শাকিলা ববি

১৭ ফেব্রুয়ারি , ২০১৯ ০০:৪৯

ছাত্রলীগের ‘কোন্দলে’ আটকে আছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন

আলাদা ভবন থাকলেও ২৮ বছর ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না এমসি কলেজে

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছিলো ১৯৯১ সালে। এরপর ২৮ বছর পেরিয়ে গেলেও আর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ছাত্র সংসদের জন্য এই কলেজে আলাদা দ্বিতল ভবন থাকলেও নেই সংসদ নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের তারিখ ঘোষণায় এমসি কলেজের শিক্ষার্থীরাও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। এখন পর্যন্ত কলেজ কর্তৃপক্ষের ভাবনায় নেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন।

নির্বাচন না হলেও কলেজে অধ্যয়নরত প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রতি বছর ছাত্র সংসদের চাঁদা নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ছাত্র সংসদ না থাকায় কলেজের ছাত্র সংসদ ভবনের নিচ তলা এখন অফিসরুম, সেমিনার এবং শিক্ষক মিলনায়তন হিসেবে ব্যবহার করছে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ আর ভবনটির দ্বিতীয় তলা ব্যবহার করা হচ্ছে বিদেশী ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে।

কলেজে অধ্যয়নরত কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতারা বলছেন, কলেজ প্রশাসন নির্বাচনের মৌখিক আশ্বাস দিলেও দৃশ্যমান কোনো কাজ করছে না। তবে এক্ষেত্রে কলেজ প্রশাসন বলছে, ছাত্রলীগের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কমিটি না থাকার কারণে নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না।

এমসি কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (হায়দার) এমসি কলেজ শাখার আহ্বায়ক সাদিয়া নোশিন তাসনিম সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি আমরা অনেকদিন যাবত করে আসছি। বর্তমান সময়ে এমসি কলেজের শিক্ষার্থীরা অনেকটা ক্যাম্পাস বিমুখ। এমসি কলেজে কি হচ্ছে এ ব্যাপারেই বেশিরভাগ শিক্ষার্থী অবগত না। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ফিরানো যাবে। কলেজের সকল কাজে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো যাবে। যেহেতু ছাত্র সংসদ নির্বাচন তাই শুধুমাত্র রাজনৈতিক দল সমর্থিত শিক্ষার্থী নয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের এখানে যুক্ত হতে হবে। অনেকেই হয়ত কোনো সংগঠন করেন না কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে প্রতিটি শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের সুযোগ আছে। সেদিক চিন্তা করলেও সকল শিক্ষার্থীদের সক্রিয়তা বাড়বে।

দীর্ঘদিন যাবত কলেজে নির্বাচন না হওয়ার ব্যাপারে তাসনিম বলেন, আমরা মনে করি, ছাত্র রাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করার জন্য নির্বাচন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ক্ষমতায় যে যখন আসেন তাদের ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্য বিস্তারের জন্যই মূলত ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। এখন সে কাজটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। শাসকগোষ্ঠী যে যখন ক্ষমতায় আসছে তাদের ছাত্র সংগঠনের জোড় জবরদস্তি, দখলদারিত্ব চলে। জোড় জবরদস্তি, দখলদারিত্ব ছাত্রাবাস, ক্যাম্পাসে সব জায়গায়ই চলে। এসব অনৈতিক কাজকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে রাখা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচন না হলেও দীর্ঘদিন যাবত আমরা এমসি কলেজের শিক্ষার্থীরা ২৫ টাকা করে ছাত্র সংসদের চাঁদা দিয়ে আসছি। আমাদের ছাত্র সংসদ ভবনও আছে। তাহলে কেন আমাদের কলেজে নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন দাবি নিয়ে আমরা ক্যাম্পাসে মিছিল করেছি। আমরা যখন কলেজ প্রশাসনের কাছে গিয়েছি তারা আমাদেরকে শুধু মৌখিক ভাবে আশ্বাস দিচ্ছেন।

এমসি কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি নেই দীর্ঘদিন ধরে। বরং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজেদের মধ্যে নানা উপ গ্রুপে বিভক্ত কলেজ ছাত্রলীগ। তবে সব গ্রুপের নেতারাই দাবি জানিয়েছেন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের।

ছাত্রলীগের কলেজ শাখার নেতা হোসেন আহমেদ বলেন, আমাদের প্রাণের দাবি এমসি কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন। বিগত দুই বছর যাবত প্রতিটি ছাত্র শিক্ষক মিটিংয়ে আমরা এই নির্বাচনের দাবি করে আসছি। এই নির্বাচনের জন্য আমরা সব সময় প্রস্তুত আছি।

হোসেন আহমেদ বলেন, ‘ছাত্রলীগের গ্রুপিংয়ের জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না এ কথা সঠিক নয়। আমাদের মধ্যে একতা নেই এটা ভুল ধারনা। এইসব কারণে নির্বাচন হচ্ছে না বলাটা কলেজ প্রশাসনের একটি অজুহাত মাত্র। এমসি কলেজে দীর্ঘ নয় বছর যাবত কমিটি নেই। তারপরও আমরা কাজ করছি। বিগত দুই বছর যাবত আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দাবি তুলেছি। ক্যাম্পাসে সৃষ্টিশীল কাজ করেছি। আমাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই বঙ্গবন্ধুর মোড়াল এমসি কলেজে স্থাপন হচ্ছে। ছাত্র সংগঠন নির্বাচনের জন্য প্রচার প্রচারণার ক্ষেত্রে কলেজে ওয়াল রাইটিং করেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করছি।’

তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা সবসময় কথা বলি। তবে নির্বাচিত সংসদ এই কাজটা করলে আরও গুরুত্ব পাবে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য কলেজ প্রশাসনকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা প্রস্তুত আছি। কলেজ প্রশাসন নির্বাচন আহবান করলেই আমাদের মাঠে নামার মত একাত্মতা আছে।

ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কলেজে নেতৃত্বের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘যখন থেকে নির্বাচন নিয়ে আমরা কথা বলছি তখন থেকেই আমরা নেতৃত্ব কাদের দিব চিন্তা করে রেখেছি। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যায়েও আমাদের আলোচনা হয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হয়তো আমরা নির্বাচন করতে পারবো না। তবে এই কলেজে আমাদের আগামী প্রজন্ম থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার মত ছাত্রনেতাও আছে। কলেজ প্রশাসন নির্বাচনের উদ্যোগ নিলে অবশ্যই নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেল থাকবে।

ক্যাম্পাসে সকল ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের সমান ভাবে কাজ করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যখন থেকে প্রশাসন নির্বাচনের জন্য আমাদের সাথে আলোচনায় বসবে তখন যেন সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণ থাকে সেজন্য আমি এমসি কলেজ ছাত্রদলের সদস্য সচিব দেলোয়ার হোসেনের সাথে কথা বলেছি। তাকে কলেজে আসার জন্য আহবান জানিয়েছি। আমরা চাই ক্যাম্পাসে সকলের সহাবস্থান থাকবে। ছাত্রদলের নেতা কর্মীদের ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাও নিশ্চিত করবো। এ বিষয়টা নিয়ে আমরা আমাদের কর্মীদের সাথেও কথা বলেছি। আমরা আমাদের কর্মীদের বলে দিয়েছি যে ছাত্রদল আসলে কেউ কোনো বাঁধা নিষেধ দিবে না। আমার যার যার রাজনীতি আলাদা ভাবে করবো। কোনো সহিংসতায় আমরা জড়াবো না। ’

এ ব্যাপারে এমসি কলেজ ছাত্রদলের সদস্য সচিব দেলোয়ার হোসেন বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন আমরা সব সময়ই আশা করি কিন্তু এক্ষেত্রে সকল রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করা দরকার। আমরা সব সময়ই ক্যাম্পাসে থাকতে চাই কিন্তু আগে আমরা ছাত্রলীগের জন্য ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারি নাই। এখন নির্বাচনে সকলের অংশগ্রহণ দেখানোর জন্য তারা আমাদের আমাদেরকে কলেজে আসার জন্য বলছেন।

কলেজ প্রশাসনের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, অধ্যক্ষ স্যারের কাছে কলেজ ছাত্রদলের নেতাদের নাম্বার আছে। স্যারেরা আগে আমাদের কলেজের সকল মিটিংয়ে ডাকতেন কিন্তু এখন কোনো মিটিংয়ে ডাকেন না। কলেজে বার্ষিক মিটিং হয়। খেলাধুলা, ক্লাব, মিলাদের মিটিং হয় কিন্তু গত দুই বছর যাবত কোনো মিটিংয়েই ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা আমন্ত্রণ পায় না। কলেজ প্রশাসন ছাত্রলীগ নিয়েই সব কিছু করেন। আমরা মাঝে মাঝে কলেজে গেলে স্যারের সাথে দেখা করে আসি।

তিনি বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে কলেজ প্রশাসনের দায়িত্ব। তারা নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করবেন। আমরা অপেক্ষায় আছি কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের ডাকবেন। তারা ডাকলে আমরা অবশ্যই যাবো। তবে এখনো কলেজ কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগাযোগ করেননি।

এ ব্যাপারে এমসি কলেজের উপাধ্যক্ষ মো. সালেহ আহমদ বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনের তারিখ হওয়ার পর এমসি কলেজের শিক্ষার্থীরা নড়েচড়ে বসেছে। আগে আমরা তাদেরকে অনেকবার বলছি নির্বাচন করার জন্য। তারা সাড়া দেয়নি।

তিনি বলেন, কলেজে এখন আর ছাত্রদল, ছাত্র শিবির নেই। সক্রিয়ভাবে আছে ছাত্রলীগ। তবে তারা নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং, মারামারি-কাটাকাটি ছাড়া কখনো রাজি হয় না নির্বাচন করতে। ২৬ বছর যাবত কলেজে কর্মরত আছি। আমি নিজেও ব্যক্তিগত ভাবে তাদেরকে নির্বাচন করার কথা বলেছি। কিন্তু তারা নিজেরাই সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। তারা কখনো চায়নি ছাত্র সংসদ নির্বাচন।

তিনি বলেন, ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য কলেজ প্রশাসন শতভাগ আন্তরিক। আমরা সকলকে আহবান জানাচ্ছি তারা যদি ঢাকসু নির্বাচনের সাথে সাথেই নির্বাচন চায় আমরা নির্বাচন দিয়ে দিব।

উপাধ্যক্ষ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের এমসি কলেজের কোনো কমিটি হয়নি। ছাত্রলীগ যারা সমর্থন করছে সিনিয়র তাদের কোনো ছাত্রত্ব নেই। কারো ২ বছর, কারো তিন বছর আগে ছাত্রত্ব শেষ। যারা বলে কলেজ প্রশাসন আন্তরিক না তার ঠিক কথা বলে না। বর্তমানে তাদের চার থেকে পাঁচটি গ্রুপ আছে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কে ভিপি জিএস প্রতিনিধিত্ব করবে এটাই তারা নির্ধারণ করতে পারেনি। এসব আমি সবার সামনা সামনি বলতে পারবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘তাদের দায়িত্ব প্রাপ্ত দুইজন নেতা আছে দেলোয়ার ও হোসেন। দেলোয়ারের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে দুই বছর আগে। সে এখন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করছে। আর হোসেন হচ্ছে ড্রপ আউট। পরীক্ষা দেয় নাই তাই অনার্স ২য় বর্ষে আটকা পড়ছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ি এই দুজন হল এমসি কলেজে ছাত্রলীগের দায়িত্ব প্রাপ্ত নেতা। এই দুই দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার এই হলো বর্তমান অবস্থা।’

ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে কলেজ প্রশাসন সব সময়ই আন্তরিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি কেউ থাকে তাহলে আমাদের জন্য ভাল হয়। এত করে লিমিটেড মানুষদের আমাদের হ্যান্ডল করতে হবে। শিক্ষার্থীদের যেকোনো সমস্যায় ভিপি জিএস কে ডাকাবো, মিটিং করবো। তারা গিয়ে সমস্যা সমাধান করবে। এটা কলেজ প্রশাসনের জন্য সুবিধা।’

ছাত্র সংসদ ভবন নিয়ে সালেহ আহমদ বলেন, ‘ছাত্র সংসদ নাই, তাই এ ভবনে এফএলটিসি প্রজেক্ট ও ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের কার্যক্রম চলছে। শিক্ষার্থীদের ভিতরে নির্বাচনের কোনো আমেজই নেই কিন্তু আমরা ঠিকই প্রস্তুত আছি। আমরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। এখন ছাত্ররা বললেই এই ভবনের ভিতরে যা জিনিস আছে সরিয়ে নিব। শিক্ষার্থীরা চাইলেই আমরা ভবন খালি করে দিতে পারবো। কলেজ প্রশাসন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য শতভাগ প্রস্তুত আছে।’

প্রসঙ্গত, এমসি কলেজে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯১ সালে। সে নির্বাচনে ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ মিলে ছাত্র ঐক্য গঠন করে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের আসাদুজ্জামান চৌধুরী পিন্টু ও জিএস নির্বাচিত হন জাসদ ছাত্রলীগের ওমর আশরাফ ইমন। একানব্বইয়ের পর আর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় নি এখানে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত