রেজা ঘটক

২০ নভেম্বর, ২০১৫ ১৭:১৮

‘ঢাকা লিট ফেস্ট’ নতুন মোড়কে নতুন মালিকানার পুরাতন ‘হে ফেস্টিভাল’

‘ঢাকা লিট ফেস্ট’ নিয়ে লেখার আগে একটু পেছন ফিরে তাকাতে চাই।

২০১১ সালে ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলে প্রথম বারের মত অনুষ্ঠিত হয় 'ঢাকা হে ফেস্টিভাল'। যার আয়োজক ছিল যাত্রিক নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আর পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল দ্য ডেইলি স্টার ও ব্রিটিশ কাউন্সিল। সেটি প্রথম বার হওয়ায় 'হে ফেস্টিভালের' মোটিভ তখন ঠিকমত বোঝা যায়নি। তারপর ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে যখন বাংলা একাডেমি চত্বরে 'হে ফেস্টিভাল' অনুষ্ঠিত হয়, তখন এ ফেস্টিভালের উদ্দেশ্য এবং এর কর্পোরেট চরিত্রটি সবার কাছে ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হয়।

গত বছর বাংলা একাডেমিতে 'কল্পনায় বিশ্ব' নামে ২৫ বছর পূর্তি উৎসব পালন করে হে ফেস্টিভাল। সেই উৎসবেরও আয়োজক ছিল যাত্রিক। আর পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল দ্য ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, এবি ব্যাংকসহ অন্তত ৩৭টি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। বাংলা একাডেমি তখন নিজেদের গা বাঁচাতে বলেছিল, একাডেমি কেবল অনুষ্ঠানের জন্য চত্বর ভাড়া দিয়েছে।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক জনাব শামসুজ্জামান খান তখন তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, এমন একটি উৎসব আমাদের দেশের লেখক, প্রকাশক ও অনুবাদকদের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হবার দ্বার উন্মোচন করবে। এরকম উৎসব বিক্রম শেঠ, কামিলা শামসির মত আন্তর্জাতিক লেখকদের খুব কাছ থেকে দেখার ও তাঁদের কথা শোনার সুযোগ করে দেয়। যে কারণে বাংলা একাডেমি ভবিষ্যতেও এরকম উৎসব আয়োজনে আগ্রহী।

জ্বি হ্যাঁ, তিনি কথা রেখেছেন বটে। ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পরপর চারবার ঢাকায় 'হে ফেস্টিভাল' আয়োজনের পর (যার মধ্যে তিনবার ছিল বাংলা একাডেমি চত্বরে) এবার পঞ্চম বারে সেই 'হে ফেস্টিভাল' চূড়ান্ত ব্যর্থতাকে আড়াল করতে নাম বদল করে এবার আবার 'ঢাকা লিট ফেস্ট' নামে নতুন মোড়কে আবির্ভূত হয়েছে।

১৯ থেকে ২১ নভেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত বাংলা একাডেমি চত্বরে এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে 'হে ফেস্টিভাল' থেকে নামবদল করা 'ঢাকা লিট ফেস্ট'। এবার শুধু কেবল নামবদলই হয়নি, অনেকটা দখলদারিত্বেরও বদল ঘটেছে। আগের চারবার 'হে ফেস্টিভালের' একক দৌরাত্ম্য ছিল ডেইলি স্টার-প্রথম আলোর কাছে। সেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম তনয়া তাহমিমা আনাম। এবার কেন্দ্রীয় চরিত্রে কাজীপুত্র কাজী আনিস। আর 'ঢাকা লিট ফেস্ট' এর এবারের একক দৌরাত্ম্য ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা দৈনিক বাংলা ট্রিবিউন।

আরো মজার ব্যাপার হলো, হে ফেস্টিভাল এবার নামবদল করেই শুধু ধোকা দিতে চায়নি, বরং এবার তারা স্বয়ং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে এর অংশীদার করেছে। সেনা অভ্যুত্থানের পর কোনো দেশে যেমন রাষ্ট্রীয় সকল বিষয়ে কিছু কিছু আবশ্যক পরিবর্তন দেখা যায়, অনেকটা তেমন একটা নতুন চেহারায় সেই হে ফেস্টিভালই এবার 'ঢাকা লিট ফেস্ট' নাম নিয়ে নতুন করে কর্পোরেট সাহিত্যের তকমা উচ্চারণ করতে এসেছে এবার।

বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বিদেশি সাহিত্য বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়ের যে ব্যাপারটি সবসময় এরা মুখে উচ্চারণ করেন, বাস্তবে এটি দেশীয় এলিট গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের যারা ইংরেজিতে বা বাংলিশ সাহিত্য চর্চা করেন, তাদের একটি প্ল্যাটফরম। বাংলা একাডেমি বারবার এটাকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যের যোগাযোগ স্থাপনের কথা বললেও সেটি ডাহা মিথ্যা কথা।

হে ফেস্টিভাল বা ঢাকা লিট ফেস্ট মোটেও বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করে না। বরং এটি বাংলাদেশের বড়লোক পাড়ার ইংরেজি চর্চা করা এলিটদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজিতে লেখাকে (সাহিত্য!) কর্পোরেট স্পন্সরের মাধ্যমে তুলে ধরার একটি চক্রান্ত। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে 'হে ফেস্টিভাল বা ঢাকা লিট ফেস্ট'-এর কোনো ধরনের সম্পর্ক নাই। এমন কি এই উৎসব বাংলা সাহিত্যের কোনো উপকারও করছে না। যদি এই উৎসব থেকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের বক্তব্য অনুযায়ী, দেশের লেখক, প্রকাশক ও অনুবাদকদের আন্তর্জাতিক খ্যাতি বা পরিচিতি আনার ব্যাপার থাকতো, তাহলে বিগত পাঁচ বছরে অন্তত বাংলা সাহিত্যের বেশ কিছু বিখ্যাত বই আমরা ইতোমধ্যে ইংরেজি ভাষায় পেতাম। বাস্তবে বাটি চালান দিয়েও তা পাবার কোনো সুযোগ নাই।

এবার কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনায় আসি। আমার খুব স্নেহের এক ছোট ভাই (কবি ও সাংবাদিক)-এর সঙ্গে অক্টোবর মাসে পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে দেখা। সে আমাকে বললো, নভেম্বর মাসে হে ফেস্টিভালে এবার ভিএস নাইপল আসছেন। আমি তাঁর ইন্টারভিউ করার প্রস্তুতি নিতাছি। গত তিন মাস আমি নাইপলের বই পড়ে মোটামুটি একটা প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছি। দোয়া কইরেন দাদা। সেখানে উপস্থিত একজন বিখ্যাত প্রকাশক আমাকে ফোঁড়ন কেটে তখন শোনালেন, হে ফেস্টিভালের আপনারা যারা বিদ্রোহী গ্রুপ, এবার তো আপনাগো নেতাই অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। তো আপনারা এবার কী করবেন?

প্রকাশক সাহেবের কথায় আমি একটু অবাক হয়ে শুধু হাসলাম। দুনিয়ায় কত কিছুই না সম্ভব। এতে আর অবাক হবার কী আছে! আর আমার কবি বন্ধুকে বললাম, ভিএস নাইপল না আসলেও তোর যে এই উপলক্ষ্যে তাঁর সাহিত্য পড়া হইতেছে, এইটা একটা কাজের কাজ হইতাছে। পরে সে আমাকে জানালো, দাদা, মজার আরো ঘটনা আছে। এবার প্রথম আলো আর মাতুব্বরি করতে পারতাছে না। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? জবাবে সে জানালো, প্রথম আলোর এক কর্তার লগে তাহমিমা আনামের বিশাল বিতণ্ডা হইছে। আবারো জিজ্ঞেস করলাম, তাইলে কী ছোটখাটো একটা অভ্যুত্থান হইলো নাকি রে? জবাবে ও হেসে বলেছিল, শুধু অভ্যুত্থান না, দেখো না জল কোথায় গিয়ে গড়ায়!

ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো'র ক্ষমতা থেকে হে ফেস্টিভাল বাগিয়ে গিয়ে এখন নতুন তুঘলকি পেয়েছেন ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউন। আর মাহফুজ আনাম তনয়া থেকে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা এখন কাজী আনিসের হাতে। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই বঙ্গভূমি! কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ছিনিয়ে নেওয়া ক্ষমতার দাপটে তো মনে হইল ফেস্টিভাল আগের চেয়েও আরো ফল করছে!! নইলে বাজারে এই নিয়ে আরো উচ্চবাচ্য শুনতাম!

লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, নোবেল লরেট ভিএস নাইপল এবারের ফেস্টিভালে না আসলেও একজন নোবেল লরেট কিন্তু সতিই এসেছেন। হ্যারোল্ড ইলিয়ট ভার্মাস একজন নোবেল লরেট। আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে কর্পোরেট ও এলিটদের রুচি আর পছন্দের সত্যিই তারিফ করতে হয় বটে! আহা একজন নোবেল লরেটকে স্বয়ং যে ফেস্টিভালে হাজির করা হয়েছে, তা নিয়ে আবার আমরা কেন আল্হাদে গদগদ হচ্ছি না? হইনি যে কারণে তা হলো, হ্যারোল্ড ইলিয়ট ভার্মাস নামে কেউ কোনোদিন সাহিত্যে নোবেল পাননি। যতদূর জানি, হ্যারোল্ড ইলিয়ট ভার্মাস একজন মার্কিন ইহুদি বিজ্ঞানী। যিনি ১৯৮৯ সালে চিকিৎসা শাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বর্তমান ওবামা প্রশাসনের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি'র অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের তিনি একজন উপদেষ্টা এবং মার্কিন ন্যাশনাল ক্যন্সার ইন্সটিটিউটের তিনি বর্তমান পরিচালক।

এবার প্রিয় পাঠক, আপনারাই বলুন, 'ঢাকা লিট ফেস্ট'-এ ভিএস নাইপলের মত একজন সাহিত্যিককে না আনতে পেরে ওনারা কিনা নিয়ে এসেছেন একজন নোবেল লরেট বিজ্ঞানীকে! আহা সাধু সাধু। বাংলা সাহিত্য এবার 'ঢাকা লিট ফেস্ট'-এর হাত ধরে গোটা বিশ্বের সাহিত্য সমাজকে মাত করে, সুদূর আমেরিকার বিজ্ঞানীপাড়াও জয় করতে চলেছে। সবাই বলেন, মাভৈ মাভৈ!!

এবার হয়তো আরেক দল কান চুলকে বলবেন, কেন নয়নতারা সায়গল এসেছে না? উনি কী বড় সাহিত্যিক নন? জবাবে কী বলব বুঝতেছি না। হ্যা, সত্যি বলতে কী ওনার নাম আমি আজই প্রথম শুনলাম। একটু খোঁজ নিয়ে জানলাম, উনি ভারতের একজন ইংরেজিতে লেখা সাহিত্যিক। তারচেয়েও বড় কথা উনি ভারতের এলিট ক্লাসের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করেন। মোটেও ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের নয়। ওনার সাহিত্যিক পরিচয়ের চেয়ে বড় পরিচয় উনি জওহরলাল নেহেরুর বোন বিজয়া লক্ষী পণ্ডিতের তনয়া। স্বয়ং গান্ধী পরিবারের মেয়ে। যদিও উনি 'রিচ লাইক আস' যার বাংলা করা যায় 'আমাদের মত ধনী' বইটির জন্য ১৯৮৬ সালে ভারতের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু তখন ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন তাঁর মামা-মামীর মেয়ের ঘরের নাতী মানে আপন মামাতো বোনের ছেলে, সম্পর্কে ভাইপো রাজীব গান্ধী। যে কারণে ভারত ও বাংলাদেশে কখনো ওনার সাহিত্য নিয়ে কোনোদিন কোথাও খুব একটা আলোচনা কখনও দেখিনি। তবে এবার 'ঢাকা লিট ফেস্ট' শেষ হবার পর হয়তো কিছু কিছু আলোচনা শোনার সৌভাগ্য আমাদেরও হতে পারে।

আরেকটা মজার ব্যাপার দেখলাম, প্রথম দিনের আলোচনায় ফেসবুকের লেখাকে অনেকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে সাহিত্যিক মর্যাদা দেবার চেষ্টা করেছেন। ভেরি গুড! দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের সাহিত্যও এবার এগিয়ে যাবে। এই না হলে ঢাকা লিট ফেস্ট!

আগে যেখানে কেবল আনিসুল হকরাই দাঁত কেলিয়ে হাসতেন, এবার সেখানে আমার এক প্রিয় কবি ফরিদ কবিরকে দেখে আমি আরো বড় টাস্কি খাইছি। আমার কবিবন্ধু কবির হুমায়ূন, শামীমুল হক শামীমরা গেছেন, তাদের দেখে অবশ্য তেমন খারাপ লাগেনি। যে কোনো লিটারেচার ফেস্টিভালে যে কোনো কবি সাহিত্যক বন্ধুরা যাবেন, যেতেই পারেন, এটা তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা। তাদের সেই ইচ্ছার স্বাধীনতাকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু, কোথায় যাচ্ছেন, কাদের কাছে যাচ্ছেন, একটু জেনে-শুনে যান!

ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউন ঢাকা লিট ফেস্টের স্পেশাল বুলেটিন বের করার কথা। মিডিয়া পার্টনার হিসেবে এটাতো তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় চলা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আর জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি যে লিট ফেস্টের সঙ্গে আছে, এতো বিশাল একটা তিনদিনের একেবারে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন, সেই সম্মেলন সম্পর্কে দেশের কয়জন কবি-সাহিত্যিক খবর পেয়েছে, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো? বিদেশ থেকে কয়জনকে বিমান ভাড়া দিয়ে নিয়ে আসলেই সেটা আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন হয়ে যাবে? কী বলবেন এলিটপাড়ার সাহিত্যিকরা?

হে বাংলা একাডেমি, বাংলা সাহিত্য নিয়ে অনেক কিছু করার কথা ছিল। বারো মাস তোমরা কী করো আমরা কিন্তু ঈগল চক্ষু নিয়া সব দেখি। অমর একুশে বই মেলার আয়োজক কিন্তু দেশের প্রকাশকরা। যার নেতৃত্বে থাকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কেন্দ্রীয় গণ-গ্রন্থকেন্দ্র। অথচ বাংলা একাডেমি ওই একুশের বইমেলার আয়োজনকেই এখন সারা বছরে নিজেদের একমাত্র পুণ্যের কাজ বলে জ্ঞান করে। এভাবে আর কতদিন চলবে?

এজন্য আমার ভাই রফিক-শফিক-বরকত-জব্বার-সালামরা জীবন দেয় নাই। বাংলা একাডেমিতে সারা বছর বসে বসে জাবর কাটার জন্য আমার ভাইয়েরা বাহান্নে রক্ত দেয় নাই। বাংলা একাডেমি চত্বরে যা কিছু করা হোক না কেন অন্তত সেই রক্তের ঋণ পরিশোধের দায়বোধ নিয়েই তা করা উচিত। নইলে অমন এলিট সাহিত্য চর্চা করে জনগণের ট্যাক্সের পয়সার হিসাব একদিন কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দিতে হবে।

রেজা ঘটক : সাহিত্যিক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত