শাবি প্রতিনিধি

০৩ অক্টোবর, ২০১৮ ২৩:৫৪

স্বাধীনতাবিরোধিরা নাস্তিক বলে আমাকে হত্যা করতে চায়: জাফর ইকবাল

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল শিক্ষকতার জীবন শেষ করে অবসরোত্তর জীবনে পা দিয়েছেন। নতুন জীবনে প্রবশের পূর্বে দীর্ঘ ২৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনের নানা স্মৃতির রোমন্থনে বুধবার মিলিত হন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে আনন্দ-আড্ডায়।

বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে দীর্ঘ ২৫ বছরের শিক্ষক জীবনের নানা আনন্দ-বেদনার স্মৃতি নিয়ে মিলিত হয়েছেন সহকর্মী শিক্ষক ও প্রিয় শিক্ষার্থীদের সাথে এক আড্ডায়।

১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক এন্ড কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেছিলেন জাফর ইকবাল। পরবর্তীতে ‘ইলেকট্রনিক এন্ড কম্পিউটার সায়েন্স’ বিভাগকে ‘কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ’ ও ‘ইলেকট্রিকাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং’ দুটি বিভাগে বিভক্ত করলে দুই বিভাগের শিক্ষক হিসেবে পড়াতে থাকেন তিনি।

দীর্ঘ ২৫ বছরের শিক্ষক জীবনের শেষ দিন ছিল ৩ অক্টোবর বুধবার। বয়স ৬৫ বছরে পৌঁছায় ৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হবে তার অবসরোত্তরকালীন নতুন জীবন।
শিক্ষক হিসেবে শেষ দিনের আড্ডায় তাঁর সহকর্মীদের সহযোগিতা, শিক্ষার্থী এবং দেশের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসার কথা তুলে ধরলেন জাফর ইকবাল। পাশাপাশি তুলে ধরলেন সিলেটে থাকাকালীন জীবেনর এই অধ্যায়ে তাঁর ওপর নেমে আসা বিভিন্ন অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলো।

তিনি বলেন, পৃথিবীতে আমার মতো সুখি মানুষ আর নাই। আমি মানুষের কাছ থেকে যত ভালবাসা পেয়েছি, আমার মনে হয় না অন্য কেউ আমার মতো এতো পেয়েছে। কিন্তু আমি কিছুই দিতে পারি নাই। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অনেক ভালো সময় কেটেছে, অনেক সুন্দর সময় কেটেছে। আমেরিকায় গেলে মানুষ আর দেশে ফিরতে চায় না। কিন্তু ইয়াসমিনকে (স্ত্রী) নিয়ে যখন এখানে আসলাম, তখন এমনভাবে জড়িয়ে পড়লাম আর যেতে পারলাম না।

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন জাফর ইকবাল। ১৯৮২ সালে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি সম্পন্ন করে ক্যালিফোর্নিয়া ইনিস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে গবেষণা শুরু করেন।

১৯৮৮-১৯৯৪ পর্যন্ত তিনি বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চ (বেলকোর) প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করেন। ওই বছরের ডিসেম্বরে দেশে ফিরে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।

একাডেমির বাইরে একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন এই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অর্জনের সাথে জাড়িয়ে আছে এই অধ্যাপকের নাম। মোবাইল ফোনে ভর্তি প্রক্রিয়া, পিপীলিকা সার্চ ইঞ্জিন, ‘ড্রোন ও রোবট’, ওয়াইফাই ভিত্তিক ক্যাম্পাস, সেমিস্টার পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর মতো নানা যুগান্তকারী অর্জন সম্ভব হয়েছে জাফর ইকবালের হাত ধরে।

জাফর ইকবাল বলেন, আমি একা এসব কাজ করিনি। আমার সহকর্মীরা এসব কাজে বেশি শ্রম দিয়েছেন। তাদের শ্রমের ফলেই এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে।

‘ইসলাম বিরোধী’ অভিযোগ তুলে চলতি বছরের ৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে এক রোবট প্রতিযোগিতা চলাকালীন তাকে  হত্যার উদ্দেশ্যে ছুরি নিয়ে হামলা চালায় এক তরুণ।

আড্ডায় সেই ন্যাক্কারজনক হামলার ব্যাপারে কথা বলেন জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, একটি গ্রুপ অন্ধভাবে মানুষকে বুঝিয়ে ভুল পথে পরিচালিত করছে। আমি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষ। তাই স্বাধীনতা বিরোধিরা নাস্তিক বলে আমাকে হত্যা করতে চায়, যাতে সাপোর্ট মিলে।

১৯৯৮ সালের দিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর বাসায়  মৌলবাদী সংগঠনের পরপর দুইবার হামলার ঘটনায় জীবনে নেমে আসা নিরাপত্তাহীনতার কথাও স্মরণ করলেন জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, আমরা (তিনি ও স্ত্রী ইয়াসমিন) রিস্ক নিয়ে এখানে শিক্ষকতা করেছি। তবে আমাদের সন্তানদের ঢাকায় বাসা ভাড়া করে নিরাপত্তার জন্য রেখে দিয়েছিলাম। শুধু উইকেন্ডে ঢাকায় যেতাম।

আয়োজনের শুরুতে জাফর ইকবালকে উৎসর্গ করে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পরে তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন তাঁর সহকর্মীরা। তারা প্রিয় শিক্ষককের অবসরোত্তর নতুর জীবনের শুরু করেন কেক কেটে।

আড্ডার শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন শিক্ষার্থীর প্রশ্নের উত্তর দেন জাফর ইকবাল।

জাফর ইকবাল বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে আজ আমার শিক্ষকতার জীবন শেষ। আমাকে আর কোন কাগজে সই করতে হবে না। তবে আমি বিভাগে থাকবো। ক্লাস নেবো। এখানকার বাসাতেই থাকবো।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত