শাকিলা ববি

০৫ মে, ২০১৮ ২৩:৩৩

একজন চারু বাউল শাহ্‌ আলম

চারু বাউল শাহ্‌ আলম। আজ তার ৪৫তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৭৩ সালের ৫ মে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট জন্ম নেওয়া এই শিল্পীর হাত ধরেই সিলেটের সংস্কৃতি অঙ্গনে এসেছিল লক্ষণীয় পরিবর্তন। শুধু সাংস্কৃতিক অঙ্গন নয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্য, অনুষ্ঠানে শাহ্‌ আলম ছিল একটি প্রয়োজনীয় নাম। চারু শিল্পের প্রতি তার সাধনা নিষ্ঠা দেখে তার নামের পাশে চারুবাউল যুক্ত করেন সিলেটের শিল্প প্রেমীরা।

নব্বইয়ের দশকে চারু বাউল শাহ্‌ আলমের একক প্রচেষ্টায় সৃজনশীলতার হাওয়া লাগে সিলেটের সংস্কৃতি অঙ্গন। ওই সময়কালীন, সিলেটে অনুষ্ঠিত নাটকের মঞ্চ ডিজাইন, বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন, পত্রিকার লোগো, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, অফিস ডিজাইন সব কিছু একাই রঙ্গিন করে তুলেছিলেন শাহ্‌ আলম। বিশেষ করে সিলেটের পহেলা বৈশাখের রং আসে তার হাত ধরে। সিলেট বৈশাখের শোভাযাত্রায় মুখোশের প্রচলনটাও তার মাধ্যমে আসে। সিলেটের শিল্প সংস্কৃতিতে শাহ্‌ আলম তার কর্মের চেয়েও বেশি বিস্তৃত ছিলেন তার সৃষ্টিশীল চিন্তা দিয়ে।মোট কথা তার চিন্তা আর অংশগ্রহণে মুখরিত হত সিলেটের প্রায় সব আয়োজন।

‘বসন্ত আনন্দ উৎসব’ নামে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনিই প্রথম সিলেটে বসন্ত উৎসব উদযাপনের সূচনা করেন। পহেলা বৈশাখ, বসন্ত বরণ, রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, নাট্য উৎসব কিংবা চিত্র প্রদর্শনী সব কিছুতেই তার রংয়ের শ্রোতধারা মিশে গিয়েছিল। সিলেটের সকল নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে ছিল তার বিচরণ।

ক্ষণজন্মা এই চারু বাউলের পৈতৃক নিবাস হবিগঞ্জের সুলতানসী গ্রামে। বাবা কাঞ্চন মিয়া সেনাবাহিনীতে চাকুরী করতেন। সেই সুবাদে ১৯৭৩ সালের ৫ মে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট জন্ম হয় তার। ৬ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৫ম। বাবা সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর শৈশবের কয়েক বছর হবিগঞ্জে কাটান শাহ্‌ আলম। এর পর ১৯৮০ সালে সিলেটের ইসলামপুরে টেক্সটাইল মিলে তার বাবা চাকুরী হলে তারা সপরিবারে চলে আসেন সিলেটে। ইসলামপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, শাহপরান উচ্চ বিদ্যালয় ও সিলেট সরকারী কলেজে পড়াশোনা করেন।

শাহ্‌ আলম ছোট বেলা থেকেই ছিলেন সৃষ্টিশীল। চারু শিল্পের প্রতি ছিল অন্যরকম আবেগ।

শাহ্‌ আলমের ছোট ভাই শাহিন আহমেদ বলেন, ‘আমি আলম ভাইয়ের ছোট হলেও সে আমার কাছে ছিল বন্ধুর মত। ছোট বেলা থেকেই তার ধ্যান জ্ঞান ছিল এই চারুশিল্পের প্রতি। প্রাইমারি স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার সময় যখন মাটির কাজ দেয়া হত তখন আমি অন্যদের সাহায্য নিয়ে মাটির জিনিস তৈরি করতাম কিন্তু ভাইয়া নিজে মাটি দিয়ে গরু, আম, হাতি তৈরি করে স্কুলে জমা দিত। আমার যখন টেবিলে পড়তে বসতাম তখন আমি জোরে জোরে শব্দ করে পড়তাম আর সে শব্দ ছাড়া পড়ত। পড়ার টেবিলে বইয়ের নিছে সবসময় খাতা রাখত আলম ভাই। পড়ার সময়ও কিছুনা কিছু আঁকা আঁকি করতো ভাইয়া। যখনই মা আসতো তখন আঁকা বন্ধ করে খাতা বইয়ের নিছে দিয়ে বইয়ের দিকে চোখ। মা চলে গেল আবার তার আঁকাআঁকি শুরু।’

চারু বাউল শাহ্‌ আলমের হাতের লিখা ছিল অনেক সুন্দর। তাই তিনি যখন হাইস্কুলে পড়তেন তখন থেকেই দেয়াল লিখন, বিভিন্ন দোকানের সাইন বোর্ড লিখতেন। এই কাজেই তিনি আনন্দ পেতেন তাই কেউ এসে লিখার কথা বললে তিনি না করতেন না। এক পর্যায়ে দেখা গেল তার এলাকার বেশিরভাগ সাইন বোর্ডই তিনি আর্ট করে ফেলেছেন। সব দোকানের সাইনবোর্ডের নিচে লিখা ‘শাহ্‌ আলম আর্ট’। এতে তার কাজের প্রচারণা বেড়ে যায়। তাই নির্বাচন আসলেই ব্যানার, পোস্টার লিখার জন্য লম্বা লিস্ট থাকতো তার।

ভাই শাহিন আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচন আসলেই অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়তো ভাই। বাসার ছাদে ফ্রেম করে ব্যানার লিখত। তখন সিলেটে আর্টের তুলি পাওয়া যেত না। তুলি না পেয়ে সে গরু, ছাগলের লেজ থেকে চুল এনে তুলি তৈরি করে কাজ করতো। ’

এই ধরনের কাজ করতে করতে এক সময় শাহ্‌ আলমের মনে হয় চারুকলা বিষয়ে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দরকার। তাই উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ১৯৯৪ সালে সিলেট শিল্পকলা একাডেমীতে চারুকলা বিভাগে ভর্তি হন শাহ্‌ আলম। ১৯৯৭ সালে শিল্পকলা একাডেমীতে চারুকলা বিভাগে ফাস্ট ক্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

শাহ্‌ আলম ২০০০ সালে সিলেট শিল্পকলা একাডেমীতে চারুকলার শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেন। ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এফআইবিডিবিতে চাকুরী করেন। বিটিভির ছোটদের মেধা অন্বেষণ অনুষ্ঠান ‘নতুন কুড়ি’ তে ২ বছর জাজমেন্ট করেন শাহ্‌ আলম। ২০০২ সালে চারুকলি নামে একটি আর্ট স্কুল শুরু করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকেন তিনি।

শাহ্‌ আলম তার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য আর যৌবন সেরা সময় গুলো পাড় করেছেন সিলেটে। তার প্রাণ ছিল সিলেটে। এই শহর, শহরের মানুষকে তিনি অনেক ভালবাসতেন। তাই ঢাকা গিয়ে কাজ করা অনেক ভাল সুযোগ আসলেও সবসময়ই তিনি তা প্রত্যাখ্যান করতেন। তিনি বলতেন ‘ সিলেটে তার প্রাণ আটকে আছে। ঢাকা গেলে নাকি তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।  

সিলেট সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক রজত কান্তি গুপ্ত বলেন, শাহ্‌ আলমের মধ্যে যে গুণাবলী ছিল তা সাধারণ না। সে অল্প বয়সে চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। সিলেটর সংস্কৃতি অঙ্গনে সে যে কাজ করে গেছে এখন পর্যন্ত এই লেভেলের কাজ কেউ করতে পারেনি।


চারু বাউল শাহ্‌ আলম স্মৃতি সিলেটে ধরে রাখতে তার কয়েকজন ছাত্র মিলে ‘শাহ্‌ আলম গ্যালারি অব ফাইন আর্টস’ নামে একটি গ্যালারী প্রতিষ্ঠা করেন। এই গ্যালারীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইসমাইল গনি হিমন বলেন, ‘ তিনি ছিলেন সিলেটের রত্ন। তার মাধ্যমেই সিলেটে তৈরি হয়েছিল একঝাঁক চারু কর্মী। সিলেটে চারুশিল্পের বিপ্লব তার হাত ধরেই হয়েছে। তার স্মৃতি ধরে রাখতে এবং নতুন প্রজন্ম যেন তার অবদান ভুলে না যায় সেজন্য আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আমরা চাই নতুন প্রজন্ম তাকে মনে রাখবে এবং তার দক্ষতা, মেধা, সৃজনশীলতা তাদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।’

শাহ্‌ আলমের শিক্ষক প্রবীণ চিত্র শিল্পী অরবিন্দ দাশ গুপ্ত বলেন, শাহ্‌ আলম একজন আপাদমস্তক শিল্পী ছিল। সে কত বড় মাপের শিল্পী ছিল সেটা বলার সময় দেয়নি সে। এর আগেই সে চলে গেছে। সে তার নিজের চেষ্টায় ছবির জগতে বিচরণ করেছে। এ বিষয়ে তার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ছিল না। চারুকলা বিষয়ে আমার কাছেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। চারুশিল্পে ডিগ্রী নেয়া শিল্পীরা যে ধরনের কাজ করে তার চেয়ে ভাল মানের কাজ করতো সে। তার কাজে ছিল বিশ্ব মানের ছোঁয়া আছে।

৩৩ বছর বয়সে হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে ২০০৬ সালের ২৯ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই চারু বাউল।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত