২৬ অক্টোবর, ২০১৫ ১০:১৯
যেনো হঠাৎই কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন কল্যানময় রায় গৌতম। আমাদের প্রিয় গৌতম দা। বলা ভালো, চলে যেতে বাধ্য করা হলো তাকে।
এমন প্রস্থান কখনোই কাম্য হতে পারে না। সড়ক সন্ত্রাসের বলি হতে হলো গৌতমদাকে। এমন হাসিখুশি মুখ, এমন কর্মদক্ষ মানুষটিই চলে গেলেন বড্ড অসময়ে।
প্রশ্ন জাগে, আর কত প্রাণ কেড়ে নিয়ে থামবে সড়ক সন্ত্রাস? আমাদের আর কত সৃষ্টিশীল মানুষকে হারাতে হবে সড়ক নামে মৃত্যুফাঁদে?
গৌতমের জন্ম ১৯৬৮ সালের ১০মার্চ। বাবা করুনাময় রায় একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ আর মা স্বর্গীয় গীতশ্রী রায়। ভাইবোন দুজন, একমাত্র ছোট বোন কাবেরী রায় তন্দ্রা অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসি। স্ত্রী শহরের শাহহেলাল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা অপরাজিতা রায়, একমাত্র ছেলে কৃতিময় রায় অংকুরের বয়স মাত্র বারো।
মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করেন গৌতম।
তিনি ছিলেন ইনকাম ট্যাক্স প্র্যাকটিশনার(আই টি পি); পেশাগত জীবনে ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্সে কর্মরত ছিলেন।
গত ২৪ অক্টোবর মৌলভীবাজার শাহমোস্তফা সড়কে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান কল্যানময় রায় গৌতম। রিক্সা যোগে যাচ্ছিলেন বাসস্ট্যন্ডের দিকে, হঠাৎ একটি কাভার্ড ভ্যান চাপা দেয়।
এসময় সাথে ছিলেন দূর্গোপুজোয় বেড়াতে আসা তার শ্যালিকা আর শ্যালিকার ১০বছরের ছেলে। এই ছোট্ট ছেলে গৌতমদা এবং রিক্সাচালক সহ মোট তিনজন এই ঘটনায় প্রাণ হারান।
কল্যানময়ের জীবনে প্রায় পুরোটাই কেটেছে সমাজের মৌলিক কল্যানকর কাজে। ছাত্র জীবনে উত্তরণ খেলাঘর আসর এর মধ্য দিয়ে তিনি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে সমম্পৃক্ত করেন।
একসময় ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় হন। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দৈন্যতা্ তাকে ভাবিয়ে রাখতো।
মৌলভীবাজারের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কল্যানময় অবদান রেখেছেন অনেক। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য ও সংগঠক হিসেবে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন।
১৯৯২ সালে ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্সে চাকরি নেন, এবং এই দীর্ঘ সময় ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্সে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেন, তিনি জয়েন ভাইস প্রেসিডেন্ট(জে ভি পি) ছিলেন।
এমন প্রাঞ্জল কর্মদক্ষ মানুষকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ কর্মক্ষেত্রের দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা। শোক প্রকাশ করে সবাই কালো ব্যাজ ধারন করেছেন।
ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্সের হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার জোনে তিন দিনের শোক ঘোষনা ও বিভিন্ন জায়গায় তাকে স্বরণ ও শ্রদ্ধা জানিয়ে ব্যানার টাঙানোর কর্মসুচি হাতে নিয়েছেন সহকর্মীরা।
তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বার্তা দিয়েছে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, সিপিবি, যুব ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, অরুনোদয়, সরগমসহ মৌলভীবাজারের অনেক প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।
যদ্দুর জানতে পেরেছি, ব্যাটারি চালিত রিক্সাযোগে শাহমোস্তফা সড়ক হয়ে বাসস্ট্যন্ডের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। সাথে ছিলেন তাঁর শ্যালিকা ও ছোট্ট ভাস্তে। নিয়ন্ত্রনহীন গতিতে ছুটছিলো রিক্সাটি। শাহমোস্তফা সড়কের টাইটেল মাদ্রাসার সামনে এসে আর নিয়ন্ত্রন রাখতে পারেনি ব্যাটারিচালিত রিক্সার চালক। সোজা ধাক্কা দেয় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি দ্রুতগামী কাভার্ড ভ্যানকে। দু'টি বাহনের গতিই ছিলো নিয়ন্ত্রনহীন।
চালকদের নিয়ন্ত্রনহীন গতির খেসারত দিতে হলো ৩টি জীবনের বিনিময়ে। গৌতমদা, শিশু পার্থ ও চালক তিনজনই মারা পড়লেন ট্রাক চাপায়।
খুব কষ্টের সাথে বলতে ইচ্ছে হয়, রাস্তায় নিয়ন্ত্রনহীন যানবাহনগুলোর মতই নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পরছে আমাদের জীবনবোধ, চেতনা আর দ্বায়িত্বশীলতা। যে যার মতো ছুটে চলছে, অনিয়ন্ত্রিত-অপ্রতিরোধ্য প্রতিযোগিতায়। আর তার খেসারত দিচ্ছি আমরা, মূল্যবান অনেক জীবনের বিনিময়ে।
শোক আর স্মরণের মাঝেইতো তাঁকে এখন ফিরে পাওয়া! ভাবতে হয়, কেনো এতো এতো অনিয়ম আর অরাজকতা? বেডরুম, রাস্তার মোড়, পার্ক, ক্যাম্পাস, ধর্মসভা, ছোটবড় বাহন- সব জায়গায় খুন হচ্ছে মানুষ!
প্রতিটি মানুষ বেচেঁ থাকতে চায়, স্বপ্ন দেখতে চায়। কিন্তু তাদের বেচেঁ থাকতে দেয়া হচ্ছে না তাদের স্বপ্নগুলোকে হত্যা করা হচ্ছে। স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তাও নাই নিরাপদ সড়কও নাই...!
হয়তো অনেক কিছুই পাওয়ার ছিলো অপনার কাছ থেকে; সমাজ ও দেশের। অকালে ঝড়ে যাওয়া ছোট্টশিশুটিও জীবনের স্বাদ বুঝে ওঠার আগেই চিরবিদায় নিলো।
বড় অসময়ে চলে গেলেন দাদা, স্বজনরা আপনাকে বিদায় দিলেন অশ্রু দিয়ে..। যেখানেই থাকবেন, যেভাবেই থাকবেন- ভালো থাকবেন।
লেখক: সাংস্কৃতিক সংগঠক ও গণমাধ্যমকর্মী।
আপনার মন্তব্য