১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ ১৩:২৩
গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নতুন জ্ঞানের দ্বার উন্মোচন, সমস্যা নির্ণয় ও সমাধানের পন্থা উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সাফল্যের শীর্ষে অবস্থান করছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ক্যান্সার শনাক্তের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন, যক্ষ্মা নিরাময়, কেমিক্যাল ও পরিবেশ, ভৌতবিজ্ঞান, সমাজ, অর্থনীতির বিভিন্ন শাখায় সমস্যা নির্ণয় ও তার সমাধানের পথ উদ্ভাবনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তৈরি প্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাফল্য দেশব্যাপী প্রশংসনীয় হচ্ছে।
শিক্ষা-গবেষণায় বিদ্যমান সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারলে নতুন জ্ঞানের দ্বার উন্মোচনে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অবসরোত্তর অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হকের নেতৃত্বে একদল গবেষক ‘ননলিনিয়ার অপটিকস’ নামে ক্যান্সার শনাক্তের একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করার কথা জানান।
অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক তখন বলেছিলেন, উদ্ভাবিত এই পদ্ধতিতে রক্তের একটি বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে মাত্র ১০ থেকে ২০ মিনিটেই ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব হবে। শিগগির এই গবেষণার বিষয়টির জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে পেটেন্ট পেতে তারা আবেদন করেছেন বলে জানান তিনি।
গবেষণায় ‘গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি’ স্বরূপ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষক চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছ থেকে ‘ইউজিসি অ্যাওয়ার্ড -২০১৭’ পুরস্কার লাভ করেছেন।
এরমধ্যে কনজুগেটেড ডোনর-একসেপটরযুক্ত ফিনাইল ইথানাইল যৌগের প্রস্তুতি, তাদের অপটিক্যাল ও থার্মাল গুণাগুণ বিশ্লেষণ নিয়ে গবেষণা করে কেমিক্যাল, বায়োকেমিক্যাল ও পরিবেশ বিজ্ঞান শাখায় রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইউনুস, পরিবেশের নিরাপত্তায় ফটোক্যাটালিক অ্যাক্টিভিটি ও সেন্সর ডেভেলপমেন্ট নিয়ে গবেষণা করে ভৌত বিজ্ঞান শাখায় একই বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সোবহান এ বছর ‘ইউজিসি অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কার লাভ করেন।
আর যক্ষ্মা নিরাময়ের জন্য ‘পেপটাইড বেইজড সাবোনিট ভ্যাকসিন ডিজাইন’ শিরোনামে গবেষণা করে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ‘ইউজিসি অ্যাওয়ার্ড -২০১৭’ লাভ করেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ।
তিনি বলেন, “যক্ষ্মা নিরাময়ের জন্য আগে থেকেই আমরা ভ্যাকসিন ব্যবহার করে আসতাম। কিন্তু তাতে দেখা যেত, প্রায় ১৮-২০ শতাংশ রোগ নিরাময় হয় না। নতুন এ পদ্ধতিতে আমরা মাইক্রোব্যাকটোরিয়ামের জিনোমের মধ্যে একটি কমন প্রোটিন নির্ধারণ করেছি, যা ভ্যাকসিনের সাথে ব্যবহার ব্যাকটেরিয়ায় এন্টিজেন হিসেবে কাজ করবে। আমরা আশা করছি এতে শতভাগ যক্ষ্মা রোগ নিরাময় সম্ভব।”
আর বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জলবায়ুর ধারণা পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে গবেষণা করে অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে অধ্যাপক ড. শাহ মো. আতিকুল হক ‘ইউজিসি অ্যাওয়ার্ড -২০১৭’ লাভ করেছেন।
‘হাই ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নাল পাবলিকেশনের’ জন্য এ বছর ‘ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুজ্জামান।
‘ফুডস ফ্লেভার একটিভ কম্পাউন্ড ডিটারমিনেশন’ শিরোনামে খাবারের সুগন্ধি নিয়ে কাজ করে ‘আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি’ কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে কোয়ালিটি-১ র্যাঙ্কিংয়ে থাকা ‘জার্নাল অব দা সাইন্স অব ফুড এন্ড এগ্রিকালচার’ পত্রিকায় তার গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়।
তবে গবেষণায় শাবি শিক্ষকদের সাফল্যের পাল্লা তুলনামূলক ভারি হলেও এখানে রয়েছে নানান সঙ্কট; যা নিরসন হলে গবেষণায় এই বিশ্ববিদ্যালয় আরও অনেকদূর এগিয়ে যাবে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
শিক্ষকদের গবেষণার জন্য ২ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, যা প্রয়োজনের তুলনায় কম বলে মনে করছেন শিক্ষকরা। এছাড়া শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য প্রণোদনা, ট্রেনিংসহ এখনও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা করতে পারেনি এ বিশ্ববিদ্যালয়।
গবেষণা সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. জাকির হোসাইন বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সেন্টারের অধীনে এ বছর ১৫০টি গবেষণাপত্র নিয়ে মোট ২৫০ জন শিক্ষক কাজ করছেন। বাকি শিক্ষকদের নিজ খরচে গবেষণা চালাতে হয়।'
'আমাদের সঙ্কট রয়েছে। তারপরও আমরা ভালো কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করছি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সঙ্কট নিরসনে সদয় হলে আরও ভালো কাজ করতে পারব।'
আর্থিক কারণে অনেক শিক্ষক গবেষণা কাজে নি:স্পৃহ হয়ে পড়েন। অনেকে আবার পদোন্নতির জন্য দেশীয় কোন জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করে দায়সারা হয়ে পড়েন। কারো কারো গবেষণাপত্রে অনেক সময় প্লেজারিজমেরও অভিযোগ পাওয়া যায়।
তবে এই অবস্থা আর থাকবে না বলে সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, 'আমরা গবেষণার জন্য বাজেট বাড়িয়ে ২৯০ কোটি টাকা করেছি। প্রয়োজনে এ বছর ৪০০ কোটি টাকা করব। কিন্তু কাজ ভালো হতে হবে। কোন ফাঁকি চলবে না। প্লেজারিজম থাকলে চলবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা শিক্ষকদের কোয়ালিটি উন্নয়নের জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে। ভালো গবেষণা হলে বাজেট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমরা সকল ধরনের সহযোগিতা করব বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে।'
শিক্ষার্থীদের গবেষণায় সক্ষমতা অর্জনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান উপাচার্য।
আপনার মন্তব্য