সজল ছত্রী

০৭ মার্চ, ২০১৯ ১৪:৪৪

মঞ্চে হাসন রাজা, দর্শকসারিতে ভাবনা

সিলেটে মঞ্চনাটকে হলভরা দর্শক দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়। সিলেট সম্মিলিত নাট্য পরিষদ আয়োজিত নাট্য প্রদর্শনীর দশম দিন বলা চলে হাউজফুল!

অপেক্ষার ক্ষণ শেষে সাতটার কিছু পরে মঞ্চ আলো করে হাজির হলেন দেওয়ান হাসন রাজা। সিলেটের মরমিসাধক এই জমিদারকে নতুন করে দর্শকদের সামনে নিয়ে এসেছে নান্দিক নাট্যদল।

মোস্তাক আহমেদের রচনায় আর আমিরুল ইসলাম বাবুর নির্দেশনায় এক ঝাঁক প্রাণোচ্ছল নাট্যকর্মী তাদের সর্বোচ্চটুকু দেবার চেষ্টা করেছেন নতুন আলোকে হাসন রাজাকে দেখার সুযোগ করে দিতে। কিন্তু কোথায় যেন তালটা ঠিক থাকেনি।

আলোক প্রক্ষেপণ মাঝে মাঝেই টাইমিং মিস করে গেছে, রিহার্সেলের অভাবে কিনা কে জানে চরিত্ররাও সময়মতো আলোর নিচের এসে দাঁড়াতে ভুলে গেছেন। এই বিচ্যুতি দর্শকের মনঃসংযোগে চিড় ধরিয়েছে বারবার। আর আঞ্চলিক ভাষা দিয়ে নাটকের নতুন ব্যঞ্জনা আনতে গিয়েও হোঁচট খেতে হয়েছে।

সিলেটি ভাষায় ‘আইতাসি, যাইতাসি’ শুনলে অনুমান করা যায় নাটকটি তৈরি বা মঞ্চে নিয়ে আসার আগে যত্নের যথেষ্ট অভাব ছিল। অচর্চিত বা ইতিহাসের আড়ালে পড়ে থাকা কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে এই বিচ্যুতি হলে মেনে নেয়া যায়।

চিত্রনাট্য তৈরির আগে এই সতর্কতা প্রয়োজন ছিল যে: হাসন রাজা সিলেটের আলোচিত মহানায়কদের অন্যতম। তাকে নিয়ে প্রায় সব মানুষই অল্প-বেশি জানেন।

যেনতেনভাবে তাকে মঞ্চে উপস্থাপন গ্রহণযোগ্য নয়। দর্শক অবশ্যই নতুন কিছু দেখতে চান, নতুন আরশি দিয়ে দেখতে চান, কিন্তু সেটা সত্যের মধ্যে থেকে, নতুন চিন্তার ভেতর দিয়ে। সত্য ও ভাবনা, বাস্তব ও ভাববাদের মিশ্রণ তৈরি করা সহজ কথা নয়।

নিরেট উপস্থাপন, ছন্নছাড়া সংলাপ এবং অভিজ্ঞ নির্দেশনার পরও মঞ্চ কাঁপিয়ে দেওয়ান হাসন রাজার বুকফাটা আকুতির বার বার দৃশ্যায়ন দর্শককে মোহিত না করে কিছুটা হলেও বিব্রত করেছে। দেওয়ান হাসন রাজা যে স্বরূপের মহীরুহ সেখানে তাকে একবার কাঁদালে দর্শকের ভেতর সেই কান্না মায়া হয়ে প্রবেশ করত।

নাটক শেষ হলেও সেই কান্না দর্শকের আপন কান্না হয়ে থেকে যেত মনের গহীনে। কিন্তু মঞ্চে হাসনের কান্না দেখে মনে হয়েছে তিনি ছিঁচকাঁদুনে, নাটুকেপ্রেমিক। বারবার হাউমাউ করে কাঁদতে গিয়ে হাসন রাজার চরিত্ররূপায়নকারী মেধাবী নাট্যকর্মী মাধব কর্মকারকেও মনে হয়েছে ক্লান্ত।

তবু সুরপাগল দেওয়ান হাসন সুরসাধক হবার আগেই কেটে গেছে নাটকের একটি ঘণ্টা। দর্শক অপেক্ষা করেছেন এই বুঝি হাসন রাজা বলবেন: 'বালা খরি গর বানাইয়া খয়দিন থাখমু আর!' কিন্তু না, নাটক শেষ হয়েছে : কানাই তুমি খেইড় খেলাও কেনে? এই প্রশ্নেই।

‘হাসন রাজা’ দেখতে এসে দর্শক হাসন রাজাকে পাননি। পেয়েছেন সুন্দরী বিধর্মী বিধবা রমণীর প্রেমে আর গানে পাগল এক জমিদারের দেখা। যার নিজের সুর পাগলামির কোনো নজিরই নাটকে নেই। এমনকি আরেক মরমি সাধক রাধারমণের ভক্ত বলে মঞ্চে আবির্ভূত সেই সুকণ্ঠি সুন্দরি বিধবা ‘চন্দ্রা’র মুগ্ধকর গায়কীরও কোনো উপস্থাপন নেই। তাকে শুধু কান্না আর প্রেমাভিনয়ের জন্যই মঞ্চে নিয়ে আসা হল কেন জানি না।

চন্দ্রাকে কেন্দ্র করেই এই নাটক হতে পারত। কিন্তু একটা সময় এসে নাট্যকার চন্দ্রাকে ভুলে গেছেন। সব মিলিয়ে না চন্দ্রা চিত্রিত হয়েছেন, না হাসন রাজা। সুরের কোনো আয়োজন নেই, তবু মঞ্চে সুরসঙ্গী নারী হতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন অদিতি দাস। অভিনয় দক্ষতা দিয়েই তিনি চন্দ্রার প্রতি দর্শককে বিরূপ হতে দেননি। তা না হলে নায়েব চরিত্রে রূপদানকারী সত্যজিত দত্ত চৌধুরী গৌতমের মুখ দিয়ে যে সংলাপ নিঃসৃত হচ্ছিল তাতে ইজ্জত যেত রাধারমণেরও।

অভিনয়ে কেউ কম যাননি। গৌতম যেমন টেনে নিয়েছেন অনেকখানি তেমনি হুরমত জাহান বিবি চরিত্রে শর্মিলা দেব এবং আজিজা বানুর চরিত্রে পরাগরেনু দেব তমা নিজেদের পক্ষ থেকে কোনো ত্রুটি রাখেননি।

শুধু প্রধান চরিত্রগুলোই নয়, নান্দিকের পুরো দলই মনে হয়েছে আপ্রাণ খেটেছেন; গানে, কণ্ঠে ভালো, কিন্তু সুরটা কেটেছে অন্য কোথাও!

সব মিলিয়ে হাসন রাজায় হাসন রাজাকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে একজন কামাসক্ত জেদি জমিদারকে, যিনি নৈতিকতা বা প্রচলিত প্রথার ধার ধারেন না। ক্ষেত্র বিশেষে মনে হয়েছে এই জমিদার কিছুটা বিকৃতকামীও। নারীসঙ্গ পিপাসা বা একের পর এক বিয়ে ঐতিহাসিকভাবে মেনে নেওয়া গেলেও কোনটিতেই বাতুলতা ছাড়া প্রেমের কোনো লক্ষণ না থাকা; বাঈজিলোভ থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত নদীর ঘাটে গান শুনে বিধর্মী বিধবা চন্দ্রাকে তুলে এনে গানের আসরের নামে প্রেমরক্ষিতা করে রাখা কোনো কিছুতেই ভাবুক হাসন রাজা উপস্থিত হননি।

এবং সেই প্রচলিত ‘মিথ’ প্রেমিকাকে ভুলতে হাসনের বাঈজিলিপ্সা এবং বাঈজিরূপে স্বয়ং হাসনজননী হাজির হওয়াতেও নতুনত্ব কিছু নেই। এই মিথের কোনো প্রমাণিত সত্য নেই। হাসন রাজার উত্তরাধিকারীদের পক্ষ থেকেও নাকি এ নিয়ে প্রতিবাদ আছে। কেননা হাসনের মা হুরমত জাহান বিবি বয়স চল্লিশে জন্ম দেন হাসনের। হাসনের পরিণত বয়সে হাসনজননীর বাঈজি সেজে আসার ঘটনা এই ক্ষেত্রে কিছুটা খটকা লাগায়।

সর্বোপরি ‘হাসন রাজা’য় যদি হাসন রাজাকে না পাওয়া যায়, এক ঘণ্টার নাটক দেখে আমার মনে হয়েছে, হলো না। আরেকটু খাটতে হবে। রামকে ফেলে রাবণকে নায়ক করতে হলেও একটা মেঘনাদবধ কাব্য লাগে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত