কাবেরী গায়েন

১২ অক্টোবর, ২০১৫ ১৭:০৮

মহালয়া মানে ঘুমচোখে শীতের সকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

দেখতে দেখতে কেমন সব কিছু স্মৃতির অনুষঙ্গ হয়ে গেলো। বরিশালে আমাদের কাঠ আর টিনের দোতলা বাসায় সকালের শিশির পড়বে মৃদু শব্দে। আগের রাতে দিদি আর মণিদা ছোড়দার কালো ছোট ট্রানজিস্টারে ব্যাটারি ঠিকমতো আছে কি না দেখে রেখেছে ঠিকঠাক। খুব ভোরে, (ভোর পৌনে পাঁচ? সাড়ে পাঁচ?) বেজে উঠবে রেডিও। ঘুম ঘুম চোখে মা বলবেন, “ওঠ। শুনবি না মহালয়া?” খানিকক্ষণ বিছানায় থাকবো, খানিকক্ষণ কাঠের বারান্দায় গায়ে চাদর নিয়ে শুনবো এক মোহময় গলার অসাধারণ বর্ণনায় দেবীর আবাহন, অসুরের সাথে যুদ্ধ আর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার বর্ণনা। মাঝে মাঝে গান হবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়সহ বড় বড় সব শিল্পীর। গীতিকাব্য শুনতে শুনতে চোখের সামনে সকাল হবে, সূর্যের আলো উঠবে। আর ক’দিন পরেই দুর্গা পূজা জানা হবে। পূজার আগাম বার্তা।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সম্পর্কে অনেক মিথ  শুনে বড় হয়েছি। তিনি সেই শীতের ভোরে, একগলা জলে ডুবে না কি এই আবৃত্তি করতেন। করতেন না কি? গলাজলে ডুবেই করুন কিংবা  স্টুডিওতেই করুন, পূজার অনুষঙ্গ ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় এই মহালয়া। তাঁর গলাই জানাতো দেবীর আগমন-বার্তা। আশে-পাশের দু’একটা বাড়ি থেকেও ভেসে আসতো এই অসম্ভব আবেগী গলা। একবার সম্ভবত অন্যরা দায়িত্ব নিয়েছিলেন (উত্তম কুমার কি?)। মা’র মুখে শুনেছিলাম, তেমন জমেনি সেবার। দিদি-মণিদা’র মুখেও সম্ভবত। সোনাদা-দাদা-আমি তখনো মতামত দেবার মতো বড় হইনি। আমরাও মনে করেছিলাম, খুব একটা জমেনি। সকালে স্কুলে যাবার আগে পুকুরে স্নান করতে গিয়ে জ্যোৎস্না-পাঁপড়িকে বলেছিলাম, এবারের মহালয়া তেমন হয়নি।

এরপর বাবার চাকরির সূত্রে রাঙ্গামাটিতে যখন গেলাম, তখন একধরণের সেমি-বাংলো টাইপের বাসা। ফলে পাড়ার যে সংযোগ, সেটি তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে আমাদের। দিদি ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেছে। আমরা মহালয়া শুনলেও নিজেরাই শুনি তখন। মণিদা যেহেতু তখনো বাসায়, নিশ্চয়ই শুনি। পাবনায় যখন এলাম, তখন ফের একটা আবহ। সকালে শালগাড়িয়া থানা পাড়ায় মাইকেই বাজতো মহালয়া। সেও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায়।

সর্বশেষ কবে মহালয়া শুনেছি, মনে নেই। তবে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় মামাবাড়ি গিয়েছিলাম, গোপালগঞ্জে। সারা শহরে মাইকে বাজছে মহালয়া। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র বাজছেন মহালয়া রেডিওতে শেষ হয়ে যাবার পরেও। কেমন উৎসব উৎসব ভাব। সেই প্রথম বোধহয় একসাথে এতো মানুষের অংশগ্রহণ দেখা। হিন্দু-মুসলিম ভেদ নেই। সবাই শুনছেন মাইকে বাজা সেই রোমাঞ্চকর বর্ণনা। শুনতে শুনতে, হাঁটতে হাঁটতে ঘোল খেয়ে বাসায় ফেরা। কবে মহালয়া শোনা বাদ দিয়েছি মনে নেই। কিন্তু একদিন মা’র মুখেই শুনেছিলাম, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর বেঁচে নেই। সেই কারণেই কি না, জানি না, আর বোধহয় শোনা হয়নি।

বহুবছর পরে, এবার প্রথমে  কয়েকদিন আগে দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজল কৃষ্ণ ব্যানার্জীর পোস্টে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার লিঙ্ক, শোনা হয়নি। আজ দেখছি কবি জাহানারা নূরীর পোস্টে  বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার লিঙ্ক। মজার ব্যাপার, কেউ-ই মহালয়া না, লিঙ্ক দিয়েছেন ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া’র লিঙ্ক। অথেনটিসিটি। চালিয়ে দিয়ে লিখছি।

সময়ের চেয়েও দ্রুতগামী মানুষের মন। অক্সফোর্ড মিশন রোডের সকালের কুয়াশামাখা বারান্দায় চাদর পরা আমার শৈশব। সেখানে মা আছে, বাবা আছে, দিদি-মণিদা-সোনাদা-দাদা আছে। লিলি আছে কি না, ঠিক মনে করতে পারছি না। খুব ছোট তখনো। চোখের সামনে কুয়াশা কেটে সকাল হচ্ছে। আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলছেন, ‘দেবী তখন অপরূপ রূপে আবির্ভূত হলেন...’। মা-বাবা পারাপার ছাড়িয়েছেন। ভাই-বোনরা শুধু দূরে দূরেই না, ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশে। তবুও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এক সকাল তৈরি করছেন। আমার শৈশবের সকাল, সেখানে সবাই আছে। বাবা নিজের চাদরের ভেতর জড়িয়ে নিলেন আমাকে, যেনো ঠাণ্ডা না লাগে। আপনাকে আকূল হয়ে শুনছি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।


ভিডিও : Mahalaya - Birendra Krishna Bhadra

আপনার মন্তব্য

আলোচিত