মোছাদ্দিক উজ্জ্বল

২১ আগস্ট, ২০১৫ ০২:০৩

নীরবে-নিভৃতে চলে যাওয়া প্রচার বিমুখ এক কবিয়াল বিজয় সরকার

“এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে। সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে”

জন্ম নিলে চলে যেতে হয় বুঝি! এমন নির্মম সত্য জেনেও আমরা আগামীর পথে হাঁটি, কারণ চলতে হয়। এটাই বোধহয় জীবনের নিয়ম। জীবন তো ছুটে চলে বহতা নদীর মতো। তবে জীবনের গান কিংবা জীবন থেকে নেওয়া নির্মম আর বাস্তব চির সত্য পরিণতিগুলোকে কথার মালায় সাজিয়ে ,তাকে সুরের পুথি দিয়ে গেঁথে, জীবনের জন্য গাওয়া গানই বুঝি জীবনমুখী গান। তাইতো আমার গাই-“সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে”। আর এই কথাটি মানবকুলের কানে ঘুরে ঘুরে যিনি পৌঁছে দিতেন তিনি চারণ কবি বিজয় সরকার।

কবিয়াল, গীতি কবি, সুরকার, ও শিল্পী বিজয় সরকার। আধ্যাত্মিক, মরমী, বিচ্ছেদ, শোকগীতি, বাউল, শ্রী কৃষ্ণ, ইসলামী, কীর্তন, ধর্ম ভক্তি, দেশের গান সহ অসংখ্য গানের স্রষ্টা বিজয় সরকার। হয়তো আজকের প্রজন্ম বিজয় সরকারকে চিনেনা সেই ভাবে। তবে বিজয় এর গান “এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে। সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে”- এই গানটি শোনেননি এমন মানুষ পাওয়া হয়তো বিরল। রিমেক এর বদৌলতে আজ অনেকের সিডি প্লেয়ারে বাজে ওই সব গানগুলি। তবে সেই সব গানগুলোর স্রষ্টাকে এটি বোধ হয় জানেনা অনেকেই।

বিচ্ছেদের গানগুলো যখন শুনি তখন কেমন করে যেন চোখের কোনে চিক চিক করে ওঠে মুক্তার মতন জল। গ্রাম বাংলায় আজও বিচ্ছেদ গানগুলো বাজে, পালা হয়। ভক্তকুল অন্য এক জগতে হারিয়ে যায়। আধ্যাত্মিক এক ভবের মাঝে হারিয়ে গিয়ে নিজেকে তালাশ করে। খুঁজে ফেরে নিজেকে। আহারে! গান গুলি সেই সুদূর অজপাড়া গাঁয়ের সবুজ ঘাসের বুক ভেদ করে যখন ইট পাথরের শহরে আজও বেজে ওঠে- “তুমি জাননারে প্রিয় তুমি মোর জীবনের সাধনা” তখন এক অর্বাচীন আমি কান পেতে রই ওই ভক্তি গানের পানে। আমি মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে যাই। কখনো চোখের মনি ভেদ করে বারি ঝরে। এই হচ্ছে আমাদের নিজস্ব সঙ্গীত!

প্রায় ২০০০ এর মতন গানের স্রষ্টা বিজয় পাগল। বিজয় সরকার কে অনেকেই ‘পাগলা বিজয়’ বলে ডাকে। ১৯০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আবার কারো মতে ১৯ ফেব্রুয়ারি বাবা নবকৃষ্ণ বৈরাগী ও মাতা হিমালয়া বৈরাগীর অভাবের সংসারে জ্যোৎস্না রাতের শশী হয়ে নড়াইলের সদর উপজেলার ডুমুদি নামক এক ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় নামক স্থানে জন্ম নেন উপমহাদেশের এই আধ্যাত্মিক কবিয়াল বিজয় সরকার। জন্ম নেওয়া পদবী বৈরাগী থেকে তিনি এক সময় হয়ে যান সরকার। বিজয় বৈরাগী থেকে বিজয় সরকার। খুব ছোট বেলা থেকে এই কবি ছিলেন সঙ্গীতের প্রতি অস্বাভাবিক এক অনুরাগী। চাচতো ভাই অভয় চন্দ্রের বাড়িতে হাতে খড়ি নেন তার শিক্ষা জীবনের। এরপর গ্রামের এক পাঠশালায় কিছুদিন শিক্ষাগ্রহণ করেন। এরপর যথাক্রমে হোগলা ডাঙ্গা ইউপি স্কুল ও বাঁশ গ্রাম এম ই স্কুলে তিনি ভর্তি হন। সেইখানে কিছুদিন শিক্ষা নেবার পর আবারো তিনি ভর্তি হন সিঙ্গাশোল পুর কে পি ইন্সটিটিউটে। ১৯২৬ সাল ভাগ্য বিধাতা একটু বিমুখ হন বুঝি বিজয় পাগল এর উপর। বিজয় সরকারের পিতা স্বর্গে চলে যান ঠিক তার ম্যাট্রিক পরীক্ষার খানিক আগেই। পিতার মৃত্যুর পর প্রবল এক আর্থিক সংকটে পড়েন বিজয় পরিবার।

অভাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিজয় হয়তো পেরে ওঠেনি। তাইতো বন্ধ হয়ে যায় তার লেখা পড়া। জীবন যেখানে দু’মুঠো অন্ন খোঁজে সেইখানে শিক্ষা বুঝি গৌণ হয়ে পড়ে। তাইতো সেই অন্নের সন্ধানে তাকে ছুটে চলতে হয় অবিরাম। জীবনের কঠিন এক আবর্তে বিজয় সংসার আর দুঃখকে জয় করতে কর্মজীবন শুরু করেন টাবরা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হিসাবে।

এরপর কিছুদিন গোপালপুর কাচারিতে নায়েবের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু যার প্রতিটি শিরা-উপশিরায় বয়ে চলে সঙ্গীত আর সুরের এক মায়াখেলা সে কি নিজেকে শত অভাবের মাঝেও নির্দিষ্ট কোন গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখতে পারে? খুব ছোটবেলায় তিনি লেখাপড়ার সাথে সাথে সঙ্গীতের তামিল নেওয়া শুরু করেন স্থানীয় নেপাল পণ্ডিত এর কাছে। সেই নেপাল পণ্ডিত কিশোর বিজয় সরকার সহ আরও চার জনকে নিয়ে একটি পালা গানের দল গঠন করেন। এবং সেই পালা দলটি দেশের বিভিন্ন স্থানে গান গেয়ে সুনাম সুখ্যাতি অর্জন করতে থাকেন।

কিশোর বিজয় এর নাম আস্তে আস্তে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিজয় এর সঙ্গীত প্রেম আর গানের প্রতি এমন মমত্ববোধ দেখে কবি পুলিন বিহারী ও পঞ্চানন বিশ্বাস তাকে বুকে টেনে নেন। তাদের কাছে বিজয় পাঁচালী গানের দীক্ষা নিতে থাকেন। কিশোর বিজয় হয়ে ওঠেন তখন আধ্যাত্মিক এক সঙ্গীত শিল্পী। বিচ্ছেদ গানের শিল্পী।

১৯৩৩ সাল। এবার ভাগ্যদেবী মুখ তুলে তাকাল বুঝি বিজয় পাগল এর উপর। পাশের গ্রামে কবিয়াল মনোহর সরকার ও রাজেন সরকারের পালা গানের দর্শক হন কবি বিজয় সরকার। এক পর্যায়ে কবিয়াল বিজয় পাগল এক তারা বাজিয়ে একটি বিচ্ছেদ গান পরিবেশন করে সবার চোখের জল ঝরান। কবির গান শুনে হাউমাউ করে কেঁদে বুকে জড়িয়ে ধরেন কবিয়াল মনোহর। বিজয় কে তিনি বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে আশীর্বাদ করেন। এবং সেই দিন থেকেই কবি বিজয় সরকার কে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করেন।

বিজয় সরকার ২ বছর মনোহর এবং বাগেরহাটের আর এক কবিয়াল রাজেন সরকারের কাছে ১ বছর কবি গানের দীক্ষা নেন। ১৯২৯ সালে কবি বিজয় সরকার নিজেই কবিগানের দল গঠন করেন। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিজয় কবি গান গেয়ে ব্যাপক সমাদৃত হন। এবং বিজয় সরকারের নাম সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। বিজয় সরকার কবি গানের মধ্যে ভ্যারিয়েশান আনেন। তার পূর্বে তৎকালীন সভ্য বা সুশীল সমাজে কবি গান খুব বেশি শোনার বিষয় ছিলনা। কিন্তু বিজয় সরকার কবি গানকে অন্য এক মাত্রা দেন। এবং ওই সময় কার সভ্য সমাজের কাছে কবি গান হয়ে ওঠে আরাধ্যের এক বিষয়।

তিনি তার ওস্তাদ রাজেন সরকার ও মনোহর এর কবিগানের যেই দুর্বল দিক গুলো ছিল তার সংস্কার করা শুরু করেন। কবিয়াল বিজয় সরকার কবি গানের পালায় ধুয়াগানের প্রচলন শুরু করেন। এবং পরবর্তী সময়ে তিনি নিজে ধুয়াগানের রচনায় ব্রতী হন।

১৯৩৫ সালে কলকাতার এ্যালবার্ট হলে কবি গানের এক আসর বসে। ওই আসরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসীম উদ্দিন, কবি গোলাম মোস্তফা, কণ্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। তারা বিজয় সরকারের গান শুনে মুগ্ধ হয় এবং আশীর্বাদ করেন।

১৯৩৭ সালে কলকাতার বিধান স্ট্রিটের রামকৃষ্ণ বাগচী লেনের এক দ্বিতল বাড়িতে কবি গোলাম মোস্তফা, কবি জসীম উদ্দিন ও গায়ক আব্বাস উদ্দিনের সাক্ষাৎ লাভ করেন। বিজয় সরকার ওই স্মরণীয় মুহূর্তে একটি বিচ্ছেদ গান পরিবেশন করে তাদেরকে অভিভূত করেছিলেন। গানটির হল-

“সজনী ছুঁসনে আমারে
গৌররূপে নয়ন দিয়ে আমার জাত গিয়েছে
আমাকে স্পর্শ করিসনে যার কুল মানের ডর আছে”

১৯৮৩ সালে কলকাতা থেকে বিজয় সরকার রচিত ২৭০টি গান নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

১৯৩৭ সালে ১ অক্টোবর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ ভবনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে কবিয়াল বিজয় সরকার কবি গান পরিবেশন করে খ্যাতিমান ছয়জন বরেণ্য পণ্ডিতের যুক্ত সনদ লাভ করেন। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার “ভারতীয় ভাষা পরিষদ” তাকে সংবর্ধিত করে। এ অনুষ্ঠানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর দেবীপদ ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন।

এই মহান শিল্পী ছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান-এর একান্ত প্রিয় বন্ধু। সুলতান প্রায় ছুটে যেতেন কবিয়াল এর বাড়িতে। প্রচার বিমুখ ও নিভৃতচারী এই সঙ্গীত সাধক মানুষের হৃদয়ের আকুতিকে চমৎকার সুর ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে সবার অন্তরে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। বিজয় ছিলেন আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনার প্রাণপুরুষ। যেকোনো ধর্মের প্রতিও সহনশীল। জীবদ্দশার শেষ দিকে এসে তিনি খুলনা বেতারের নিয়মিত গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী ছিলেন।

যতদূর জানা যায় তার গানের সংকলন এখন আর্কাইভে খুব বেশি নেই। অথচ এই কালজয়ী শিল্পীর গানগুলো সংরক্ষণ করা জরুরী ছিল আগামী প্রজন্মের জন্য। আজ বিজয় সরকারের গানগুলো রিমেক করা হয়। তবে তার সম্পর্কে আমারা অনেকেই জানিনা যে সে কোন ধরনের শিল্পী ছিলেন। বারি সিদ্দিকি “ এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে” গানটি গেয়েছেন বিকৃতভাবে। সেই যাই হোক তবুও কবিয়ালের গান গুলো যে এখনও রিমেক হলেও বেচে আছে এটি বোধ হয় সান্ত্বনা বিজয়প্রেমীদের নিকট।

জাতি ধর্ম বর্ণের ঊর্ধ্বে থেকে এই চারণ কবি প্রায় দুই হাজার বিজয় গীতি রচনা করেন।

বিজয় সরকারের ভাবধারা ও সংগীত প্রসঙ্গে পল্লী কবি জসীম উদ্দিন বলেছেন,- “মাঝে মাঝে দেশীয় গ্রাম্য গায়কদের মুখে বিজয়ের রচিত বিচ্ছেদ গান শুনিয়া পাগল হই। এমন সুন্দর সুর বুঝি কেহই রচনা করিতে পারে না।”

এই যশস্বী শিল্পীর দরাজ কণ্ঠের কবিগান শুনে অনেক গুণীজন মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি একাধিকবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ডক্টর মোঃ শহিদুল্লাহ, দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, বিশ্ব নন্দিত চারু শিল্পী এস.এম. সুলতানসহ অসংখ্য গুণীজনের সান্নিধ্য লাভ করেন।

আমাদের বাংলা গানের যেই ব্যাপকতা সেই বিশদ বাংলা গানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন কবিয়াল বিজয় সরকার। আজীবন এই সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব রয়ে গেছেন প্রচার বিমুখ। ১৯৮৫ সাল থেকে কবি বিজয় সরকার পশ্চিম বাংলার কেউটিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। শেষ জীবনে তিনি অন্ধত্বের সাথে আপোষ করেছিলেন খানিকটা সময়। ১৯৮৫ সালের ৪ ডিসেম্বর বুধবার কবি সবাইকে কাঁদিয়ে ৮১ বছর বয়সে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে।

কবিয়াল নিজে জানতেন তাকেও চলে যেতে হবে একদিন। তাই তিনি লিখেছিলেন- “সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবেরে মন চলে যেতে হবে”। মানব ও মানবতার জন্য আজীবন গেয়ে যাওয়া গান গুলো কবিয়ালের কোটি ভক্তরা লালন করে আসছেন তাদের হৃদয়ে। তারা বিজয় সরকারকে অনুভব করেন অন্তর দিয়ে। হৃদয়ের গহীন কোণে লালন করে কবিয়াল বিজয় সরকারকে।

তথ্যসূত্র:
বিজয় সরকারের জীবনী 
বাংলাবাজার পত্রিকা

আপনার মন্তব্য

আলোচিত