আমিনা আইরিন

২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ২০:২৯

একটি নীল নকশা অথবা আরও একটি স্বাধীনতা চাই

আমার ছেলেবেলা আসলে ঠিক ছেলেবেলাও না। এই কয়েকবছর আগেও আমার কাছে ধর্ম বলতে ছিল শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া এবং নিয়মিত কোরান তেলাওয়াত করা। আমি যে স্কুলে পড়তাম সেখানে পিটিতে সুরা ফাতিহার সাথে মন্ত্র পাঠও করানো হত। আমার আর আমার প্রিয় বন্ধুটির মাঝে যে কোন পার্থক্য আছে তা কেবল টের পেতাম ধর্ম শিক্ষা ক্লাসে। তখন আমাদের দুই আলাদা রুমে ক্লাস করতে হত। কিন্তু এরকম হাজারটা ৪৫ মিনিটের ক্লাস আমাদের মধ্যে কখনো দূরত্ব তৈরি করতে পারে নি।

আমার মা নিয়মিত নামাজ পড়তেন। আমার যে হিন্দু বন্ধুরা ছিলো তাদের মায়েরাও নিয়মিত পূজা করতেন। তবু আমার মা আমাদের পূজায় নতুন জামা কিনে দিতেন আমার বন্ধুদের মায়েরাও ঈদে তাদের নতুন জামা কিনে দিতেন। আমরা পূজায় যেমন একসাথে লাবড়া খেতাম ঈদেও তেমনি এক থালায় বিরিয়ানি খেতাম।আমাদের পাশের বাসার মাসীমা যখন মজার কিছু রাঁধত আমাদের দিয়ে পাঠাত। মাকেও দেখতাম রোযায় ইফতারি পাঠাত নিয়মিত। তাদের ধর্ম ছিল আলাদা, তারা দুজনেই ছিলেন ধার্মিক তবু তারা বন্ধু ছিলেন। ধর্ম কখনো তাদের বন্ধুত্বে বাধা হয় নি। আমি বা আমার বন্ধুরা এমনই এক পরিবেশে বড় হয়েছি।

কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম এই ঈদ পূজার আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে শিখে নি। তাদের মন ও মগজে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বীজ পুঁতে দেয়া হচ্ছে। যদিও এই সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ শুরু হয় পঁচাত্তরের পর থেকেই। তবু তার অধিকাংশই টিকে নি আমাদের অভিভাবকের সচেতনতার জন্য। তবু একটি অপশক্তি একটু একটু করে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে তাদের নীল নকশা।

তারা বাঙালিদের তিন ভাগে বিভক্ত করে। ৯০% মুসলমান, ৮% অন্য ধর্মাবলম্বী এবং ২% আধিবাসী। যেহেতু স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন সরকারই আধিবাসীদের অধিকার নিয়ে তেমন কাজ করে নি তাই তাদের বিলুপ্তি ঘটছে ক্রমান্বয়ে। তাই তাদের নিয়ে চিন্তার কোন কারণ ছিল না। তাই তারা মনোযোগী হয় ৮% ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের। তাদের অস্তিত্ব মুছে দিতে এই অপশক্তি বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে তাদের উপর হামলা চালাতে থাকে। বিশেষকরে নির্বাচন পরবর্তী সময় এই নির্যাতনের পরিমাণ হয় ভয়াবহ।

তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ি এই ১০% কে মুছে দিতে পারলে থাকবে শুধু ৯০% মুসলমান। যাদের অধিকাংশই সহজ, সরল এবং বিশেষ করে ধর্মভীরু। এদের অধিকাংশকেই মাইন্ডওয়াশ করে নিয়ে আসা যাবে নিজেদের দলে। এই অপশক্তি কখনোই ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করতে চায় নি। চেয়েছে শুধু নিজের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে।

কিন্তু ২০১৩ সালে যখন সমগ্র বাংলাদেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিতে। তখন এদেশের অধিকাংশ মানুষ চলে আসে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিতে। তারা ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ভুলে এক হয় অপশক্তির বিরুদ্ধে। এই অপশক্তির এত দিনের পরিশ্রম জলে ডুবতে দেখে পাগলা কুকুরের মত ক্ষেপে ওঠে এই ঐক্যবদ্ধ গণজোয়ারকে ভাঙার জন্য। তারা বুঝতে পারে এই ঐক্যে ভাঙন না ধারালে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত। তারা বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং তারা তাদের শেষ এবং একমাত্র অস্ত্র ধর্মকে প্রয়োগ করা শুরু করে। শুরু হয় আস্তিক নাস্তিক, হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ।

সৃষ্টি হয় সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু, সাম্প্রদায়িকতার মত ঘৃণ্য শব্দের। এই অপশক্তি সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করতে সক্ষম হয়। এই অপশক্তি ১৯৭১ সালে চায়নি এই দেশ স্বাধীন হোক তবু এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল কারণ এই দেশের জন্য কোন হিন্দু মুসলিম যুদ্ধ করে নি, যুদ্ধ করেছিল বাঙালি। একটা প্রশ্ন মনে জাগতেই পারে ৪৪ বছর আগে যে বিষাক্ত বীজ বিস্তার লাভ করতে পারে নি তা আজ এত বছর পর কিভাবে বিস্তার লাভ করল।

এর প্রধান কারণ হল স্বাধীনতার পরবর্তী সময় অপশক্তির যে বীজ রোপণ শুরু হয়েছিল তা শুরুতেই উপড়ে ফেলা হয় নি। তাই আজ তা বড় হতে হতে বিশাল বিষবৃক্ষ। যারা এই দেশকে একদিন জন্ম নিতে দিতে চায় নি তারা আজ রাজত্ব করতে চায় এই দেশকে। প্রতিষ্ঠা করতে চায় নিজের মতাদর্শ।

২০১৩-এর গণজোয়ারের পর এই অপশক্তি স্পষ্টত বুঝতে পেরেছিল এরকম গণজোয়ার যদি আরো একবার সৃষ্টি হত তবে তাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব। তাই তারা তাদের নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। যেহেতু অধিবাসীদের নিয়ে তাদের প্রথম থেকেই চিন্তা ছিল না তাই তাদের টার্গেট হয় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা।

শুধু ২০১৩ সালের মার্চ মাসে সংঘটিত হওয়া নির্যাতনগুলো ছিল এরকম, নৌকায় হিন্দু বিধবাকে ধর্ষণ, নাটোরের বাড়াইমাড়া উপজেলায় সংখ্যালঘু এনজিও কর্মী ধর্ষণ, শ্মশানের ভূমি দখল, শেরপুরে শতবছরের পুরনো মন্দির দখলের চেষ্টা, জলঢাকায় হিন্দু পরিবারকে হত্যার হুমকি, শ্রীমঙ্গলে শিবমন্দির ভাঙা, তালতলায় ১৪ হিন্দু পরিবারকে ভিটেমাটি ছাড়া করা, হিন্দু শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক গরুর মাংস খাওয়ানো, বৌদ্ধদের উপর হামলা, সুনামগঞ্জে এবং কেশবপুরে সংখ্যালঘু পরিবারকে ভিটেমাটি ছাড়া করা, মানিকগঞ্জে প্রতিমা ভাঙচুর।

তাছাড়া ২০১৩-২০১৪ সালে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর নির্যাতনের চিত্র ছিল এরকম, ৭০৬ জন হিন্দু মেয়েকে জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণ করানো, ১৬৯৯ টি হিন্দু মন্দির এবং প্রতিমা ভাংচুর এবং আগুন লাগানো, ৩০২ জনকে হত্যা করা, ২০৯ মহিলা ও শিশুকে ধর্ষণ করা, ৫০৫০ হিন্দুকে বাড়িছাড়া করা, ৩১২৮ হিন্দু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ২৯০০ কে শারীরিকভাবে আহত করা।

যেহেতু এদের কোনটিরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি তাই নিজের এবং আপনজনের প্রাণ রক্ষার্থে তারা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই অপশক্তি যখন ১০% কে নিঃশেষ করতে প্রায় সক্ষম। তাই এখন তারা মনযোগী হয়ে উঠেছে ৯০% বাঙালিদের প্রতি। তারা তাদের চতুরতা দিয়ে এদেশের অধিকাংশ ধর্মভীরু মুসলমানকে ব্রেইনওয়াশ করে নিজেদের দলে নিয়ে যাচ্ছে আর যারা তাদের দলে যাচ্ছে না তাদের পরিণতি হচ্ছে সেই ১০% বাঙালির মত।

তারা কিন্তু তাদের নীল নকশা বাস্তবায়নের শেষ সীমায় যার উদাহরণ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে তাজিয়া মিছিলে হামলা, শিয়া, আহমদিয়া মসজিদে হামলা।

এটাই কিন্তু শেষসময়; হয় আমরা অপশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, হিন্দু মুসলমানের নয় প্রতিষ্ঠা করব মানুষের অধিকার, মুছে ফেলে সাম্প্রদায়িকতা নামক ঘৃণ্য শব্দের। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা যদি মানুষ হয়ে না জন্মাতাম তবে এই ধর্মের ভেদাভেদ, বর্ণের ভেদাভেদ কিছুই কিন্তু থাকত না। তাই আমাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মত রাষ্ট্র চাই নাকি বাঙালির গর্বের বাংলাদেশ চাই।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত