ফরিদ আহমেদ

৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ১২:৩৫

আলোর মুখ দেখলো ‘যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর বিচার : রায়ের পূর্ণ বিবরণ’ নামের বই

অবশেষে বইটা বের হয়ে এলো। গত এক মাসের পরিশ্রম, রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাজ করার ফল আজ নিজের চোখে দেখলাম। পাললিক সৌরভ প্রকাশনা সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তামান্না সেতু স্কাইপে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে, গভীর যত্নে এবং ভালবাসা নিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখালেন আমাকে বইটা। যেন সদ্য ভূমিষ্ঠ কোনো শিশু। সুদৃশ্য মোড়কে অসাধারণ সুন্দর বাঁধাই হয়ে এসেছে বইটা। এতো শুধু বই না, এ যে আমাদের ইতিহাস। আমাদের গর্ব আমাদের অহংকার, আমাদের কান্না আর বেদনা ধারণ করে আছে এই বই। একদিন আমরা কেউ থাকবো না এই ধরায়, কিন্তু সেদিনও থাকবে এই বই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।

এই বইয়ের জন্ম প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল খুবই ক্যাজুয়াল ঢঙে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুজাহিদের রায় মাত্র বের হয়ে এসেছে। আমি আর মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক সাব্বির হোসাইন কথা বলছিলাম ইনবক্সে। কে যে এটাকে অনুবাদ করার কথা আগে তুলেছিলাম শুরুতে, সেটা মনে নেই আমার। এটুকু মনে আছে যে, দুজনে একমত হয়েছিলাম যে, এই রায় ইংরেজিতে হবার কারণে এটি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরেই থেকে যাবে। অথচ এটি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অপরাধের এক জ্বলন্ত দলিল। আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষই বিস্মৃতিপ্রবন। একাত্তরে ঘাতকেরা কী কী অপকর্ম করেছিল, সেটা ভুলে যাবার দিকেই ঝোঁকটা আমাদের বেশি।

একাত্তরের অনিশ্চিত এবং ভীতিকর সময়ে অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক। শুধু শিক্ষকই নন, আরো অনেক পেশার প্রথিতযশা মানুষজন আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে। প্রবল ঝড়ে ভীত-সন্ত্রস্ত পাখিরা যেমন আশ্রয় খোঁজে বটবৃক্ষের কাছে, সেরকম অসংখ্য সাধারণ মানুষ এসে আঁকড়ে ধরেছিল তাঁকে সামান্য একটু নিরাপত্তার জন্য। জান-মাল, ইজ্জত-সম্মান, আর প্রাণ রক্ষার তাগিদে। চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে সবাই যখন দেশ ছেড়ে সীমান্তের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে, কেউ কেউ তাকে অনুরোধ করে বলেছে “চলেন দাদা, চলে যাই। পরিস্থিতি ভালো হলে ফিরে আসবেন। তারপর না হয় জনসেবা করবেন।“ নূতন চন্দ্র সেইসব কথা শুনেন নি, এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছেন।কোথায় যাবেন তিনি এই মাটি ছেড়ে? কোথায় পালাবেন প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে? কিসের মায়ায়? কার জন্য? তিনি কোথাও যান নি। পাকিস্তান আর্মি যখন তাঁর বাড়িতে এলো তাঁর স্বভাবসূলভ অতিথি পরায়নতা দেখাতে এক বিন্দু ভুল করেন নি তিনি। উঠোনে চেয়ার সাজিয়ে রেখেছিলেন তাদের জন্য। তাঁর অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলো মিলিটারি। কিন্তু যাওয়া হয় নি। কারণ সাথে ছিলো এক মৃত্যুদূত, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিরোধিতা করা মুসলিম লীগের নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর বড় সন্তান। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাল্টে দেয় সব ঘটনাপ্রবাহ। মিথ্যা বলে ফিয়ে আনে পাকিস্তান মিলিটারিকে। নিজের হাতে নূতন চন্দ্রকে গুলি করেন তিনি।বুলেটের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত, রক্তাক্ত হয় নূতন চন্দ্রের দেহ। তিনি লুটিয়ে পড়েন তাঁর প্রিয় মাটির বুকে।

রাউজানের প্রতিটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় বাড়ি থেকে লোকজনকে ডেকে এনে, সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে, ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়েছে। ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গুডস্‌ হিল নামক এক নরকে। সেই নরকে কাঠের পাটাতনে পোঁতা ছিলো অসংখ্য পেরেক। সেখানে শুইয়ে, উপর থেকে চেপে ধরা হয়েছে আরেকটি কাঠ।

এই সব দুঃসহ স্মৃতি ভুলে যাওয়া যায় না। ক্ষমা করে দেওয়া যায় না সব অন্যায়, অবিচার আর পৈশাচিকতাকে। আমরা ভুলি নি, ভোলাটা সম্ভব নয়। হাত-পায়ে পানি ঢাললেই রক্তের দাগ মুছে যায় না। আমরা অনেক কিছুই ভুলতে রাজি আছি, কিন্তু এমন কিছু নিশ্চয়ই ভুলবো না, যার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। জড়িয়ে আছে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত, ২ লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগ। বিজয়ী হয়েও আমরা পরাজিত হয়ে থেকেছি দীর্ঘকাল। আমাদের অক্ষমতা এবং অসহায়ত্ব নিয়ে লজ্জায় মাথা নীচু করে থেকেছি আমাদের তিরিশ লাখ শহীদ, এবং দুই লাখ ধর্ষিতা মা-বোনের কাছে। এই পরাজয়ের গ্লানি আমরা ভুলতে পারি নি হাজার চেষ্টা করেও। আসলে ভুলে থাকতে চাই নি আমরা।

সেই ভুলে না যাওয়ার বাসনা থেকেই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার এবং গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের পূর্ণাঙ্গ বেসরকারী অনুবাদ আমরা করেছি। এটি একটি যৌথ কাজ, একক কোনো ব্যক্তি অনুবাদকর্মটি করেন নি, বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গভীরভাবে বিশ্বাসী কিছু মানুষকে একসাথে করে, একটা দল গঠন করে ভাগ ভাগ করে এই বিশাল রায়টিকে অনুবাদ করা হয়েছ। তারপর, সুসমন্বিত করার জন্য সম্পাদনা সম্পন্ন করা হয়েছে কয়েক স্তরে।

বর্তমানে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতাবিরোধীদের বিচার হচ্ছে। যদিও এই অপরাধসমূহের ঘটনাকাল এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে। নানা কারণে এই বিচার বিলম্বিত হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ের অনেকখানি জায়গা জুড়েই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকতে পারে নি। ফলে, এদের কোনো বিচার হয় নি। শুধু যে, বিচার হয় নি বা বিলম্বিত হয়েছে, তাই নয়। এই সুযোগে এরা সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজেদের পূনর্বাসিত করেছে, আর্থিকভাবে পুষ্ট হয়েছে, গা থেকে রাজাকারের গন্ধ মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। এদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময়ে জনপ্রতিনিধি হয়েছে, মন্ত্রী হয়েছে, এমনকি রাষ্ট্রের শীর্ষপদও দখল করেছে। এরকম লোকজনকে যুদ্ধ ঘটনার এতো বছর পরে এসে তাদের কৃতকর্মের জন্য যথাযথ শাস্তি দেওয়াটা অত্যন্ত দুরূহ কাজ।

দুরূহ, কিন্তু অসম্ভব নয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যে সরকার বর্তমানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন আছে, তারা তাদের নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি হিসাবে এই সব রাজাকা্রদের, বিশেষ করে শীর্ষ রাজাকাররা, যারা একাত্তরে গণহত্যা, নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, হিন্দু ধর্মালম্বী এবং স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের উপর নৃশংস অত্যাচার করেছিল্‌ তাদের বিচার করা শুরু করে। এই বিচারে ইতোমধ্যেই কাদের মোল্লা, মোঃ কামরুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসানের ফাঁসি হয়েছে। জেলদণ্ড হয়েছে গোলাম আযম এবং দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর। মতিউর রহমান নিজামীর রায় প্রকাশের অপেক্ষায়।

ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে যখন বিচার হচ্ছিলো তখন জার্মানির ভিতরেতো নয়ই, বিশ্বের কোন প্রান্ত থেকেই এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে কোন কথা উঠেনি। সেই বিচার হয়েছিলো বিশ্বযুদ্ধ শেষ হ’বার বছরই, অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের নভেম্বর মাসে, শেষ রায় হয় ১৯৪৬ এর ৩০ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর। আরো উল্লেখ্য সেই ট্রাইব্যুনালের বাইরেও অনেক আদালতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার হয়েছে। শুধু জার্মানিতেই সেই আদালতের সংখ্যা ছিলো ১২০ টি। এর বাইরে অন্যান্য দেশেতো হয়েছেই। অন্যদিকে আমরা স্বাধীনতার পর কয়েক দশক পর্যন্ত বিচার দূরে থাক, যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেও সেটিয়ে থাকতে চেয়েছি প্রাণপণ। এই সময়কালে সেই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি প্রবল বেগে বাড়িয়েছে তাঁদের আধিপত্য, গড়ে তুলেছে আলাদা অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক, চালিয়েছে ধূর্ত প্রচারণা। সেই ধারাবাহিকতায় বিচার শুরু হবার পর তাঁরা সর্বশক্তি দিয়ে ট্রাইব্যুনাল নিয়ে কুৎসা রটানো শুরু করে। জুটে যায় কিছু আন্তর্জাতিক দালালও। ফলে দেশের ভিতরেতো বটেই, বাইরেও চলেছে এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে নানান অপপ্রচার। যাঁরা এই বিচার সমর্থন করেন, তাঁরাও হয়তো কেউ কেউ সংগোপনে ভেবেছিলেন, কী দরকার ছিলো এতো দিন পর এইসব পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটার? অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধাটাও সমাজের ক্রমাগত অবহেলায় ভুলে গিয়েছেন তাঁর গৌরবগাথা যুদ্ধ দিনের স্মৃতি, কিংবা হয়তো ভুলে থাকতে চেয়েছেন সবকিছু থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য এবং হয়তো ভুলে থেকেছেন। ফলে, নতুন প্রজন্মের বড় অংশই আমাদের অসামান্য গর্বের যে ইতিহাস, সেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে অনেক সময় আগ্রহ বোধ করে না তেমন একটা। ঘেটেঘুটে দেখে না, কী পৈশাচিক পাশবিকতা চালিয়েছিলো পাক বাহিনী এবং তাদের এদেশিয় দোসররা আমাদের পূর্ব প্রজন্মের উপরে।

দীর্ঘ সময়ের পার্থক্য হবার কারণে অনেক মানুষের মন থেকেই এদের ঘৃণ্য অপরাধসমূহের স্মৃতি অনেকখানিই ফিকে হয়ে গিয়েছে। সে কারণে, এদের রায়ের পরে শাস্তি কার্যকরের সময়ে অনেককেই এদের বিষয়ে সহানুভুতি প্রকাশ করতে দেখা গেছে। কেউ কেউ বলেছেন যে, কী দরকার ছিলো এতো বছর পরে রায় দিয়ে হত্যা করার? এই মানুষদের মধ্যে স্বাধীনতা-বিরোধী লোকজন যেমন আছে, তেমনি স্বাধীনতার পক্ষের মানুষেরাও আছেন। স্বাধীনতাবিরোধীরা জ্ঞানপাপী। তারা জেনে বুঝেই এটা করছে। এদের নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা কম। বাকি অংশটা নেহায়েতই সঠিক তথ্যের অভাবে এরকম করছেন। এঁদের কোনো ধারণায় নেই যে, এই অপরাধীরা একাত্তরে কতখানি নৃশংস ছিলো, কতোখানি রক্তলোলুপ ছিলো, কতোখানি প্রাণসংহারী ছিলো।

বিচার মানে যে, প্রতিশোধপরায়ন হয়ে ধরো-মারো-কাটো ধরনের না, বরং অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় তার অপরাধ মিথ্যা প্রমাণের জন্য, বিচারিক সব প্রক্রিয়াসম্পন্ন করা হয় স্বচ্ছভাবে, এবং এই বিচারকরা নির্মোহভাবে নিরপেক্ষ থেকে বিচারকার্য পরিচালনা করেন, রায় দেন, সেটা এই সকল বিচারের পূর্ণ রায় পড়লেই অনুধাবন করা যায়। সেই সাথে কোন কোন অপরাধের জন্য অপরাধীর কোন আইনে কী ধরনের সাজা হচ্ছে, তাও জানা যায়। কিন্তু, দুর্ভাগ্য হচ্ছে যে, এই রায়গুলো দেওয়া হয় ইংরেজিতে। ফলে, সাধারণ মানুষের পক্ষে, এমন কি অনেক শিক্ষিত মানুষের পক্ষেও এই রায়গুলো পড়া সম্ভব হয় না। পত্রপত্রিকায় রায়ের কিছু অংশ আসে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বিবরণ কখনোই প্রকাশিত হয় না।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এই রায় একটি ইতিহাস, যেখানে উল্লেখ আছে তার নৃশংসতা, উল্লেখ আছে গুডস হিল নামক নরকের বর্ণনা, আছে প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য, আছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ইতিকথাও। যা জানা দরকার আপামর জনগণের। সেই জানানোর তাগিদ থেকেই আমরা আইনের ছাত্র না হয়েও দুঃসাহস দেখিয়েছি এই রায় অনুবাদ করার। আইনি পরিভাষা জানা না থাকায় প্রকৃত শব্দ চয়ন হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে হয়নি, কিন্তু আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছি মূল বক্তব্য থেকে বিচ্যুত না হয়ে সাবলীল ভাবে অনুবাদ কাজ তুলে আনতে। সফলতা ব্যর্থতা পাঠক ঠিক করবেন। সকল ধরণে পরামর্শ আমরা সাদরে গ্রহণ করে ভবিষ্যতে ঋদ্ধ করবো আমাদের এই অনুবাদকে।

আমাদের কাছে মনে হয়েছিলো যে, এগুলোকে যদি বাংলায় অনুবাদ করা যেতো, তবে এই সকল পশুসম মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি মানুষের যে সামান্য সহানুভূতি জন্মেছে, তা জমতো না। বরং ঘৃণার আগুনটা আরেকটু বেশি জ্বলতো। এই দায়বদ্ধতা থেকেই সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের অনুবাদ করা শুরু করি আমরা। আমাদের এই দলে মোট বারো জন সদস্য ছিলেন। এর মধ্যে দশ জন সরাসরি অনুবাদ করেছেন। পাঁচজন (যাঁদের মধ্যে তিনজন অনুবাদও করেছেন) সম্পাদনার কাজ করেছেন। এবং একজন উপদেষ্টার ভূমিকায় ছিলেন। ইনি আবার চুড়ান্ত সম্পাদনাতেও যুক্ত ছিলেন।

অনুবাদের কাজটি খুব কঠিন ছিলো, কারণ এটা আইনের একটা বিষয়। পরিভাষাগত সমস্যা ছাড়াও, আইনের ইংরেজির সাথে আমাদের সম্যক ধারণা না থাকাতে কাজটা আয়াসসাধ্য হয় নি মোটেও। যেহেতু দশ জনে মিলে অনুবাদ করা হয়েছে, ভাষাগত ভিন্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক ছিলো। হয়েছেও তাই। সেগুলোকে সম্পাদনার মাধ্যমে সমন্বিত করাটা কষ্টকর এবং সময়সাপেক্ষ কাজ ছিলো একটা।

অনুবাদের সঙ্গে সরাসরি যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে দুইজন নিজেদের নাম প্রকাশের ব্যাপারে অনিচ্ছুক। অন্তরালে থেকে দেশের জন্য কাজ করে যাওয়াতেই তাঁদের আনন্দ, এটাই জানিয়েছেন তাঁরা। এই দুজনকে বাদ দিয়ে অনুবাদের সাথে যাঁরা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন, তাঁরা হচ্ছেন,
১। আরিফ রহমান
২। আহমদ রনি
৩। সাব্বির হোসাইন
৪। সুমিত রায়
৫। সুবর্ণা সেঁজুতি
৬। দেব প্রসাদ দেবু
৭। কেশব কুমার অধিকারী এবং
৮। ফরিদ আহমেদ

সম্পাদনার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা হচ্ছেন,
১। সাব্বির হোসাইন
২। দেব প্রসাদ দেবু
৩। শারমিন আহমেদ
৪। ইরতিশাদ আহমদ এবং
৫। ফরিদ আহমেদ

উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছেন ইরতিশাদ আহমদ এবং সম্পূর্ণ কাজটার সমন্বয়ের দায়িত্ব এবং প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ফরিদ আহমেদ।

আমরা আশা করছি যে, মুক্তিযুদ্ধের দলিল হিসেবে এটি বাংলাদেশের পাঠক সমাজে সাদরে গৃহীত হবে এবং রেফারেন্স হিসেবে বাংলা না পাওয়া যাওয়ার দুষ্প্রাপ্যতাকে অনেকখানি দূর করবে। এটি ইতিহাস বিকৃতিও ঠেকাতে সাহায্য করবে বলেই, আশা রাখছি।

রায়টা যখন সবে অনুবাদ করা শুরু করেছি, এর একেবারেই প্রাথমিক অবস্থায় আছি, কথা হয়েছিলো একদিন পাললিক প্রকাশনার দুই কর্ণধার মেহেদি হাসান শোয়েব এবং তামান্না সেতুর সাথে। এঁরা দুজন আমাদের অনুবাদ শেষ হবার আগেই, এবং অনুবাদকর্ম চোখে না দেখার অপেক্ষা সয়েও এটি বই আকারে প্রকাশের জন্য প্রবল আগ্রহ দেখান। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এবং বাংলাদেশ নামের দেশটির প্রতি এঁদের ভালবাসা দেখে আমরা আপ্লুত এবং অভিভূত।

খুব অল্প সময়ের প্রস্তুতিতে বইটার দৃষ্টিনন্দন এবং শৈল্পিক প্রচ্ছদটি করেছেন শিল্পী চারু পিন্টু।

২.

মানবতাবিরোধী মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর প্রথম দিকে ট্রাইব্যুনালের বিচারককে হুমকি দিয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দম্ভোক্তি করেছিলেন, 'চোখ রাঙাবেন না। আমি রাজাকার। আমার বাপ রাজাকার। এখন কে কী করতে পারেন, করেন।'

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এই দম্ভের কথা তাঁর বিচারের পূর্ণাঙ্গ রায়তেও লিখে রেখেছেন বিচারকেরা। সেখানে বলা হয়েছে, “বিচারের কোনো পর্যায়েই তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য অনুশোচনা এবং অনুতাপ দেখান নি, বরং এই আদালতের বিচারকাজকে অবমাননা এবং উপেক্ষা করেছেন। তাঁর হাবভাবকে ট্রাইব্যুনাল দম্ভ হিসাবে দেখেছে এবং বার বার সতর্ক করার পরেও তিনি পুরো বিচার প্রক্রিয়া চলার সময়েই চিৎকার-চেচামেচি করে ট্রাইব্যুনালের সৌষ্ঠবকে নষ্ট করেছেন। ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তাদের প্রতি কোনো সম্মান তিনি প্রদর্শন করেন নি এবং ট্রাইব্যুনালের কর্তৃত্বকে অমান্য করে গিয়েছেন প্রতিনিয়ত।“

এই দম্ভ এবং অমান্য করার ইতিহাস সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের বহু পুরোনো।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে মুসলিম লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগ, জামাত-ই-ইসলামি এগুলোর মতো ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা দিয়েছিলো। এরা স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি রাজাকার, আল-শামস, শান্তি বাহিনী এবং অন্যান সশস্ত্র দলগুলোকে সুসংগঠিত করেছিলো এবং নির্বিচারে হত্যা লুণ্ঠন, জ্বালাও, পোড়াও নীতি নিয়েছিলো স্বাধীনতাকামী মানুষদের উপরে। এই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি রাজাকার এবং আল-শামসের জন্য স্থানীয় তরুণদের নিয়োগ করতো এবং সাধারণ মানুষ, হিন্দু ধর্মালম্বী এবং আওয়ামী লীগের সমর্থকদের নির্বিচারে হত্যা করতো। এদের সহযোগিতা ছাড়া, পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের পক্ষে খুন, নিপীড়ন এবং অন্যান্য অপরাধসমূহ করা সম্ভবপর ছিলো না।

ফজলুল কাদের চৌধুরী কনভেনশনাল মুসলীম লীগের অন্যতম প্রধান একজন নেতা ছিলেন। আইয়ূব খানের মৃত্যুর পর এক সময় তিনি কনভেনশনাল মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্টও হন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, ন্যাশনাল এসেম্বলির স্পিকার হিসাবে কাজ করেছেন এবং পাকিস্তানের সাময়িকভাবে স্থলাভিষিক্ত প্রেসিডেন্টও ছিলেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার শক্তির বিপক্ষে লড়াইয়ে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

১৯৭১ সালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সেই সময়ে তাঁর বয়স ছিলো প্রায় ২২ বছর। ফজলুল কাদের চৌধুরীর একমাত্র সাবালক ছেলে ছিলেন তিনি। বাবার রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন সালাউদ্দিন এই মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপক্ষে অবস্থান নেন তিনি। নির্বিচারে হত্যা, গণহত্যা এবং অন্যান্য মানবতা-বিরোধী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হয়ে যান। তাঁদের পারিবারিক বাসস্থান ‘গুডস হিল’ থেকে স্বাধীনতা বিরোধী সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। গুডস হিল হিন্দু জনগোষ্ঠী ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোকদের অত্যাচার এবং নির্যাতনের কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো।

বাংলাদেশে একক পরিবার হিসেবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি নৃশংস অত্যাচার চালানোর অভিযোগ রয়েছে কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরীর পরিবারের বিরুদ্ধে। ফজলুল কাদের চৌধুরী আর তাঁর ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীই সে সময় পাকবাহিনীর সহায়তায় তার অন্য অনুচরদের নিয়ে সমগ্র রাউজান ও চট্টগ্রাম শহরে ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন।

হত্যা, নির্যাতন, লুট-তরাজ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী চালিয়ে যান একাত্তরের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই। এই অত্যাচার বন্ধ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটা ছোট দল তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনাও করেছিলো তাঁরা। সেই অনুযায়ী এক বৃষ্টিমুখর রাতে তাঁরা হামলা চালান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গাড়ির উপরে। খবর ছিলো যে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী গাড়ির সামনের সীটে থাকবেন। পরিকল্পনা মতো হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু সালাউদ্দিন ছিলেন গাড়ির পেছনের সীটে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করলে ড্রাইভার নিহত হয়। পায়ে গুলি লাগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর। আহত অবস্থা পালিয়ে যান তিনি। এর পর পরই তাঁর বাবা তাঁকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন।

এগুলো সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর একাত্তরের অপকর্মের সামান্য কিছু অংশ মাত্র। তাঁর রায়ের পূর্ণ বিবরণীতে তাঁর কুকীর্তির প্রায় সবকিছুই বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা আছে।

অথচ এই ব্যক্তিটি স্বাধীনতার পরে রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন সদম্ভে, সাড়ম্বরে। ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে  রাজনীতির পথে পা বাড়ান সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী। ৭৯ সালে মুসলিম লীগের হয়ে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়িতে নির্বাচন করেন তিনি। রাউজান, রাঙ্গুনিয়া দু’টি সংসদীয় আসন  থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাঙ্গুনিয়া আসনটি রেখে রাউজান আসনটি ছেড়ে দেন সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী। পরে যোগ দেন জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে। জায়গা পান স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের মন্ত্রিপরিষদে। দায়িত্ব পালন করেছেন ত্রান মন্ত্রনালয়, গণপুর্ত মন্ত্রনালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের।পরে জাতীয় পার্টি ছেড়ে নিজেই গঠন করেন এনডিপি(ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক পার্টি)। এক পার্টি, এক নেতা ও এক আসন(রাউজান-চট্টগ্রাম) নিয়ে জাতীয় সংসদে তিনি এনডিপির নেতা হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন।

৯০-এর দশকে এসে যোগ দেন বিএনপিতে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী। ২০০৯ সালের ৬ই ডিসেম্বর বিএনপি’র পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

আজকে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার হচ্ছে, এর ভিত্তিটা কিন্তু গড়ে দিয়েছিলেন এক অসমসাহসিক নারী জাহানারা ইমাম। একটা সময়ে প্রায় সবাই যখন একাত্তরের কথা ভুলতে বসেছে, বাংলাদেশের সমাজে যুদ্ধাপরাধীরা যখন শক্ত ভিত গেড়ে বসেছে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষেরা যখন কোণঠাসা, ঠিক সেই সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আন্দোলনটা গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিচারের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে বার্ট্রান্ড রাসেলে একটি বেসরকারী ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন। সেই ট্রাইব্যুনালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং উত্তর ভিয়েতনামে গুপ্তহত্যার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জনসনের সরকারকে দায়ী করা হয়। এরই আদলে জাহানার ইমাম ১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গড়ে তোলেন গণ আদালত। সেখানে প্রতীকী বিচারকার্য সমাধা হয় গোলাম আযমসহ কুখ্যাত বেশ কিছু রাজাকারের। এই গণআদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য সারা দেশব্যাপী এক বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

পঁচাত্তরের পরে আমাদের ইতিহাসকে বিকৃত করার, আমাদের গৌরবোজ্জল উত্তরাধিকারকে কালিমালিপ্ত করার, ইতিহাসের সাহসী মানুষদের বিস্মৃতির আঁধারে ঠেলে দেবার, খলনায়কদের নায়ক বানানোর সব প্রচেষ্টাই চালু হয়ে যায়। একসময় যারা বাংলাদেশের জন্মে প্রবল বিরোধিতা করেছে, নিদারুণ নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে একে আঁতুরঘরেই হত্যা করতে, একাত্তরের সেইসব যুদ্ধাপরাধীরা তখন সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো কোনো কণ্ঠ তখন বাংলাদেশে ছিলো না। অদম্য সাহস নিয়ে মহিয়সী এই মহিলা এগিয়ে আসেন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে। সেই সময় তিনি মরণব্যাধী ক্যান্সারে আক্রান্ত। মৃত্যুকে সঙ্গী করে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন তিনি। বিএনপি-জামাত এবং ফ্রিডম পার্টিওয়ালাদে অকথ্য গালিগালাজ খেয়েছেন। বিএনপি সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটেও থেকেছেন। তারপরেও তাঁকে ঠেকানো যায় নি। নির্মূল কমিটির জেলা বা থানা পর্যায়ের আয়োজিত যে কোন জনসভাতেই অংশ নিতেন তিনি। ফলে আন্দোলন হয়ে উঠেছিল দুরন্ত-দুর্বার।

গণ আদালত গঠন করার অপরাধে তাঁকে সহ চব্বিশজনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় ফেলে দেয় বিএনপি সরকার। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপবাদ মাথায় নিয়েই মারা যান তিনি। কী আজব এই দেশ! অথচ এই ভদ্রমহিলা মানব ইতিহাসের বিরল এক মা। একাত্তরে বাংলাদেশের যাতে জন্ম হয় সেই কারণে নিজ হাতে সন্তানকে রণসাজে সাজিয়ে ভারতের পথে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলেন তিনি। যুদ্ধে যাওয়া তাঁর সেই ছেলে রুমি বাঁচে নি। আরো অসংখ্য গেরিলা যোদ্ধার সাথে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো তাঁকে। শুধু যে ছেলে হারিয়েছিলেন তিনি, তাই নয়। তাঁর স্বামীও মারা গিয়েছিল এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ স্পর্শে। আর সেই দেশে তিনি রাষ্ট্রদোহী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন!

৩.
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অন্যান্য কুখ্যাত রাজাকার, আল-বদররা, যারা আমাদের এই দেশটাকে নরককুণ্ডে পরিণত করেছিলো, পরিণত করেছিলো মৃত্যুর হিম ছোঁয়ানো এক শ্মশানভূমিতে, তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল এবং আদালতের এই রায়গুলো একেকটি ইতিহাস। এই রায়গুলোতে রক্তের অক্ষরে লেখা আছে তাদের সকল কুকীর্তির কথা। এগুলো জানা দরকার আপামর জনগণের, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের। একদল রক্ত পিপাসু দস্যু কীভাবে আমাদের পূর্ব পুরুষদের রক্ত ঝরিয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই, কোনো কারণ ছাড়াই মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে তারা, বিনা কারণে ধ্বংস করেছে সমৃদ্ধ জনপদ, এগুলো জানলে এদের ঘৃণা করতে সুবিধা হবে তাদের। সেই সাথে জানবে এই দেশটা কারো দয়ার দানে আসে নি, কিনতে হয়েছে অনেক রক্তের দামে। রক্ত আর প্রাণের বিনিময়ে কেনা এই দেশটা যেনো সঠিক পথে থাকে, সেই চেষ্টাটা যে আমাদেরই করতে হবে।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের এই বাংলা অনুবাদ বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকতে পেরে আমি গর্বিত এবং আনন্দিত। আমার সঙ্গে অন্য যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে শ্রম দিয়েছেন, মেধা দিয়েছেন, তাঁরাও সবাই নিঃসন্দেহে একেকজন গর্বিত মানুষ এই মুহুর্তে। এঁদের সবার প্রতি রইলো আমার আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।

বইটা সংগ্রহ করে আপনারা নিজে পড়বেন, অন্যকে পড়তে দেবেন, পড়তে দেবেন ভবিষ্যত প্রজন্মকে, তাদের স্বাধীনতা বিরোধী অংশের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করবেন, এটাই আশা করছি। নিজের দেশের ইতিহাস যে জানে না, তার চেয়ে অভাগা আর কেউ হয় না। এরকম অভাগার সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকলে, দেশ যে সঠিক পথে আগাবে না, এটা বলা যায় চোখ বন্ধ করেই। এই অভাগার সংখ্যা যাতে না বৃদ্ধি পায় তার জন্য আপনার এবং আমাদের সকলেরই কাজ করতে হবে এক সাথে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত