গোঁসাই পাহলভী

২৫ অক্টোবর, ২০১৫ ০৯:০৬

ফের কারবালা

আসো,
কাছে আসো সহ্যের নিকটে,
পা’তা আছে গলা, নিথর দেহ।
আসো,
নগ্ন তরবারি,
নগণ্য বলি বা ধীরে ধীরে টুকরা করো,
এ বিষয়ে ইশ্বরের প্রত্যাদেশ থাক বা না থাক,
কাছে আসো গুরু,
হন্তারকের সাথে দা কুমড়ার পিরিতি চলুক।
কেহ বলুক বা না বলুক,
সন্ত্রাস হও,
সন্দেহ করো,
দাহ করো আকাশের যত ক্ষোভ!
বিক্ষোভের বদলে টুকরা বাটখাড়া, নতজানু হয়ে পাতালে সূর্য দেখো
আর প্রণামের বদলে নিজের নামে কিছু দান খয়রাত করো!
 
আসো,
মুখোমুখি দাঁড়াও,
দরিয়ার থেকে ঢেউয়ের সাথে যতটুকু ফেনা আসে,
রূপচর্চার জন্যে ঐসব গ্রহণ করো, গ্রহণ করো দ্বি-খণ্ডিত চোখ।
 
ইশ্বর একজন থেকে যাবে আর চিড়িয়াখানায় থেকে যাবে কতিপয় বানর।
 
হোসেনী দালানে বোমা হামলার কথা শোনার পরে আর ঘুম হয়নি। ঘুম হয়নি দুটি কারণে, এক.পরের দিন সকালে অর্থাৎ কারবালা দিবসে ইমামবাড়ায় যাওয়ার কথা,অনেক সময় রাতেই চলে যেতাম। কিন্তু যাইনি,ভাবলাম,আমি কী তাহলে রক্ষা পেয়ে গেছি! দুই. কোনও মানুষের মৃত্যুই স্বাভাবিক নয়। মৃত্যু মেনে নেওয়ার মধ্যে কোনও সাফল্য নেই।বাহাদুরি নেই।সাধুগুরুদের সাথে মিশে দেখেছি তাঁরা জেন্দা দেহে মরার বসন পড়ে আছেন। অর্থাৎ জিয়ন্তে মরা। বেঁচে আছেন কিন্তু মৃত। অর্থাৎ যার কোনও প্রতিক্রিয়া নাই। এই প্রতিক্রিয়াহীনতা বা নিস্পৃহ বা নিরপেক্ষ উপস্থিতি নিরবতার শামিল।
 
জ্ঞানীর নিরবতাকে মহাঅপরাধ,জঘণ্যতম অপরাধ হিসাবে গণ্য করি। সাধুগুরুরা যদি নির্বাণলাভ করে নিরব থাকেন, তাহলে তাঁরা মানুষের সমাজ ছেড়ে দিন। মানুষের মধ্যে থাকার কোনও কারণ নেই! রসুলের তিরোধানের পর মাওলা আলীর নিরবতাকে পৃথিবীর ইতিহাস নতুনভাবে পাঠ করছে। বলা যায় মাওলা আলীর নিরবতাকালের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই মানব সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে। আলী তাঁর (নাহাজুল বালাগায়) খুৎবার ভাষণে বলেছেন, আমি যদি সেদিন অস্ত্র ধারন করতাম তাহলে ইসলাম বিপন্ন হতো। ইয়া মওলা আলী আপনার প্রতি আমার প্রশ্ন ইসলাম কি এখন বিপন্ন হচ্ছে না! কিছু মনে করবেন না ইসলামের এই সমূহ বিপর্যয়ের কারণ হিসাবে আপনার ঐ নিরাবতাকেই মূল কারণ সনাক্ত করি। সাধুদের এই যে বেঁচে থাকা, এবং বিভিন্ন বিপর্যয়গুলোতে নিরব থাকার কারণ হচ্ছে এঁরা নির্ভরশীল। ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই।
 
দ্বিতীয়ত, সার্বজনীনতা মানে এই নয় যে অপরাধ সংঘটিত হবার সময় তিনি নিরব থাকবেন। মনে রাখতে হবে বর্তমান বা আগামি সময়ের বাঁচা মানে কিন্তু রাষ্ট্রের অংশ হয়ে বাঁচা। মানুষ ধ্বংস হয়ে গেলে রাষ্ট্র থাকে না। মানুষ ধ্বংসের মধ্যে দিয়ো রাষ্ট্র এবং সভ্যতা ধ্বংসের সূচনা হয়। একজন মানুষকে সার্বিকভাবে হত্যা করতে পারলে একটি সভ্যতাকে হত্যা করা যায়। এটাই ঘটছে, এই বাস্তবতা। সত্যিকার অর্থে, সাধুবিধান থাকার পরেও রাষ্ট্র এবং সাধুর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক টি পরিষ্কার হয়নি।ফলে রাষ্ট্রের সামনে সাধু নিরব। যেভাবে মাওলা আলী নিরব ছিলেন! বিযুক্ত থেকেও যে যুক্ত থাকা যায়, রাজহংস এবং জল ও দুধের রূপকে কথা বলার পরেও বিষয়টি কারো কাছে পরিষ্কার হলো না! হোসেনী দালানে বোমা বিষ্ফোরণের পর বাঙলাদেশের কোনও পীর মাশায়েখ, সাধুগুরু ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এর কোনও ‘প্রতিবাদ’ করেননি। প্রতিবাদ শব্দটিকে বন্ধনীতে রাখলাম। যারা কৌম হিসাবে বাঁচেন, যেমন আহলে বায়াতের নামে যতগুলো সংগঠন আছে, তাঁরা কোথায়? পীর ফকির যাঁরা কথায় কথায় মুসলমানদের জন্যে আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক, তাঁরা কোথায়? মাওলা আলীর মতো সকলেই নিরব!
 
রাতে ঘুম হয়নি। অপক্ষো করছিলাম সকালের জন্যে। হৃদয়ে শোক নিয়ে আর ঘরে বসে থাকার জো নেই। যারা শোক পালনের অধিকারটুকু হারাতে বসেছে, কারবালা দিবসের জন্যে নয়, আমার নিজের শোক পালনের অধিকার রক্ষার দাবি নিয়ে হাজির হবো হোসেনী দালান থেকে বের হওয়া মাতম মিছিলে। সারারাত কোরানের একটি আয়াতাংশ মনে পড়েছে খুব।‘হে মানুষ! আমি তো তোমাদের মধ্যে এককে অপরের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ করেছি। তোমরা কি ধৈর্য ধরবে? তোমার প্রতিপালক তো সব দেখেন (সুরা ফুরকান,২১)।হে আল্লাহ, আমরা তোমার পরীক্ষায় ফেল করেছি। আপনি আমাদের প্রতিপালক, কিন্তু আমাদের পালকেরাও ফেল মেরেছে। হ্যা আমরা কেবল কাপুরুষের মতো ধৈর্য ধারন করে আছি। আমরা খুব মহৎ!
 
সকালবেলা হোসেনী দালানে গিয়ে হাজির হলাম। পুলিশ র‌্যাব বিডিয়ার যৌথ বাহিনীর গাদাগাদির মধ্যে ইমামবাড়ার সামনের লন্ড্রীর দোকানে দাঁড়িয়ে আছি। দুটো মহিলা আয়রন করা কাপড় নিচ্ছেন। একজন মহিলা আরেকজন মহিলাকে বলছেন, এই সব কি বাজে কাজ সারারাত ধরে পোলাগো নাচন কোদন। লন্ড্রীর দোকানদার বললেন শুধু কি পোলারা, মাইয়ারাও আছে, মহিলা বললেন কি নোংরামি,ছিনালগিরি। অন্য মহিলা বললেন আমার জামাইতো আমারে ওখানে যাইতেই দেয়না, ওসব মাতম কোদম পছন্দ করে না, হারাম এসব! ভাবছিলাম এরা দুজন মা। কারো জননী।
গতকাল রাতে এখানে প্রাণ গিয়েছে,আহত হয়েছে অনেকে। মায়েদের আহাজারি তো টিভিতেও দেখিয়েছে। রক্ত এখনও তাজা, মাছি উড়ছে, অথচ একজন জননীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, কোনও টান নেই, কোনও আহাজারি নেই, নেই হাসান হোসেনের জন্যে কোনও শোক। তাঁরা হারাম হালাল নিয়ে চিন্তা করছেন!
 
এইসব যখন ভাবছি, তখন কলেজে পড়া এক ছাত্র আমাকে প্রশ্ন করলো, আপনার নাম?
বললাম, আমি কি আপনাকে চিনি?
ছেলেটি বললো, না।
তাহলে আপনি আমার নাম জানতে পারেন কীভাবে?
: চাইতে পারি না!
বললাম, আপনি তো নাগরিক জ্ঞানটুকুও রাখেন না। একজন অপরিচিত লোকের সাথে কথা বলতে হলে আগে নিজের পরিচয় দিয়ে নিতে হয়, এটা ভদ্রতা। ছেলেটা কাচুমাচু করছে। বললাম, নাম জানতে হবে না, আপনি মূলত কি জানতে চান সেটা বলুন। বললো, আপনি যে গোঁফ রেখেছেন সেটা হারাম, মুসলমান হলে আপনি এই গোঁফ রাখতে পারেন না! অবাক হলাম খুব। ছেলেটা মুহুর্তেই বিচারক হয়ে গেল। আমার ভেতরে যে শোক, হাহাকার কাজ করছে ছেলেটা কি সেটা বুঝতে পারছে না! এই যে কাছাকাছি বোমায় হত্যা হওয়া মানুষের রক্ত পড়ে আছে ঐ রক্তের কি কোনও তারঙ্গিক সংঘর্ষ নেই, কোনও অভিঘাত নেই ছেলেটির কাছে! ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে হালাল হারামের বিচার চালাচ্ছে! একজন লোকের মগজের ভেতর ঢোকার সহজ রাস্তা হচ্ছে ধর্মের পথ দিয়ে ঢোকা। ছেলেটা সে সুযোগই নিচ্ছে। বললাম আপনি কি মুসলমান? ছেলেটি সম্মতি জানালো। বললাম, আপনি নিজে তো ক্লিন সেভড,দাড়িগোঁফ ছোটবড় কিছুই তো রাখেন নি। মুসলমান হওয়া কি সহজ? বললো, আমি ধর্ম পালন করি, আমি মুসলমান। বললাম, মানুষ হওয়া কি সহজ কাজ? ছেলেটি বললো না, খুব জটিল। মানুষ হওয়া যদি খুব জটিল কাজ হয় তাহলে মুসলমান হওয়া খুব অসম্ভব কাজ। অত্যন্ত অল্প কিছু লোক মুসলমান হতে পারে।
 
মানুষ হতে গেলে আপনাকে রিপুইন্দ্রিয় বিষয়ক ফয়সালা না করলেও চলে। যেমন ছেলেটা মানুষ হয়েছে, কিন্তু সেই মানুষ হওয়ার সাথে রিপু ইন্দ্রিয়; যেমন, ছেলেটার লোভ, কাম ক্রোধ এগুলো কি ছাড়তে হয়েছে? মানুষ হলে কামক্রোধ লোভ মোহ এইভাবে ষড়রিপুকে ত্যাগ করার প্রয়োজন হয়না, কিন্তু মুসলমান হ’তে গেলে এগুলো ত্যাগ করতে হয়। মুসলমান হওয়া খুব কঠিন কাজ!
 
ছেলেটিকে বললাম,আরো জানুন, জানতে জানতে বিকশিত হন। বললো, জানার থেকে মানা ভালো। বললাম, যতটুকু মানছেন ততটুকু জেনেই মানছেন। কিন্তু শিক্ষার বিষয় হচ্ছে এই, সম্পূর্ণ না জানা পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। কিন্তু আমরা জন্ম থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে পয়দা হই। সিয়া হই, সুন্নি হই!
 
এরই মধ্যে লক্ষ্য করলাম তাজিয়া মিছিল বের হচ্ছে ধীরে ধীরে। সকলের চোখে মুখে নিরবতা। রক্তিম ধ্বজায় ছেয়ে আছে রাস্তা। আমিও ঢুকে গেলাম মিছিলে। একজন মাইক্রোফোন হাতে গান গাইছেন, কোরাসে-
 
বেইমান ইয়াজিদ চাইলো হুসেনের হাত
মিথ্যা চেয়েছিল সত্যের বায়াত
আমার হুসেন সত্যের প্রতিক হাত
না দিয়ে দিলেন গলা।
লা ইলাহা ইল্লাললাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
 
মিছিল এগিয়ে চলছে। রাস্তার দু’পাশের বাড়ীঘর থেকে বের হয়ে আসছেন গৃহিনীরা। কেহ আপেক্ষা করছেন পানি নিয়ে, কেহ বা দুধ। কয়েকজন হিন্দু মহিলাকে দেখা গেল মিছিলের ছেলেদেরকে পরম মমতায় জল পান করাচ্ছেন, বিস্ময় জাগলো খুব। এঁরা কি হুসেনী ব্রাহ্মণ? না’কি এরা মা, সন্তানের জননী! শোক পালনের অধিকার নিয়ে মিছিল এগিয়ে চলছে..

আপনার মন্তব্য

আলোচিত