রওশন আরা বেগম

২১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:৫৯

দেশ-কাল ও অপবিবর্তন

প্রবাসীদের জন্য বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা আর ফেসবুক ফ্রেন্ড এদের মধ্যে রয়েছে ওঁতপাতা শিকারী।

আর্থিক ভাবে তিন উপায়ে মানুষের উত্তরণ হতে পারে। কেহ ধনী হয় লটারী পেয়ে, কেহ উত্তরাধিকারে, কেহ বা আবার আপন পরিশ্রমে।

সুদীর্ঘ প্রবাস জীবনের তিল তিল পরিশ্রম করে যে কিঞ্চিত সম্পদের মালিক হতে পেরেছিলাম সেই অপরাধে রক্তিয় মানুষগুলো অচেনা হয়ে যায়। এই সব দ্রুত পতনশীল ঈর্ষাকাতর স্বজনদের পতনের সাথী হতে না পারায় আমরা ক্রমাগত অবাঞ্ছিত হয়েছি। তাই এবার বঙ্গ যাত্রা সম্পূর্ণ নিজের উপর ভর করে চারমাসে কি কি করবো তার বড় একটা লিস্ট হাতে নিয়ে ‘’আপন চেয়ে পর ভাল তোর’’ এই তত্ত্বে ঈমান এনে এক বান্ধবীর বাসায় উঠলাম। একরাত সেখানে থেকেই ভাল না লাগায় কেটে পড়লাম ভাগ্য সন্ধানে।

একবার ভেবেছিলাম হোটেলে উঠে বাসা ঠিক করে নিবো। সেই সাহস না পেয়ে এক স্কুল বান্ধবীকে আমার সমস্যার কথা সব জানালাম। যত সমস্যাই হোক বাপের বাড়িতে আর কোন দিনও উঠবো না এই ছিল আমার সংকল্প। আমার এই অবস্থা দেখে স্কুল বান্ধবী আমাকে তার বাসায় আপাতত একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিল। আর এরপর থেকেই শুরু হলো আমার একটা স্থায়ী ঠিকানা তৈরীর সংগ্রাম।

পছন্দ মত ভাল বাসা পেতে প্রায় ১ সপ্তাহ সময় ব্যয় হলো। বেনু আপা আমাকে বেশ সাহায্য করেছিল বাসা খুজার ব্যাপারে। বাসা নিয়েই শুরু হলো বাসার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কেনার সংগ্রাম। একসেট হাড়িপাতিল ছাড়া কানাডার থেকে আর কিছুই নিতে পারি নাই। আস্তে আস্তে বাসা সব জিনিস দিয়ে ব্যবহার উপযুক্ত করে তুললাম।

বেশ কিছু বন্ধুবান্ধবকে বাসা নেবার খবরটি জানালাম। কিন্তু কেহ আর একটি বারের জন্য ফোন করে কোন খবর জানতে চাননি। যারা ফেসবুকের পাতায় আগুন লাগিয়ে যুদ্ধ করছেন তাদের ভাষ্য ছিল এ রকম বুক পেতে দিবো, জীবন দিয়ে রক্ষা করবো। এরা সবাই আমার কোন দুঃসংবাদের আশায় অপেক্ষা করছিলেন। তাই এই দুর্ঘটনার কোন সাক্ষী যেন না থাকে সে জন্য বিশেষ দুরত্ব বজায় রাখলেন।

এক সময় দাওয়াত করেছি, রেস্টুরেন্টে খাইয়েছি, সংগঠনে চাঁদা দিয়েছি। এরা সবাই আমাদের কাছ থেকে দূরে কোথায় যেন পালিয়ে গেলেন। তাদের মরণশীল কন্ঠের ধ্বনি শুনতে পেলাম না। এটি আমার ভাগ্য। অথচ যাদের জন্য সামান্য লেখা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারি নাই, তদের কেহ কেহ আমাদের খোজ খবর নেবার চেষ্ট করেছিল।

মানুষের সঙ্গ ছাড়া কেহ ভাল থেকেছে আমার জানা নেই। মানুষের কাছ থেকে শত আঘাত পাওয়ার পরেও সেই মানুষই খুঁজি। মানুষ খোঁজার সেই প্রবণতা থেকে এবার সুযোগ এলো এক বিখ্যাত সমাজকর্মী নারীর সাক্ষাতে তিনি পতিতাদের অবাঞ্ছিত বাচ্চাদের লালন পালন করেন। নিজের স্কুলে পড়ান। দেশী বিদেশী মানুষের সাহায্য সহযোগিতা পান। এই খ্যাতির তাড়নায় তাকে বিবিসির সাক্ষাতকারে আসতে হয়েছে।

স্বপরিবারে লালমাটিয়ায় তার বাসায় গেলাম। তার উপরে আমাদের ভক্তি অগাধ। উদ্দেশ্য ছিল বাচ্চাদের জন্য একটা কম্পিউটার দিবো। তাদের দোতলা বাড়িটি অতি সাধারণ। একটু অদ্ভুত ও বটে। নির্জনতা আর আলোর স্বল্পতা দেখে হঠাত মনে হতে পারে পরিত্যক্ত ও ভুতুড়ে বাড়ি। ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই সমাজকর্মী কলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে দিলেন।

বাসায় দুটো কাজের মেয়ে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলাম না। ৩০/৩২ বছরের এই সমাজকর্মী স্বরোচ্চাকিত, কণ্ঠ বিপ্লবী। পতিতাদের সামাজিকরণের স্বপক্ষে তার যুক্তি তুলে ধরলেন আমাদের সামনে। আমরা তাকে মনে মনে সত্যিকারের আরেক কাননবালার জায়গায় প্রতিস্থাপন করে ফেললাম।

এক সময় এই নারী নিষিদ্ধ পল্লীর বাসিন্দা ছিলেন, সে কথাও বললেন দীর্ঘ বক্তৃতায়। আলোচনার এক ফাঁকে তার গৃহকর্মী তিন কাপ কফি ও একপ্রিসে কিছু বিস্কুট সামনে আনলো। আমাদেরকে জানানো হলো বৃটেন থেকে আনা হয়েছে এটি বিশেষ ধরনের কফি। আমাদের মেয়েটি কফির দিকে হাত বাড়ালেই আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম তোমার পেটের অবস্থা ভাল না। আর আমি চা কফি কোনটাই পান করি না। শাখাই একা কফিটি বাড়িয়ে নিলো। আর ড্রাইভারকে ডেকে আমার কাপটি তার হাতে দিলাম। মেয়েটা পানি খেতে চাইলো। ড্রাইভারকে গাড়ির ভিতর থেকে পানির বোতল আনতে বললাম।

সমাজকর্মী তখন একটা গ্লাস এনে দিলেন এবং বললেন আপনাদের পানি খান এই গ্লাসে। আমি যেই গ্লাসে পানি ঢালতে যাব ঠিক সে সময় গ্লাসে নীচে সাদা কিছু পাউডার দেখতে পেয়ে নিজে উঠে ভাল করে গ্লাস ধুয়ে মেয়েকে পানি দিলাম। আর মনে মনে ভাবলাম কাজের মেয়েটি তাড়াহুড়া করে গ্লাস এনেছে তাই সাবানের পাউডার নীচে রয়ে গেছে।

এদিকে শাখা আর ড্রাইভার কফি পান করলো। ড্রাইভার কিছু না বলে গাড়িতে গিয়ে বসে রইল। আর শাখা একেবারেই চুপ করে বসে রইল। আমি তখনো বুঝতে পারি নাই যে পাউডার আমি নিজ হাতে পরিস্কার করেছি তা ছিল ড্রাগ। আমার মেয়ের জন্য তা বরাদ্দ ছিল।

শাখার এতটাই খারাপ লাগছিল যে কোন কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। আর আমি সেই সমাজকর্মীকে কানন বালার স্থানে বসিয়ে আনন্দের সাথে কুলাকুলি করে গাড়িতে উঠলাম।

এদিকে ড্রাইভার জানালো তার খুব খারাপ লাগছে। এই অবস্থায় বাসায় ফিরে এলাম। শাখা তার পর কথা বলা শুরু করলো। কফি খাওয়ার পর তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছিল আর বেহুশ-বাহুশ ভাব এসেছিল। ড্রাইভার ও তার খারাপ লাগার কথা বলেছিল। এরপর আমি আরো মনে করলাম যে গ্লাস আমার মেয়েকে দেওয়া হয়েছিল তাতে তো সাদা পাউডার ছিল। তা তো আমি নিজেই পরিস্কার করলাম।

তাহলে ড্রাগযুক্ত কফি আমাদেরকে দেওয়া হয়েছিল? কেন দেওয়া হলো? উদ্দেশ্য কি ছিল? আমরা তো গিয়েছিলাম তার কাজে সাহায্য করতে। বিনিময়ে একি পুরস্কার পেলাম!!

তিন দিন শাখা ভুগলো। আর আমাদের ড্রাইভার আমাদের সাথে আর যোগাযোগ করলো না। আমাদেরকে সে দোষী মনে করলো। একটু সজাগ থাকার জন্য আমাদের মেয়েটি বেঁচে গেছে। ড্রাগের পরিমাণ খুব বেশী না হওয়ার কারণে ড্রাইভার ও শাখা বেঁচে গেছে। তবে মেয়েটিকে বাঁচানো আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যেত। মুক্তিপণ অথবা ঐ নরকপুরের স্থায়ী বাসিন্দা আমাদেরকে বানাতে চেয়েছিল। সামনে একটা চ্যারিটির সাইনবোর্ড লাগিয়ে নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়া তার পক্ষে অনেক সহজ হয়ে গেছে। আর তাই এ ড্রাগের ব্যবসা সে দিবালোকে চালিয়ে যাচ্ছে।

আপনারা মেয়েটির নাম জানতে চান? কি হবে? কি করবেন? সবাই মত আমারও মনে হয় চুপ থাকা নিরাপদ।

যে স্বচ্ছ গ্লাসের মধ্যে দীর্ঘদিন নিজেকে লালন পালন করেছি সেই স্বচ্ছ গ্লাস থেকে বের হয়ে অস্বচ্ছ ঘোলাটের মধ্যে গিয়ে অন্ধের হাতি দেখার মতই হাতড়িয়ে একেবারেই হাপিয়ে উঠেছিলাম। মানসিক সুস্থতা নিয়ে পূর্বের জায়গায় ফিরে আসার সম্ভবনাও কমে গিয়েছিল চার পাশের মানুষের অসহযোগিতার কারণে। দেখতে পেলাম চারিদিকে ছলনা। কবির ছলনা, লেখকের ছলনা, সমাজকর্মীর ছলনা, মুক্তমনার ছলনা। সবাই এখানে শিকারী বণ্যপশু। সুযোগ হাতে এলেই লাফিয়ে পড়েন নিরীহ কোন প্রাণী বধ করতে।

তাদের চোখে নিরীহ প্রাণী হলো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোন ইটালীয় নাগরিক, কোন জাপানী কৃষি গবেষক যে কাজ করার জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছিল অথবা আমাদের মত কোন এক প্রবাসী যে বাংলাদেশের ভালবাসার টানে বার বার ছুটে যায়। আর ফিরে আসে জীবন-মরণ কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে।

আমরা ফিরে এসেছি, শক্ত মেরুদণ্ড নিয়েই বেঁচে আছি। এটাও আমাদের ভাগ্য। ভাল মানুষ যে একেবারেই পাই নি তা নয়। পেয়েছিলাম এক বেবিটেক্সি ড্রাইভার, এক রিক্সাচালক এক গ্রোসারী দোকানের মালিক, আমাদের বাসার কাজের মেয়ে ও আমাদের এক ধার্মিক প্রতিবেশী এবং বাড়িওয়ালা। আমাদের ধার্মিক প্রতিবেশী যে একটা ভাল মনের অধিকারী তা আগে বুঝতে পারি নাই। সবাইকে সন্দেহের কাতারে ফেলাতে ফেলাতে উনিও পড়ে গিয়েছিলেন। পরে উনি আমাদের কাছে প্রমাণ করে দিলেন ধার্মিক হয়েও উনি একজন ভাল মানুষ।

আরেক জনের কথা না বললেই নয় সে হচ্ছে আমার স্কুল বান্ধবী লিজা। তার সাহায্য ছাড়া আমার পক্ষে ফিরে আসাই কঠিন ছিল। গুরুত্বপুর্ণ পদে চাকুরী করা স্বত্বেও যতটুকু তার সাধ্যে ছিল তা করেছে, আমার পাশেই সব সময় ছিল। তার কারণেই এক প্রকার ভালভাবেই ফিরতে পেরেছি।

কি অদ্ভুত রহস্যময় নীরবতা। মুক্তমনার লেখকরা এখন নিশানা। হয়তো নিশানা ছিলাম অথবা ছিলাম না, সেটা যত না ভাবায় তার থেকে বেশী ভাবায় অনলাইন থেকে অফলাইনে চলে আসা বন্ধুদের রহস্যময় নীরবতা।

শুনেছি সব কিছু ব্যবসার উপকরণ হয়েগেছে। অভিজিতের মৃত্যুর পর মুক্তমনা ও অভিজিৎ প্রসঙ্গ কি কিছু মানুষের ব্যবসার দুয়ার খুলে দিল? সন্দেহ হয়। পরিচিতজনের নীরবতা, উপেক্ষা, অবহেলা দেখে আমার সেই সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছে। এদেশের ছোটখাট মহতি কাজে সাধ্যমত সাহায্য করে গেছি যেখানে আর সেখান থেকেই আমরা এই সব রকম পুরস্কার পেলাম।

প্রবাসীদের উপর আপনাদের এত রাগ কেন? দেশের সবচেয়ে বড় দুটো আয়ের উৎস তো প্রবাস থেকে আসে, সে কথা কে না জানে। গার্মেন্টস আর রেমিটেন্স ছাড়া বাংলাদেশ অচল। শুনেছি বড় কোন রেমিটেন্স আনতে পারলে সরকার বাহাদুর খেলাত দেন, গলায় চড়িয়ে দেন পুরস্কারের মালা।

দীর্ঘ ১৮ বছরে এই বঙ্গের মাটিতে কম রেমিটেন্স আনিনি। খিলাত তো দুরের কথা আপনজনের কাছ থেকে পেয়েছি ঈর্ষা। আর পরিচিতজনদের কাছ থেকে পেয়েছি অবহেলা আর উপেক্ষা। স্বীকৃতি আমাদের দরকার নেই। অনেক নির্ভেজাল মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে পঙ্গু হয়ে ভিক্ষে করছে। দেশমাতার জন্য আত্মত্যাগের বিনিময়ে কিছু পেতে হয় এমন আত্মসম্মানহীন তারা নন। দেশের জন্য কিছু করতে পারাই সবচেয়ে বড় কিছু। খিলাত আমাদের দরকার নেই।

রওশন আরা বেগম : কানাডা প্রবাসী লেখক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত