মাসকাওয়াথ আহসান

০৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০৩:১১

এ অশনি সময়ে যদি চার নেতা বেঁচে থাকতেন...

আমাদের জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমদ, ক্যপ্টেন মনসুর আলী ও মুহাম্মদ কামরুজ্জামান যদি আজ বেঁচে থাকতেন, গণজাগরণে তারুণ্যের অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষে ও ন্যায়বিচারের জন্য ঋজু অবস্থান ব্যক্ত করায় খুব খুশী হতেন। কারণ এছিলো তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তার সমানুভূতির জায়গা।

এরপর কট্টরপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলেরা একে একে হত্যা করতে থাকে গণজাগরণের ভাবনার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত তরুণ লেখকদের। কারণ মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে মেধা হত্যা করে কট্টরপন্থীরা অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিলো যে আর অনুরূপ মেধার উন্মেষ বাংলাদেশে ঘটবেনা।

আচম্বিতে একবিংশের তরুণদের মাঝে সেই একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মুক্ত চিন্তার উদ্ভাস; ভীত সন্ত্রস্ত করে ধর্মকে যারা রাজনীতিতে ব্যবহার করে সেই কট্টরপন্থীদের। একাত্তরের মতোই শুরু হয় মেধাহত্যা। স্বাধীন বাংলাদেশে এরকম ধারাবাহিক মেধাহত্যার ঘটনা এই প্রথম।

শ্রদ্ধেয় জাতীয় নেতারা এই অশনি সময়ে বেঁচে থাকলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নিজেদের নিবেদিত করতেন এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর এই চার বন্ধু কখনো অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করেননি। মানুষের জীবন-তাদের অধিকার রক্ষা; এই ছিলো তাঁদের রাজনৈতিক সক্রিয়তার গোড়ার কথা।

সম্প্রতি প্রকাশক হত্যা ও লেখক-প্রকাশক হত্যা প্রচেষ্টার প্রতিবাদে ৩ নভেম্বর হরতাল ডাকা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কিছু কর্মীকে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা যাচ্ছে; কেন জেল হত্যা দিবসে হরতাল ডাকা হয়েছে; বা কেন তারুণ্য তাদের শ্লোগানে এই সরকারকে রাজাকারের পাহারাদার বলেছে!

সাম্প্রতিক হত্যাযজ্ঞের কারণে এই নভেম্বরে শোক দ্বিগুণ হয়েছে। জাতীয় চার নেতার রাজনৈতিক দলের উত্তরসূরীরা যদি কেবল দিবসটি পালনের আনুষ্ঠানিকতাকেই নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের একমাত্র পথ ভেবে থাকেন সেটা অবশ্যই তাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা। কিন্তু জাতীয় চার নেতার ধারন করা অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক চেতনার অনুবাদ এই প্রকাশক হত্যা ও প্রকাশক লেখক হত্যা চেষ্টার প্রতিবাদে হরতাল।

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়; তখন দেশের মানুষ একটু স্বস্তিতে বাঁচতে চেয়েছিলো। কিন্তু তা যখন হলোনা; ধারাবাহিক হত্যাকান্ডের কোনটিরই তদন্ত একটি ফলদায়ক গন্তব্যে পৌঁছুলো না, সরকার অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলো; তখন দিনের পর দিন স্বজনের লাশ কাঁধে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বিক্ষুব্ধ তারুণ্যের মনে প্রশ্ন জাগলো, কেন আওয়ামী লীগ সরকার ৭ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকেও ধর্ম-ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলো না! তাহলে কী সরকারের মধ্যে এদের পাহারাদার আছে!

যেসমস্ত দেশে এইরকম ধর্মব্যবসায়ী খুনীদের অভয়ারণ্য তৈরী হয়েছে; সেইসমস্ত দেশে খুনীদের প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন পাহারাদার হিসেবে সরকার কাজ করেছে; ইতিহাস তার সাক্ষী।

এই বাস্তবতায় সরকারের প্রতি তারুণ্য যদি বিক্ষোভ প্রকাশ করে থাকে; তাকে অযৌক্তিক বা ষড়যন্ত্রমূলক বলে উড়িয়ে দেবার কারণ নেই।

আওয়ামী লীগের কর্মী হলেই তারা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মনোপলি অর্জন করেছেন তা তো নয়। চার নেতা-অনুভূতির চেয়ে বেশী জরুরী চার নেতার জীবন ও সমাজ-রাজনৈতিক সুচেতনাকে ধারন করা।

কী সেই সুচেতনা? একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ; যেখানে সব বিশ্বাসের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকবে; মেধার উতকর্ষ সাধিত হবে; সভ্যতার আলোকস্নাত হবে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগের কর্মী হওয়া মানে আওয়ামী লীগ অনুভূতি থাকা; আর আওয়ামী লীগের আদর্শকে আত্মস্থ করা মানে অসাম্প্রদায়িক সাম্যভাবনার প্রতি ঋজু অঙ্গীকার।

কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে নিরাপোষ অবস্থান সুস্পষ্ট করা। সেইখানে আওয়ামী লীগের পরিচয়ে যারা অনলাইনে এসে মানুষের প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নিতে ষড়যন্ত্রসূত্রের পাতকূয়ায় ফেলে দিতে চান প্রতিবাদকারীদের; তারা স্পষ্টতই এই ধারাবাহিক মেধা হত্যাকারীদের সমর্থক-পৃষ্ঠপোষক-পাহারাদার।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এই এপোলজিস্টদেরকেই রাজাকার বলা হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত