা ভেবেও আমার আনন্দ হতো, গর্ব হতো।

এটা নির্দিধায় বলতে পারি, কালিকার মধ্যে এসে বাঙালির সব কাটাতার বিলীন হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ তাঁকে নিজের মনে করে, পশ্চিম বাংলাও তাঁকে নিজের মনে করে; বরাক ভ্যালীতো তার নিজেরই। কালিকার মধ্যে এপার, ওপার বলে কিছু নেই। সব বিলীন। আমরা সীমান্তহীন বাঙালীত্বের যে স্বপ্ন দেখি সে ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।
কলকাতা শহরে শাহ আবদুল করিমের নাম কেউ নিত না; আরকুম শাহ, শীতালং শাহকে বড় করে দেখা, ১৯ শে মের কথা, ২১ ফেব্রুয়ারির কথা কলকাতায় সেই বলেছে। আমরা সবসময়, সকল কাটাতারকে অবিশ্বাস করি। সে বলতো, তোমার গীটারটা আমার কেন হবে না? বাংলাদেশে অপূর্ব তুমি কেন আমার আপন ভাই হবে না। সমস্ত ধরনের কাটাতার, জাত ধর্ম ভাষা রাষ্ট্র প্রজন্ম যত ধরনের যত কাটা তার আছে সবকিছুকে অস্বীকার করার স্বপ্ন দেখতাম আমরা।  

গত চার-পাঁচ বছর সে প্রচ- ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। দিনরাত দেখা হয় না। তবে নিয়মিতই ফোনে কথা হত। মাঝে মধ্যে যদি তাঁর সাথে পাঁচ মিনিটও দেখা হত সে সব উগরে দিতে চাইত, আমিও উগরে দিতে চাইতাম সব। কত কত কথা, স্বপ্নের কথা, অপূর্ণতার কথা, দীর্ঘশ্বাসের কথা, উচ্ছাসের কথা? এখন আর কেউ বলেনা? তাঁর ছবির দিকে চেয়ে থাকি? জিজ্ঞেস করেনা জিবাংলার ঐ অনুষ্ঠানটা কেমন হলো শুভ দা?


ঘামে শুরু বাতিঘরে শেষ
কালিকা অনেকদিক থেকেই অনন্য। আমরা প্রথিতযশা শিল্পীদের গলায় লোকগান শুনছি অনেকদিন ধরেই। কিন্তু ওর আগে কী কোন শিল্পী আমাদের জানিয়েছেন তার গাওয়া গান তিনি কোন গ্রামীণ লোকশিল্পীর কাছ থেকে শিখেছেন? আমরা এখন জিটিভির অনুষ্ঠানের কথাই শুধু ভাবি। কিন্তু দোহারের প্রথম দিন থেকেই কালিকা প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে কোনো না কোনো লোকশিল্পীকে মঞ্চে হাজির করেছে। এভাবেই কলকাতা শহরের মঞ্চে কখনো সনাতন দাস বাউল, কখনো কালাচাঁদ দরবেশ, কখনো মনসুর ফকির, কখনো তুলিকা গঙ্গাধরদের হাজির করেছে ও। আরেকটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ কারণে কালিকা অনন্য। সেটা হচ্ছে তার জীবনপথের ব্যাপ্তি। ওর ছোটকাকা যিনি  লোকগানের এক অগ্রণী শিল্পী ও ভা-ারী ছিলেন, তিনি প্রথম জীবনে অত্যন্ত সৌখিন মানুষ ছিলেন। তাঁর জামাকাপড় তৈরি হতো তখনকার বম্বের দর্জিদের ঘরে। ড্রাইক্লিনও হতো বম্বের ড্রাই ক্লিনারে। প্রত্যন্ত শিলচর  থেকে তিনি এভাবে কাপড়জামা জুতো বম্বে থেকে আনাতেন। হঠাৎ করে তুরফান আলি নামে পেশায় রিক্সাচালক এক লোকশিল্পীর সংস্পর্শে এসে তাঁর জীবন সম্পূর্ণ বদলে যায়। সৌখিন দামি জামা কাপড় ছেড়ে তিনি গায়ে তুললেন সাদা কুর্তা পাজামা। তুরফানকে সঙ্গী করে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন গ্রামে গ্রামে মাজারে মাজারে আখড়ায় আখড়ায়। সংগ্রহ করলেন কয়েক হাজার গান। কালিকা ছোটবেলায় তুরফান আলিকে ভীষণ ভালোবাসত। সারাদিন ঘেমে নেয়ে আসা তুরফানের কোলে চড়ে সে তার ঘাম চাটতো। রক্ষণশীল বাড়ির লোকেরা কিছু বললে ও উত্তরে বলত, ‘না গো, তুরফান ভীষণ ব্রাহ্মণ।’ আমার কাছে ব্যাপারটা খুবই প্রতীকী। কালিকা বড়ো হয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে মাস্টার্স পড়তে যায়। সেখানে শিক্ষক হিসেবে পায় এই সময়ের এক বিশিষ্ট চিন্তক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ভীষণ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে তাঁর। পায় অধ্যাপক অভীক মজুমদারকে। ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয় শঙ্খ ঘোষ মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়দের সাথে। এঁরা ওর ভাবনাবিশ্বে ঝড়ের হাওয়া বইয়ে দেন। আমার কাছে কালিকা এখানেই অনন্য। এই সময়ে আর কে আছে যার জীবনের পথচলা রিক্সাওয়ালা তুরফান আলির ঘামচাটা থেকে শুরু হয়ে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ে শেষ হয়েছে। এই ব্যাপ্ত পথচলা আর কারো নেই। কালিকা সারাজীবন নানা মানুষকে পেয়েছে সমাজের নানা স্তর থেকে যারা তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। স্কুলে পড়ার সময় ওর গৃহশিক্ষক ছিল বরাক উপত্যকার বিশিষ্ট কবি বিজয় ভট্টাচার্য। আমাদের বন্ধু বিজয়কে আমাদের উনিশের চেতনার এক স্পন্দমান কবি বলা যায়। কালিকাকে স্কুলে পড়ার সময় বাংলা পড়িয়েছে বিজয়। তাকে কবিতায় আগ্রহী করেছে। কালিকার হাতের লেখাটাও বিজয়ের মত অনেকটা। আর যদি অনুপ্রেণার কথা বলতে হয়, সেটা শুধু আমিই ছিলাম না, সুমন দা (কবির সুমন), শুভেন্দু দা (শুভেন্দু মাইতি) তাদের অনুষ্ঠানের প্রভাবও আমাদের ওপর পড়েছিল।


আমি তোমারই তোমারই নাম গাই...
প্রসাদ সারা জীবন যা করেছে, সব যদি মুছে যায়, সব গান সব লেখা যদি হারিয়ে যায় শুধু ‘আমি তোমারই নাম গাই’ গানটা যদি বাঁচে, প্রসাদ অমর হয়ে থাকবে বাঙালির হৃদয়ে। এই গানটি তাঁর জীবনের সেরা সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ সহজের সাধনা করতেন, এ সহজ মানে তরল নয়। কঠিন পেরিয়ে বাউলরা পায়, ফকিররা পায়। কঠিনকে অতিক্রম করে একটা সহজ। ঠিক সেইরকম একটা সহজের সন্ধান পেলো কালিকা। লিখলো, তোমারই নাম গাই। প্রসাদের এই গানটি অবিস্মরণীয় যেসব বাংলা গান আছে, যেমন-‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’, ‘আগুনের পরশমনি’, ‘অমরত্বের প্রত্যাশা নেই’, কিংবা ‘আমার ভিতরও বাহিরে অন্তরে অন্তরে’র পাশাপাশি স্থান করে নিয়েছে কালের ক্যানভাসে।

লোকে গান গায়, ছবি আঁকে। নাম গাইতে শুনেছেন কখনও? কিন্তু প্রেম, প্রতিবাদ, পূজা একাকার হয়ে গেল তাঁর গানে। এটা নিছক একটা গানই নয়, বাঙালির ঐতিহ্যকেও এই গানের মাধ্যমে ধরে রেখেছে সে। চল্লিশের দশকেও সংযুক্ত করেছে। আবার বর্তমানকেও তুলে ধরেছে।  

কালিকা মারা যাবার পর কে একজন লিখেছে, আমি ওর গুরু ছিলাম; না গুরু ছিলাম না, আমরা দুইজনে দোসর ছিলাম। ধ্বনি প্রতিধ্বনির সম্পর্ক ছিল আমাদের। কিন্তু ওর মৃত্যু দোসর থেকে ওকে আমার গুরুর আসনে বসিয়ে দিয়েছে। এখন ও আমার গুরু বা মুর্শিদ। বাউলদের যেমন মুরিদ হয়, শিষ্য হয়। গুরু যেমন বীজ মন্ত্র দেন, আমার জন্যও বীজ মন্ত্র রেখে গেছে সে। যখন একা থাকব, অসহায় লাগবে আমি ওর বীজ মন্ত্র গাইবো। সেই বীজমন্ত্রটি আর কিছু নয়, ‘আমি তোমারই তোমারই নাম গাই।’

কালিকা নেই, কালিকা আছে?
এক ঝটকায় আমার পৃথিবীটা বদলে গেছে। একদিকে একটা সর্বগ্রাসী শূন্যতা, ভর দেওয়ার অবলম্বন হারিয়ে যাওয়ার বেদনাবোধ। অন্যদিকে, প্রতিটা মুহূর্তকে জবরদখল করে ভরিয়ে রাখা তাঁর সীমাহীন স্মৃতি। এতকাল আমার অহংকার ছিল, বিধাতা আমাকে একটি বিশেষ সংলাপের মালিকানা দেন নি। ‘কাল রাতে একদম ঘুম হল না’। কিন্তু ৭ মার্চ সেই অহংকারটি কেড়ে নিয়েছে। ঘড়ি রাত তিনটের কাছাকাছি এলে আপনাআপনি ঘুম ভেঙে যায়। কী যেন নেই জীবনে! কে যেন আর কখনো ফিরবে না! বুঝতে পারি সে আর কেউ নয়, কালিকা।  

একদা সে আমার অনুজ ছিল, বয়সে, চিন্তায়, ভাবনায়। তারপর একদিন সহ-পথিক হল। এগিয়ে গেল। ভাবনায়, কাজে, স্বপ্নে অগ্রজ হয়ে উঠল আমার। গত ৭ মার্চ তাকে উন্নীত করেছে আমার গুরুর আসনে। ঘুমে জাগরণে সে আমাকে ভাবায় কাঁদায় পথ দেখায়। আমার একাকীত্বের প্রহরগুলি কাটে তাঁর সঙ্গ পেয়ে। এই সঙ্গ-নিঃসঙ্গতা আমি কাটিয়ে উঠতে চাই না। এটাই আমার সর্বস্ব, এটা হারালে আমি জ্বালানিহীন যানের মত অর্থহীন হয়ে পড়ব! আমি জানি সে আছে, থাকবে অনুভবে, আমার হিয়ার মাঝে কিংবা হৃদমাঝারে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত