রনেন সরকার রনি

০৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:৪৫

ঘটনাবহুল ৭ নভেম্বর: একটি প্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা

আর দশটা রাতের মতই আরও একটি রাত নামে ঢাকা শহরে। ঘড়ির কাঁটা মধ্য রাত পেরিয়ে পৌঁছে যায় ৭ নভেম্বরে। শহরের উপর দিয়ে বয়ে যায় নভেম্বরের ঠান্ডা হাওয়া। লেপের নিচে গা ঢাকে ঢাকা শহরের কর্মব্যস্ত মানুষ। তারা জানে না আর কিছুক্ষন পরেই শুরু হবে এক রক্তপাতহীন সিপাহী বিপ্লব। আশ্চর্য কাকতালীয় ব্যাপারই বটে। মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার চুড়ান্ত বিপ্লবটি ঘটেছিল এই ৭ নভেম্বর।

লেনিনও এমন এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষনে পৌঁছেছিলেন। বলেছিলেন, বিপ্লবের জন্য ৬ তারিখ বেশি আগে হয়ে যাবে, ৮ তারিখ হবে বেশি দেরি; বিপ্লব ঘটাতে হবে ৭ তারিখেই। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর সেই অদ্ভুত সন্ধিক্ষন এসেছে বাংলাদেশের বুকেও। যুদ্ধাহত, ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটা এক কর্ণেলকেও বলতে হয়েছিল Now or never.

নানা পথ ঘুরে দেশের এক চরম ক্রান্তিকালে দেশের ইতিহাসের ঘুড়ির নাটাই এসে পড়ে কর্ণেল আবু তাহেরের হাতে। অপ্রত্যাশিত এক পরিস্থিতিতে চুড়ান্ত এক সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাকে। শান্ত কন্ঠে নেতাদেরকে তিনি বুঝাতে চেষ্ঠা করেন ‘অভ্যুত্থান ঘটাতেই হবে এবং তা কালকেই। অভ্যুত্থান যারা করবে তারা প্রস্তুত। ঘটনার গতিপথকে এখন আমাদের ফলো করতেই হবে। আমরা এমন একটা সন্ধিক্ষনে এসে পৌঁছেছি যে, This has to be now or never. কাল মধ্য রাতের পরই অর্থাৎ সাতই নভেম্বর আমি অভ্যুত্থানটি ঘটাতে চাই’।

খানিকটা বিহ্বল তাহের। ঠান্ডা মাথায় পুরো অভ্যুত্থানের ছকটি তৈরি করেন তিনি। অভ্যুত্থানের দুটি পর্ব: একটি সামরিক অন্যটি বেসামরিক। সিদ্ধান্ত হয়েছে তাহের তার নেতৃত্বে ক্যান্টনমেন্টে অভ্যুত্থানের সামরিক পর্বটি সফল করবার পর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বেসামরিক পর্বে শামিল করবেন শ্রমিক-ছাত্র-সাধারন জনগণকে। কর্নেল তাহের সামরিক পর্বটি সফল করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু বেসামরিক পর্বটির প্রস্তুতিতে দেখা দেয় নানা অনিশ্চয়তা। রহস্যময় মানুষ চিন্তাগুরু দাদা সিরাজুল আলম খান তাহেরকে মাঠে নামিয়ে দিয়ে চলে যান অজ্ঞাত স্থলে।

ড. আখলাক যিনি বরাবরই এই অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করে এসেছেন, তিনি আশ্রয় নেন এক পীরের দরগায়। ফলে অভ্যুত্থানের প্রথম সারির প্রথম মানুষটি তখন তাহের। গুলশানের এক বাসায় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের সাথে চুড়ান্ত মিটিংয়ে বসেন তিনি। সৈনিকদের বুঝিয়ে বলেন, ‘দেশের একটা সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে জনজীবনে শৃঙ্খলা আনবার জন্য সেনাবাহিনী এবং জনগন দুই পক্ষ মিলে এই অভ্যুত্থান ঘটাতে যাচ্ছে। এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকবে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। জীবন বাঁচানোর অনিবার্য প্রয়োজন ছাড়া কাউকে গুলি করা যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘খালেদ মোশারফকে গ্রেপ্তার করা হবে এবং জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে আমার কাছে নিয়ে আসার উপরই নির্ভর করবে অভ্যুত্থানের সাফল্য। সুতরাং খুব সতর্কতার সাথে কাজ করতে হবে।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাম পা হারানো ১১নং সেক্টরের কমান্ডার ক্রাচে শব্দ তুলে পথচলা কর্নেল তাহেরের নির্দেশে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার শত শত সৈনিক যখন চরম উত্তেজনায় এগিয়ে যেতে থাকে আর্মি হেড কোয়ার্টারের দিকে, তাহের তখন আবু ইউসুফের এলিফেন্ট রোডের বাসায়। বারান্দায় আধো অন্ধকারে অধীর আগ্রহে বসে আছেন প্রথম ফায়ার ওপেন হবার শব্দ শোনার জন্য। গভীর চিন্তিত মুখ তাঁর। ক্যান্টনমেন্ট থেকে এলিফেন্ট রোড বেশ খানিকটা দূরে, তবুও আশা করছেন ফায়ার শুরু হলে রাতের নীরবতায় হয়ত শোনা যাবে সে শব্দ।

২.

ভয়ঙ্কর এক ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে যে ঘটনার শুরু তাহের তার যবনিকা টানতে চাইছেন রক্তপাতহীন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। ১৫ আগষ্ট বাংলাদেশের নানা প্রান্তের মানুষের ঘুম ভাঙ্গে রেডিওর ঘোষনায় : ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। জননেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে এবং সারা দেশে কারফিউ জারী করা হয়েছে।’ দেশ জুড়ে এক গাঢ় নিস্তব্ধতা নেমে আসে। শেখ মুজিবের মৃত্যুর খবর পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত ভোর বেলা দ্রুত পায়ে হেঁটে রওনা দেন কাছাকাছি উপ সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায়। উত্তেজিত হয়ে দরজা ধাক্কান তিনি। বেরিয়ে আসেন জেনারেল জিয়া। তাঁর গায়ে স্লিপিং ড্রেস এবং এক গালে শেভিং ক্রিম লাগানো। শাফায়াত উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলেন President is killed. কিন্তু জিয়াকে মোটেও বিচলিত মনে হয় না। তিনি শান্ত কন্ঠে বলেন, President is killed so what? Vice-president is there.

বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু যেন নেহাত একটা দাপ্তরিক ব্যাপার।

জীবিত শেখ মুজিবের সবচাইতে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিল জাসদ। জাসদের রয়েছে ব্যাপক গণসমর্থন। ইতিহাসের মোড় ঘোরবার ঐ ঊষালগ্নেই মোশতাক তাই প্রথম স্মরণ করেন তাহেরকে। খন্দকার মোশতাক তখন রেডিও স্টেশনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণদানের। ক্রাচে ভর দিয়ে বড় বড় পা ফেলে তাহের দ্রুত ঢোকেন রেডিও স্টেশনে। খন্দকার মোশতাক, মেজর রশীদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর বোঝাবার চেষ্টা করেন তাহেরকে। তিনি চুপ করে শুনেন সবার কথা। তারপর ক্রাচটি হাতে নিয়ে উঠে পরেন তিনি চেয়ার থেকে। তিনজনের দিকে চোখ বুলিয়ে বলেন: ‘আপনারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছেন। জনগন মুজিবকে নির্বাচিত করেছে কেবল জনগনেরই অধিকার আছে তাকে উৎখাত করার। তাঁকে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। আর কোন কন্সপিরেন্সি করবার চেষ্টা করবেন না।’

এই বলে ক্রাচে ঠক ঠক শব্দ তুলে বেরিয়ে যান তাহের। সাথে হাসানুল হক ইনু এবং ছোট ভাই আনোয়ার।

গ্রামের মুদির দোকানের একটি সস্তা সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় কবর দেওয়া হয়েছে শেখ মুজিবকে। যে মানুষটির সভায় লোক সমাগম হয়েছিল দশ লক্ষ, তার জানাজায় দেখা যায় গোটা দশ ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ। বাতাসে তখনও অনিশ্চয়তা, ভয়, উদ্বিগ্নতার আভাস। খন্দকার মোশতাক টের পান যত দ্রুত সম্ভব নিজের অবস্থানকে নিরাপদ করা প্রয়োজন। নতুন সেনা প্রধান হিসাবে তিনি নির্বাচিত করেন জেনারেল জিয়াকে। সপ্তাহ না যেতেই তাঁকে স্বীকৃতি জানায় আমেরিকা, সৌদি আরব, এবং চীন। পর পর আসে পাকিস্তানেরও অভিনন্দন। সমর্থন জানিয়ে বসেন মাওলানা ভাসানী এবং পিকিং পন্থী বামরাও। ধীরে ধীরে উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করে ইতিহাসের চাকা। কেবল বাগে আসছে না জাসদ। তারা দাঁড়িয়েছেন পুরো পরিস্থিতির বিপক্ষে। সারা দেশে মোশতাক বিরোধী মিছিল করছে জাসদ। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা তো বটেই, পাশাপাশি গণবাহিনীকেও চাঙ্গা করে তুলেছে। জাসদ কর্মীদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশ দেন মোশতাক। গণহারে গ্রেফতার করা হতে থাকে হাজার হাজার জাসদ কর্মীদের। খন্দকার মোশতাক যখন জাসদ কর্মীদের সায়েস্তা করার কাজে ব্যস্ত তখন ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিলকে নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ। ঘটনা পরম্পরায় মোশারফের নির্দেশে বন্দি করা হয় সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে।

৩.

পরিস্থিতির বিপদ বিবেচনা করে জিয়া সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। কর্নেল তাহের ভেবেছিলেন জেনারেল জিয়া চিফ হওয়াতে ভালই হয়েছে। তিনি মোশতাকের সাথে আছেন ঠিকই, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা পজেটিভ কিছু করতে পারলে তিনি হয়ত চলে আসবেন। তাঁর চিফ হওয়ার স্বপ্ন ছিল, সেটা পূরণ হয়েছে। তাহের সঙ্গীদের নিয়ে বাড়িয়ে দেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কাজের গতি। তাহের সৈনিক সংস্থার সদস্যদের বোঝাতে থাকেন, ‘কোন সংকীর্ণ স্বার্থে কোন পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। শুধু ক্ষমতা দখল করলেইতো হবে না। ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে হবে।’ কিন্তু দ্রুত বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট।

সেনাপ্রধান মেজর জিয়াকে বন্দি করে খালেদ মোশাররফ জড়িয়ে পড়েন বঙ্গভবনের সাথে টেলিফোন যুদ্ধে। এরই মধ্যে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘটে যায় আরও একটি নারকীয় হত্যাকান্ড। জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ঘটনা, দুর্ঘটনা, অতি ঘটনার এক আশ্চর্য সময় পার করছে তখন বাংলাদেশ। মূহূর্ত, ঘন্টা, দিনের মধ্যে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। যেন প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে নতুন এক একটি ইতিহাস। খালেদ মোশাররফের অনুগত অফিসাররা গৃহবন্দি জিয়ার ড্রইং রুমের টেলিফোন বিছিন্ন করলেও শোবার ঘরের ফোনটির লাইন খোলা ছিল।

রাত প্রায় ৪টার সময় সন্তর্পনে জিয়া ডায়াল করেন একটি নাম্বারে। নাম্বারটি কর্নেল তাহেরের। গ্যাস্টিকের ব্যাথায় ঘুম হচ্ছিলনা তাহেরের।

টেলিফোনের শব্দে জেগে উঠেন তিনি। জিয়া নিচুস্বরে বলেন: ‘তাহের I am in danger, save my life’. ফোন লাইনটি কেটে যায়।

খন্দকার মোশতাক আর খালেদ মোশাররফ তখন নাগর দোলায়। একজন উঠছেন, একজন নামছেন। কিন্তু তারা কেউ জানেন না ঠিক সেই সময়টিতেই তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে, শহরের অন্য এক প্রান্তে। তাহেরের ভাই আবু ইউসুফের এলিফেন্ট রোডের ৩৩৬ নম্বর বাসাটি তখন সরগরম। দফায় দফায় মিটিং হচ্ছে, জটলা করছেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা। জাসদ এবার তার সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে মোকাবেলা করতে চায় এ পরিস্থিতি। আর তাদের প্রধান শক্তি তখন গণবাহিনী ও সৈনিক সংস্থা। দু’টি সংগঠনেরই কমান্ডার ইন চিফ তাহের। নেতৃবৃন্দ খানিকটা দ্বিধান্বিত থাকলেও তাহেরের আত্ম প্রত্যয় প্রভাবিত করে তাদের। ফলে তারা সমর্থন করেন তাহেরকে। বিপ্লবী অভ্যুত্থানের দিনক্ষন ঠিক হয় ৭ নভেম্বর প্রথম প্রহর।

এলিফেন্ট রোডের আবু ইউসুফের বাসার বারান্দায় আধো অন্ধকারে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানের সর্বাধিনায়ক কর্নেল আবু তাহের। প্রথম ফায়ারটি ওপেন করার কথা ঠিক ১২টায় নায়েব সুবেদার মাহবুবের। সময় গড়িয়ে যায় কিন্তু ফায়ারের শব্দ শোনা যায় না। চিন্তিত হয়ে পড়েন কর্ণেল তাহের। রাত ১২টা ৩০ মিনিটে প্রথম ফায়ার ওপেন হয়। সারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে হাজার হাজার বুলেট ছুটে যেতে থাকে আকাশে। চারদিকে স্লোগান 'সিপাই জনতা ভাই ভাই, সিপাই বিপ্লব লাল সালাম', 'কর্নেল তাহের লাল সালাম, জেনারেল জিয়া লাল সালাম'।

ইউসুফের বাড়ির টেলিফোনে কল আসতে থাকে। একের পর এক অভ্যুত্থানের টার্গেট অর্জিত হচ্ছে বলে আনন্দিত হয়ে উঠেন তাহের।

হাবিলদার হাইয়ের দায়িত্বে মুুক্ত করা হয় জেনারেল জিয়াকে। কিন্তু তিনি তাহেরের কথা মত ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যেতে রাজি হলেন না। খবর পেয়ে তাহের নিজেই ছুটে গেলেন ক্যান্টনমেন্টে।

৪.

চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে আসেন জিয়া। কোলাকুলি করেন তাহেরের সঙ্গে। বলেন: তাহের You save my life. Thank you so much. জিয়া যতই তাহেরকে ধন্যবাদ জানান, তার পরিকল্পনা মতো জিয়া বাইরে না যাওয়াতে তিনি খানিকটা বিরক্ত। জেনারেল জিয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে না আসার ঘটনার এই ছোট্ট মোচড় বস্তুত বদলে দেয় বাংলাদেশের পরবর্তী ইতিহাস।

মাঝ রাতে অভ্যুত্থান শুরু হয়ে ভোর হয়েছে। কিন্তু বাতাসের বেগে এগিয়ে যাচ্ছে ঘটনা প্রবাহ। তাহের টের পান মাছ ফসকে গেছে হাত থেকে। কথা ছিল জিয়া আর তাহের এসে উন্মুক্ত জনসভায় বক্তৃতা দেবেন। সিপাই-জনতা সম্মিলিতভাবে ডাক দেবেন বিপ্লবের। গঠন করা হবে অন্তবর্তীকালীন সরকার। কিন্তু কিছুই ঘটেনি। জিয়া রয়ে গেছেন ক্যান্টনমেন্ট, তাহের তার ক্রাচে ভর করে ছোটাছুটি করছেন ক্যান্টনমেন্টে, এলিফেন্ট রোড, রেডিও স্টেশন।

উপ মহাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় এ সিপাহী অভ্যূত্থান ঘটবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেটিকে বানচাল করে দেবার জন্য তৎপর হয়ে উঠে দুটি শক্তি, একদিকে জেনারেল জিয়া, আরেক দিকে খন্দকার মোশতাক। আর এই বিপরীতমুখী স্রোতের তোড়ে উজান ঠেলে একজন পঙ্গু মানুষ ক্রাচে ভর দিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়।

চীনাপন্থী বাম নেতারা তাহেরের এই তৎপরতাকে বলেন ভারতীয় উস্কানী। কেউ কেউ বলেন: পেটি বুর্জুয়া হঠকারিতা, রোমান্টিকতা।

ক্রোধ, আক্রোশ আর খানিকটা অসহায়তা যেন ঘিরে ধরে তাহেরকে। যে লোকটির সঙ্গে তেলাঢালায় মুক্তিযুদ্ধ কেম্পে বহুদিন চা খেতে খেতে গল্প করেছেন এক সাথে, বাড়ির লনে বসে দেশের ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলেছেন, মাঝরাতে ফোন করে যে লোকটি তার কাছে জীবন রক্ষার অনুরোধ জানিয়েছেন, তার সাথে একবার সরাসরি কথা বলার ইচ্ছা হয় তাহেরের। কিন্তু জেনারেল জিয়া তখন কোন ব্যক্তি নন, জিয়া তখন একটি রাষ্ট্র।

তাহের এগিয়ে যেতে থাকেন সামনে, তাঁর নিয়তির দিকে। ঘটন-অঘটনের নানা আঁকা-বাঁকা পথ পেড়িয়ে সময় এসে থেমে যায় ছিয়াত্তরের ২১ জুলাই। রাত ৪টা ১ মিনিটে নিভে যায় সিপাই জনতার অভ্যুত্থানের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল তাহেরের জীবন প্রদীপ। সেই সাথে নিভে যায় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দুর্লভ স্বপ্নও। থেকে যায় কিছু বিভ্রান্তি।

কে ঘটনাবহুল ৭ নভেম্বরের নায়ক কিংবা খলনায়ক। জিয়া, তাহের মোশতাক নাকি খালেদ মোশাররফ!

 

লেখক : রনেন সরকার রনি, রাজনৈতিক কর্মী

আপনার মন্তব্য

আলোচিত