মোবারক হোসেন রুবেল

২৯ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:৫০

ব্লগ, ব্লগার এবং ব্লগিং নিয়ে কিছু খোলামেলা কথা

ধরেন, প্রবাস থেকে আপনার বড় ভাই মরণাপন্ন অবস্থায় ফোন দিলো আপনাকে, এই মূহুর্তে তিনি মাকে দেখতে চান। আপনি কিভাবে ভিডিও চ্যাট করতে হয় তা জানেন না। সার্চ ইঞ্জিন “গুগলে” লিখলেন – “কিভাবে ভিডিও চ্যাট করা যায়” অথবা ইংরেজিতে লিখলেন “How can I chat (video)”, অথবা আরবিতে লিখলেন “كيفية الدردشة” ব্যস মুহুর্তেই চলে আসল হাজার হাজার দিক নির্দেশনা।

মাঝরাতে ঘুম আসেনা? কবিতা পড়তে চান? জীবনানন্দ? হাদিস? সার্চ দেন “গুগলে”। আপনার পার্সপোর্ট পেতে দেরী হচ্ছে? কিভাবে তাড়াতাড়ি পেতে পারেন, পরামর্শ চান? সার্চ দেন “গুগলে”। জরুরী কাগজ পত্র হারিয়ে গিয়েছে? কিভাবে ফেরত পাবেন? সার্চ দেন “গুগলে”। অসংখ্য তথ্য নিয়ে “গুগল” আপনার সামনে হাজির। এই যে তথ্যগুলো আসে, এগুলো কী? কোথায় থেকে আসে এসব? কে রাখল ঐসব?

এই যে তথ্যগুলো পাচ্ছেন প্রতিটি একেকটি মাইক্রো ব্লগ, ব্লগ। যারা দিনকে রাত, রাতকে দিন করে, বিনা পারিশ্রমিকে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে আপনার জন্য তথ্যগুলো রেখেছেন তাদের নাম ব্লগার। যাদেরকে আপনারা শুধু 'নাস্তিক' বলেই বিবেচিত করেন।

ব্লগ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত জীবনের একটা অভিজ্ঞতা তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করলাম।

এক ভদ্রলোক একবার আমার কাছে আসছিলেন। তিনি পাসপোর্টে রিনিউ করতে চান। কোথায় কিভাবে কি করতে হবে তা তিনি জানেনা না। আমি নিজেও ততটুকু জানি না। ভদ্রলোককে বসতে বললাম, কথায় অকথায় তিনি জানতে চাইলেন আমি ব্লগার কি না। ব্লগিং করি সেই ২০০৯ সাল থেকে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্লগিং করেছি প্রায় পাঁচ শতাধিক। তাই নিজের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্যটুকু দিতে আমি লজ্জিত বোধ করলাম। মুখটা গম্ভীর করে চোখ দুটো নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম, হ্যা, আমি ব্লগিং করি, আমি ব্লগার।

তিনি আস্তাগফিরুল্লা, নাউজুবিল্লা বলতে বলতে চেয়ার থেকে উঠে গেলেন। তিনি তার নিজ গালে বেশ কয়েকবার চপেটাঘাত করতে করতে বললেন, আল্লায় মাফ করুক। ব্লগিং করে যদি আমি কোন অপরাধ করে থাকি তো মাফ চাওয়ার কথা আমার। কিন্তু তিনি কেন নিজ গালে থাপ্পর দিয়ে মাফ চাইলেন তা এখনো আমার বোধগম্য হয়নি।

কিঞ্চিত হাসিমাখা মুখে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি জানতে চেয়েছিলেন জানি? মেহেদী মাখা দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে তিনি বললেন, পাসপোর্ট রিনিউ। ওনাকে সবিনয়ে বললাম আচ্ছা আপনি বসেন, দেখি নেটে কিছু পাওয়া যায় কি না।

তিন ক্লিকের ব্যবধানে ওনাকে নেট থেকে পাসপোর্ট রিনিউ করতে যা যা দরকার তার সম্পূর্ণ তথ্য দিলাম। তিনি খুব খুশি হলেন। বারবার আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। বললাম আমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে বরং তাকে দিন।

পান খাওয়া লাল দুটো ঠোট কান পর্যন্ত বিস্তার করে হাসিমুখে বললেন, কাকে? আমার ডান হাতের তর্জনী মনিটরের দিকে লক্ষ্য করিয়া ওনাকে বললাম, যিনি কষ্ট করে আপনার জন্য তথ্যগুলো নেটে সংগ্রহ করে রেখেছিলেন ধন্যবাদটা দিন তাকে।

প্রথম শ্রেণীর নির্বোধ বালকের ন্যায় শিশুসুলভ হাসি দিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, কে সে?

জি হ্যা, ওনি একজন ব্লগার। আপনার যাদেরকে শুধু শুধু নাস্তিক বলেই জানেন। আর যে তথ্যগুলা পেলেন সেগুলোই ব্লগ। ব্লগ সম্পর্কে ওনার ধারণা কিছুটা পাল্টালো।

এবার আসি মূল প্রসঙ্গে।

ব্লগিং বিভিন্ন বিষয়ের হতে পারে। যেমন সাহিত্য, কবিতা, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, অর্থ, সংগীত, ইতিহাস, গীটার...। একজন ব্লগার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে পারেন। কেউ লিখেন কবিতা, কেউ গান, কেউ দেশ-দশ-সমাজ, কেউ লিখেন চিকিৎসা....

গত কয়েকদিন আগে “দৈনিক সুনামকণ্ঠ” পত্রিকায় আমার একটা লেখা প্রকাশ করা হয়। সেখানে লেখক পরিচয় হিসাবে উল্লেখ করা হয় “ব্লগার”। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাষ্টার্স সমাপন করুয়া একজন ভদ্রলোক আমার লেখাটা পড়লেন। মন্তব্য করলেন, সব ঠিক আছে কিন্তু পরিচয় হিসাবে ব্লগার দেওয়াটা উচিত হয়নি। কেন উচিত হয়নি তা জানতে চাইলে তিনি আমাকে মহাভারত থেকে হিমালয় পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলেন যে, ব্লগার মানেই নাস্তিক।

কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করুয়া একজন ভদ্রলোক যদি ব্লগার এর সংজ্ঞা নাস্তিক হিসাবে জ্ঞাপন করেন তবে আমাদের মতো “তিন দু গুনে ছয়টি” বই পড়ুয়া আম পাবলিক ব্লগ/ব্লগার সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষন করতেই পারি, যা অস্বাভাবিক কিছু না।

আজকাল নাস্তিক এবং ব্লগার দুটো শব্দকে অন্ধ সমাজে খুব করে সমার্থক বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। আসলেই কি তাই?

২০১৪ সালে শান্তিতে নোবেল পেলেন পাকিস্থানী নাগরিক মালালা ইউসুফ জাই। যিনি একজন ব্লগার। তিনি পাঁচ বেলা নামাজ পড়েন। তিন বেলা আহার করেন, এক বেলা ব্লগিং করেন। তাহলে তিনিও কি নাস্তিক? হিজবুত তাহরীর কমান্ডো ফারাবী সেও তো একজন ব্লগার। তাহলে কি সেও...

ধর্ম/হাদিস/কুরান নিয়ে সার্চ দিন গুগলে অসংখ্য তথ্য আসবে, যারা এইসব রাখে তারাও কি নাস্তিক?

যেহেতু ব্লগ হলো নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম। একজন ব্লগার তার নিজস্ব ব্লগে নিজস্ব অভিমত প্রকাশ করতে পারে। সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিককে দেওয়া হচ্ছে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা। পরবর্তী অর্থাৎ ৩৯(২) নং অনুচ্ছেদে দেওয়া হয়েছে ভাবপ্রকাশের অধিকার। সাংবিধানিক অধিকার বলে প্রত্যেক নাগরিক তার নিজস্ব মতামত পোষন করতে পারেন এবং কারো মতামতে যদি দ্বিমত/বহুমত তাকে তবে যুক্তির বিপক্ষে যুক্তি প্রয়োগ করা যায়। প্রয়োজনে আইনীভাবে মোকাবেলাও করা যায়।

হাঁ, আমি এটাও স্বীকার করি যে একশ্রেণীর অজ্ঞেয়বাদী ব্লগাররা বিভিন্ন ধর্মকে নিয়ে নোংরা সমালোচনা করছে এবং এটা যদি বাংলাদেশের আইনের পরিপন্থি হয় আর ব্লগারদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় তবে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন তা দেখবে এবং দেখছেও।

একশ্রেণীর ব্লগার ধর্মের পক্ষে লিখেন আর এক শ্রেণীর ব্লগার ধর্মের বিপক্ষে লিখেন। কিন্তু ব্লগ মানেই ধর্মকেন্দ্রীক কিছু নয়। ব্লগিং বিভিন্ন প্রেক্ষাপট। যারা ধর্মের পক্ষে লিখেন তারাও ব্লগার, যারা বিপক্ষে লিখেন তারাও ব্লগার। উভয়ই অবশ্য নাস্তিক নন।

গুটিকয়েক অজ্ঞেয়বাদী ব্লগারদের জন্য যদি সব ব্লগারদেরই এক লাইনে দাঁড় করিয়ে এক দড়িতে ফাঁসি চাওয়া হয়, ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়, তবে এটা অবশ্যই ব্লগ/ব্লগিং এবং ব্লগার সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতার সর্বশেষ পরিচয়।

সব ব্লগার নাস্তিক নয়, কিছু ব্লগার নাস্তিক হয়। এই কিছু ব্লগারেরা যদি কোন ধর্মকে নিয়ে কটাক্ষ করে তবে উপযুক্ত প্রমাণসহ তাদের আইনের মুখোমুখি করা যায়। তাই বলে ঢালাওভাবে সব ব্লগারদের বর্তমান সমাজে অবহেলিত করার অধিকার আমাদের কারো নেই।

মোবারক হোসেন রুবেল :  ব্লগার। 

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত