সাগর কান্তি দেব

১৪ নভেম্বর, ২০১৫ ২২:৪৬

প্রিয় পারীর বুকে অন্ধকার রাত

কাল রাত থেকে সাহস সাহস করে যাচ্ছি, সবাইকে বুঝানো গেলেও নিজেকে বুঝানো সব থেকে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। খেলা দেখতে যাবার কথা ছিলো ফ্রান্স- জার্মানির, কিন্তু এই সেই করতে করতে আমিই দেরি করে ফেলায়, বাদ বাকি দুজন আমাকে ফোন ঝাড়ি দেয়, খেলা দেখা বাদ দিতে হলো। আরেকজনের ঘরে দাওয়াত ছিল,  ঘর থেকে বেরুতে ইচ্ছে করছে না বলে তাকেও না করে দিলাম। রাত তখন সাড়ে দশটা, বাইরে অনবরত পুপু করে সাইরেন বাজিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, আমার বেখেয়ালি কান এইসব তেমন খেয়াল করে না।

দুই বন্ধুকে বিদায় দিয়েই ফেইসবুকে ঢুকে দেখলাম ২৬ জন মারা গেছেন। এক ঘণ্টার মাথায় সেই সংখ্যা ১৪০ ছাড়িয়ে গেলো, মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম অনবরত এম্বুলেন্স যাচ্ছে আসছে। রিপাবলিক থেকে প্রায় দেড় কিলো মিটার দূরে থাকি আমি, সুতরাং কান পাতলে গুলির শব্দ শোনা যাবে দূরত্ব। আস্তে আস্তে সবাই সেইফ জোনে কিনা দেখা শুরু করলাম। নন্দন কাজে, কাদেঁ নামক জায়গায়, হোটেল এর পুরো সামনের টুকুন কাঁচের জানালা, গুলি শুরু হলে দৌড়ে লুকানোর জায়গা নেই। সে বললো সকল ক্লায়েন্ট নাকি বোতল হাতে রুমে যাচ্ছে যেনো এই শেষ রাত! তাকে সাহস দেয়ার কিছু খুঁজে না পেয়ে সকালে যেনো ঘরে ফিরতে পারে সেই কামনা নিয়েই লিমন কে ফোন দিলাম। ফোন ধরলো না, ফেইসবুকে ম্যাসেজ দিল তার হোটেলের একজন ক্লায়েন্ট মারা গেছে।

এক মহিলা সারা গায়ে রক্ত নিয়ে দৌড়ে হোটেল এ ঢুকছে, সে হতভম্ব হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। জানে না কি করা উচিত, কি করবে। আজ সকালে ফোন করে জানলাম আজকে রাতেও সে কাজে যাবে, কারণ যার কাজ ছিলো সেই লোকটা আরবি, ঘর থেকে বের হয়ে বউ বাচ্চা রেখে কাজে আসতে ভয় পাচ্ছে। এই অবস্থায় কেউ একজনকে তো কাজ করতেই হবে। আমার কাজের জায়গায় ফোন করে সবার খোঁজ নিয়ে বললাম রাতে ঘুমোই নি কাজে আসবো না। ডিরেক্ট্রিস ফোন করে বললো সুখবর আমরা বেঁচে আছি! কাজে যাবার দরকার নেই। দেখা যাক কি হয়! যে বিল্ডিং এ থাকি সেখানে ৪১ জন মানুষের বাস, চোখে চোখে দেখা হয় যে কজনের তাদের দেখতে গেলাম একটু আগে, সবাই যার যার ঘরে বসে আছে। এদের অনুভূতি জগত আমাদের থেকে ভিন্ন, একজন গান শুনছে আরেক জন চুলে শ্যাম্পু করছে! কাল একি হলো বলাতে সবাই হা হুতাশ করলো, একজন নিচে গিয়ে দেখে এসেছে, মানুষ জন তেমন নেই, অন্যদিনের তুলনায় ১০ শতাংশ মানুষ রাস্তায় আছে। নেটে বসে ছবি দেখছি, রিপাবলিকে মানুষ গোল জড়ো হয়ে বলছে আমরা ভয় পাইনি, জরুরী অবস্থা জারী।  
 
এই শিরোনামে একটা ছবি দেখলাম, সাহস ফিরে এলো, প্যারিসবাসী আহত দের রক্ত দিতে এই ভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। বিবিসিতে শেষ খবর মোতাবেক ৩০০ আহত মানুষ হাসপাতালে আছে, ৮০ জন গুরুতর অবস্থায়, ১৭৭ জন শংকামুক্ত, ৫৩ জন কে ডিসচার্জ করা হয়েছে। বাতাক্লান কনসার্ট হলের নিহতরা প্রধানত টিএনেজ, কিশোর কিশোরী।

প্রতিদিন লাখ লাখ দর্শনার্থীতে ঘেরা প্যারিস নগরী আজ শূন্য। তবু আমরা হয়তো সব সামলে উঠবো। ইউরোর রেট ৮৪ তে নেমে এসেছে। আরো নামবে হয়তো। হত্যা  কারা চালালো তা নিয়ে কথা বলার আসলে কিছু খুঁজে পাচ্ছি না, টুইট এ যখন একটা কথা দেখলাম ফ্রেঞ্চ ব্লাড অয়াজ সো টেস্টি ইয়ামী, আমেরিকান ব্লাড শুড মোর টেস্টি!  বমি চলে আসলো, আর কিছু ভাবতে পারলাম না।
আমরা কোথা যাচ্ছি ? কাদের হাতে যাচ্ছি? এতো কিছুর পরেও কি স্বপ্ন দেখবো না? বাঁচার? বাঁচানোর?  


[লেখক: প্যারিস প্রবাসী বাংলাদেশি সংস্কৃতিকর্মী]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত