প্রণব জ্যোতি পাল

০৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০১:১২

নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ রোকেয়া

আজ ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস। বাঙালী নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়ার ১৩৫ তম জন্ম ও ৮৩ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ । রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩২ সালের একই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্যের শেকড় উপড়ে ফেলে সমতা, উন্নয়ন এবং শান্তি অর্জনের জন্য বিশ্বব্যাপী যে যুগের দাবি আমরা শুনতে পাই তা বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল  রোকেয়ার লেখনীতে।

রোকেয়া সবসময় বালিকা বা কন্যাশিশুর অধিকারের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সমাজে নারীর উন্নয়নের জন্য প্রথমে দরকার কন্যাশিশুদের উন্নয়ন। বেগম রোকেয়ার প্রতিটা লেখালেখিতে নারীমুক্তির প্রতিফলন দেখা যায়। বাংলার মুসলিম নারী জাগরণ, নারী উন্নয়ন ও নারী মুক্তির অগ্রদূত  রোকেয়া পুরুষ শাসিত সমাজের নির্মম নিষ্ঠুরতা, অবিচারও কুসংস্কারে জর্জরিত অশিক্ষা ও পর্দার নামে অবরুদ্ধ জীবনযাপনে বাধ্য নারী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। মুক্তির পথ দেখিয়েছেন উপমহাদেশের রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের নারীদের। তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই নারী সমাজ নীরব সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে পারবে। নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি কখনো পুরুষকে ছোট করে দেখেননি।

তাই তিনি লিখেছিলন, 'আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোড়াইয়া খোড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই।'

তিনি বুঝেছেন, প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে নারী-পুরুষের সমতা অনস্বীকার্য। তিনি লিখেছেন, 'দেহের দুটি চক্ষুস্বরূপ, মানুষের সবরকমের কাজকর্মের প্রয়োজনেই দুটি চক্ষুর গুরুত্ব সমান।'

সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ  রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন। তার মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী।  রোকেয়ার দুই বোন করিমুন্নেসা ও হুমায়রা এবং তিন ভাই। তৎকালীন মুসলিম সমাজ ব্যবস্থা অনুসারে রোকেয়া ও তার বোনদের বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়নি, তাদের ঘরে আরবি ও উর্দু শেখানো হতো। নারী শিক্ষার সুযোগ বলতে ছিল শুধুমাত্র কোরান তেলাওয়াত শিক্ষা ও উর্দু শিক্ষা । বাংলা বর্ণ পরিচয় ছিল নিষিদ্ধ । রোকেয়ার পরিবারে পর্দা প্রথার এতই কড়াকড়ি ছিল যে, আত্মীয় পুরুষ তো দূরের কথা বহিরাগত মহিলাদের সামনেও সাবের পরিবারের মেয়েদের পর্দা করতে হতো। তবে রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের আধুনিকমনস্ক ছিলেন। তিনি রোকেয়া ও করিমুননেসাকে ঘরেই গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শেখান।

১৮৯৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বেগম রোকেয়া পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর তিনি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’নামে পরিচিত হন। সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন উদারচেতা, মুক্তমনের মানুষ। তাই তিনি  রোকেয়াকে লেখালেখি করতে উৎসাহ জুগিয়েছেন এবং সাহিত্যচর্চার সুযোগ করে দেন এবং একটি স্কুল তৈরির জন্য অর্থ আলাদা করে রাখেন। স্বামীর উৎসাহে রোকেয়া সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্পের মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়া সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন। ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। এর পাঁচ মাস পর রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল নামে একটি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ভাগলপুরে। ১৯১০ সালে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার ফলে স্কুল বন্ধ করে তিনি কলকাতায় চলে যান। এখানে ১৯১১ সালের ১৫ই মার্চ তিনি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল পুণরায় চালু করেন। প্রাথমিক অবস্থায় ছাত্রী ছিল ৮ জন। চার বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪-তে। ১৯৩০ সালের মাঝে এটি হাই স্কুলে পরিণত হয়। স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত রাখেন। বিভিন্ন সভায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

অসচেতন নারী সমাজকে সচেতন করার জন্য তিনি আহ্বান করেছেন, 'ভগিনীরা! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন, অগ্রসর হউন! মাথা ঠুকিয়া বল মা! আমরা পশু নই; বল ভগিনী! আমরা আসবাব নই; বল কন্যে আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্ধুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বলো আমরা মানুষ।' ১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়া বিধবা নারীদের কর্মসংস্থান, দরিদ্র অসহায় বালিকাদের শিক্ষা, বিয়ের ব্যবস্থা, দুস্থ মহিলাদের কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ, নিরক্ষরদের অক্ষর জ্ঞানদান, বস্তিবাসী মহিলাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম মুসলিম মহিলা সমিতি 'আন্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম'। তৎকালীন বাংলার পশ্চাৎপদ ও অবহেলিত মুসলিম নারীদের গৃহকোণের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য এবং নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে নারী উন্নয়নের ইতিহাসে এই সমিতির অবদান অপরিসীম।

নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজের বিবেককে জাগ্রত করার জন্য তিনি তার লেখনীর মধ্য দিয়ে সংগ্রাম চালিয়েছেন। নারী সমাজ ও পুরো সমাজকে সচেতন করার জন্য তিনি বলেছেন, 'আদিম কালের ইতিহাস কেহই জানে না বটে। তবু মনে হয়, পুরাকালে সভ্যতা ছিল না, তখন আমাদের অবস্থা এইরূপ ছিল না কোনো অজ্ঞাত কারণবশত মানব জাতির এক অংশ (নর) নানা বিষয়ে উন্নতি করিতে লাগিল, অপর অংশ (নারী) তাহার সাথে সাথে সেরূপ উন্নতি করিতে পারিল না বলিয়া পুরুষের সহচরী বা সহধর্মিণী না হইয়া দাসী হইয়া পড়িল।' তিনি তার সাহসী লেখনীর মাধ্যমে নারী সমাজকে সংগঠিত করে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ডাকই দেননি, প্রস্তুত করার দায়িত্বও নিয়েছেন। তিনি নারী শিক্ষাকে কখনো পুঁথিগত জ্ঞান অর্জনের মাঝে দেখতে চাননি। তিনি শিক্ষার ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে, 'আমি চাই সেই শিক্ষা যাহা তাহাদিগকে (নারীদের) নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে'। অন্ন-বস্ত্রের জন্য নারী যেন কাহারো গলগ্রহ না হয় এটাই ছিল বেগম রোকেয়ার প্রত্যাশা। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন রাতারাতি কোনো আন্দোলনের মাধ্যমে নারী সমাজ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষা। এ সত্যকে উপলব্ধি করে তিনি বলেছেন, 'সমপ্রতি আমরা যে এমন নিস্তেজ, সঙ্কীর্ণমনা ও ভীরু হইয়া পড়িয়াছি ইহা অবরোধ থাকার জন্য হই নাই, শিক্ষার অভাবে হইয়াছি।' তিনি তার রচনা দিয়ে ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন এবং সফলও হয়েছেন।

রোকেয়া বলেছেন, ‘শিশুকে মাতা বলপূর্বক ঘুম পাড়াইতে বসিলে, ঘুম না পাওয়ায় শিশু যখন মাথা তুলিয়া ইতস্ততঃ দেখে, তখনই মাতা বলেন, ঘুমা শিগগির ঘুমা! ঐ দেখ জুজু! ঘুম না পাইলেও শিশু অন্তত চোখ বুজিয়া পড়িয়া থাকে। সেইরূপ আমরা যখন উন্নত মস্তকে অতীত ও বর্তমানের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, অমনই সমাজ বলে, ঘুমাও ঘুমাও ঐ দেখ নরক! মনে বিশ্বাস না হইলেও অন্তত আমরা মুখে কিছু না বলিয়া নীরব থাকি।’

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সম্পর্কে বঙ্গের মহিলা কবি গ্রন্থে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বলেছেন, “ বঙ্গের মহিলা কবিদের মধ্যে মিসেস আর,এস, হোসায়েনের নাম স্মরণীয়। বাঙ্গালাদেশের মুসলমান-নারী-প্রগতির ইতিহাস-লেখক এই নামটিকে কখনো ভুলিতে পারিবেন না। রোকেয়ার জ্ঞানপিপাসা ছিল অসীম। গভীর রাত্রিতে সকলে ঘুমাইলে চুপি চুপি বিছানা ছাড়িয়া বালিকা মোমবাতির আলোকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কাছে ইংরাজী ও বাংলায় পাঠ গ্রহণ করিতেন। পদে পদে গঞ্জনা সহিয়াও এভাবে দিনের পর দিন তাঁহার শিক্ষার দ্রুত উন্নতি হইতে লাগিল। কতখানি আগ্রহ ও একাগ্রতা থাকিলে মানুষ শিক্ষার জন্য এরূপ কঠোর সাধনা করিতে পারে তাহা ভাবিবার বিষয়।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা Sultana’s Dream। যার অনূদিত রূপের নাম সুলতানার স্বপ্ন। এটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয়। বিজ্ঞান বিষয়ক গভীর আগ্রহ এবং সাধারণজ্ঞান তাঁর চিন্তাকে সমুজ্জ্বল করেছিল। বিজ্ঞানের সুস্পষ্ট ছাপ মুদ্রিত দেখা যায় বিশেষ করে তাঁর রচিত গ্রন্থ “সুলতানার স্বপ্নে”। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলি হলঃ পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর। তাঁর প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর রচনা দিয়ে তিনি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন, শিক্ষা আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবে না এ কথা বলেছেন। খুব সহজভাবে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন এমন অনেক কথাই বলেছেন বেগম রোকেয়া। নারীদের তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন মানুষ হিসেবে এবং সমাজের অর্ধেক হিসেবে নারীর মর্যাদার স্বীকৃতির লক্ষ্যেই পরিচালিত হয় তাঁর সমগ্র প্রয়াস। তাঁর মধ্যে ছিল একজন যোগ্য শিক্ষকের প্রজ্ঞা, সমাজসংস্কারকের অন্তর্দৃষ্টি এবং মানবতাবাদীর নির্মল চেতনা।


রোকেয়া দিবস উপলক্ষে গভীর শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করছি নারী সমাজের অগ্রদূত, নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ , কিংবদন্তী মানবতাবাদী এই মহীয়সী নারীকে।

প্রণব জ্যোতি পাল: সমন্বয়কারী, বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চ, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত