রাবি প্রতিনিধি

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ২১:০১

শিক্ষা যাতে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে: রাষ্ট্রপতি

উচ্চশিক্ষা যাতে সার্টিফিকেট সর্বস্ব না হয় কিংবা শিক্ষা যাতে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত না হয় তা দেশ ও জাতির স্বার্থে সম্মিলিতভাবে নিশ্চিত করতে হবে। এটা করতে না পারলে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়বে এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়বো বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি যুগের চাহিদাকে ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) দশম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এসব কথা বলেন। শনিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়াম মাঠে এ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়।

আবদুল হামিদ একাত্তরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্মরণ করে বলেন, “১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অধ্যাপক ড. হবিবুর রহমান, ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইউমসহ সেইসব অকুতোভয় সূর্য সন্তানদের যাঁরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমি তাঁদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বলেন, “কারিক্যুলামভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি মুক্তচিন্তা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা, জাতিগঠনমূলক কর্মকাণ্ড, সমকালীন ভাবনা, সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা ইত্যাদি সৃজনশীল কর্মকাণ্ড শিক্ষার্থীদের কেবল দক্ষ ও পরিপূর্ণ করো না; কূপমণ্ডূকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকেও পরিপুষ্ট করে। এর প্রভাব ব্যক্তি জীবনে তো বটেই, সামষ্টিক জীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে।”

ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব নিয়ে রাষ্ট্রপতি জোর দিয়ে বলেন, “গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করতে হলে দেশে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। আর সেই নেতৃত্ব তৈরি হবে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের কোন স্থান থাকবে না। ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব থাকবে ছাত্রদের হাতে। লেজুড়বৃত্তি বা পরনির্ভরতার কোন জায়গা থাকবে না। ছাত্রসমাজকেই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।”

তিনি বলেন, “এই সমাবর্তন শিক্ষার সমাপ্তি ঘোষণা করছে না, বরং উচ্চতর জ্ঞানভাণ্ডারে প্রবেশের দ্বার উন্মোচন করছে। তোমরা কেউ কেউ সে বিশাল জ্ঞানরাজ্যে অবগাহন করে বিশ্বকে আরো সমৃদ্ধ করবে। তোমরা বড় হও, সফল হও।”

সমাবর্তন বক্তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এমিরেটাস অধ্যাপক আলমগীর মো. সিরাজউদ্দীন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী তাদের গবেষণার ও সৃজনশীলতার মধ্যদিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান উন্নত করেছেন। আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আজকের বক্তব্যের বিষয় নির্ধারণ করেছি ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্বাধীনতা, স্বায়ত্ত্বশাসন ও জবাবদিহিতা।”

তিনি বলেন, “মানব জাতির অনন্যতা তার বুদ্ধিবৃত্তি, বোধশক্তি ও তার বিচার বুদ্ধিতে। আর তার লালন ও বিকাশের দায়িত্ব হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের। সভ্যতার বিকাশে যখন কোন মানুষ নতুন করে কিছু জানতে চাইল তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি হলো। এ বিশ্ববিদ্যালয় একজন মানুষকে স্বাধীন মুক্তচিন্তা, সৃজনশীলতা, বস্তুনিষ্ঠ করে তোলে। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শুধু দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করে না, সমাজ ও জনসাধারণকে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনষ্ক করে তোলে। যাতে আধুনিক চিন্তাভাবনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার বাধাগ্রস্ত না হয় এবং সমাজ কুসংস্কারের থেকে মুক্তি পায়।”
বিশেষ অতিথি হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, “দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উত্তর বঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ্য শিক্ষকমণ্ডলীর সাহায্যে যুগোপযোগী, মানবিক এবং বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানচর্চার সফল প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে তার জন্য শিক্ষা পরিবারের কর্মী হিসেবে আমি গর্ববোধ করছি।

শিক্ষামন্ত্রী গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনারা এদেশের বড় সম্পদ। এ দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের একাংশ। আপনাদের আগামী দিনের কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করছে আমাদের দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি। আপনাদের অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞান বাস্তব কর্মজীবনে প্রয়োগ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করার সুযোগ আপনারা পেয়েছেন। জ্ঞান ও মেধা প্রয়োগে সৃজনশীলতা ও উদ্যোগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা অর্জনের সীমা বা শেষ নেই। আমাদের দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন, জাতির উন্নতির জন্য আপনারা সততা নিষ্ঠার মাধ্যমে আপনাদের অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগাবেন এটাই আজকের দিনে আপনাদের কাছে প্রত্যাশা।”

এর আগে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে রাষ্ট্রপতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আব্দুল লতিফ হলের মাঠে পৌঁছান। নেমেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে গিয়ে বিশ্রাম নেন। এরপর তিনি গাড়িযোগে সমাবর্তনস্থল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়ামে যান। সমাবর্তন অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বে দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের নামে দুইটি বহুতল আবাসিক হলের ফলক উন্মোচন করেন তিনি।

এদিন বাংলা সাহিত্যে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সমাবর্তনে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক ও দেশবরেণ্য সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার (ডি. লিট) ডিগ্রি তুলে দেন রাষ্ট্রপতি। পরে বিকেল পাঁচটায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে গান পরিবেশন করেন জনপ্রিয় গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিন।

সমাবর্তনে ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি, এমবিবিএস, বিডিএস ডিগ্রি অর্জনকারীদের মোট ছয় হাজার ১৪ জন গ্র্যাজুয়েট নিবন্ধন করেছিলেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত