সরোজ কান্তি দাশ

০২ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:৩৮

অশিক্ষার সমার্থক শব্দ বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা

১৯৭১ সালের ৭-ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন 'ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি' বলে উনার ভাষণ শুরু করেছিলেন; ঠিক তেমনি আমিও জাতির সন্তান হয়ে, বড় দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে, আমার এই লেখাটি লিখছি। আমি জানিনা, আমি অখ্যাত-ব্যক্তির লিখা কতজনের কাছে পৌঁছাবে; তবে অনেকের কাছে পৌঁছাক এবং সেই অনেকেরা আমার লেখা পড়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার সাথে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করুক, এটাই কামনা করি।

যাঁরা এর-আগে আমার লিখা পড়েছেন, তাঁরা হয়তো ভাবতে পারেন, 'কী-রে, বাবা! সব লেখাতেই শুধু প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ! এই ব্যক্তির সমস্যাটা কী?' তাঁদের উদ্দেশে আমি স্মিত হেসে বলবো- সমস্যা শুধু আমার-ই না, আপনিসহ গোটা রাষ্ট্রের জনগণের এবং উত্তরপ্রজন্মের-ও। কিন্তু কিভাবে? আমরা তো ভালোই আছি। আর কী এমন সমস্যা যা গোটা রাষ্ট্রের উপর দিয়ে বহে যায়? এমন প্রশ্নের জবাবে, আমি সেই ঘুমন্ত বিবেকের উদ্দেশে বলবো- তাহলে পড়ুন।

আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, 'বাংলাদেশে সবচে' ত্রুটিপূর্ণ সমস্যা কী?' আমি কিছু সময় ব্যয় না-করেই বলবো- 'প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা'। যে ব্যবস্থা আস্তে-আস্তে 'ধ্বংস ব্যবস্থা'য় পরিণত হচ্ছে। একটি রাষ্ট্র কিংবা একটি জাতিকে সমৃদ্ধশালী করতে হলে, প্রকৃত শিক্ষার কোনও বিকল্প নেই; কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উপর চোখ বুলালে দেখা যায়, এখানে শিক্ষার নামে যা করা হচ্ছে, তা-কেবল অশিক্ষা-ই নয়, আস্তে-আস্তে বাংলাদেশকে ধ্বংস করাও।

আর এই ধ্বংসের মাধ্যমে, বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, ৭১, ৫২ অর্থাৎ বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস মুছে ফেলা। আমি যদি আমার এই লেখায়, শুধু শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি নিয়েই লিখতে থাকি, তাহলে আমাকে কতোটুকু লিখতে হবে, আমি সন্দিহান। তবে, এই শিক্ষাব্যবস্থার গুণগুলো নিয়ে-ও যদি লিখতে বসি, তাহলে যে একদম-ই লিখতে পারবোনা কিংবা লিখতে চাইবোনা, তা কিন্তু নয়।

এই শিক্ষাব্যবস্থার কিছু ভালো কাজ-ও আছে। যেমন: বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদানসহ নারীশিক্ষার অগ্রগতিতে এই শিক্ষাব্যবস্থার কিছু পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে বিচারের বেলায় যদি এই শিক্ষাব্যবস্থা-কে 'ভালো' এবং 'খারাপ' শব্দযুগল নামে দু'টি দিকে বিভাজন করে দাঁড়িপাল্লায় রাখি, তাহলে স্পষ্টই দেখতে পাই, 'ভালো' এবং 'খারাপ'-এর স্থলে যথাক্রমে একটি 'বালুকণা' ও একটি 'ফুটবল' অবস্থান করছে।

বাস্তবে, এই শিক্ষাব্যবস্থাসহ প্রায় সকল ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট হর্তা-কর্তারা, তাদের দেশের জনগণকে একটি বড় মাইক্রোস্কোপের গ্লাসে চোখ ধরিয়ে ভেতরে রাখা 'বালুকণা'-কে দেখিয়ে বলছেন- 'It's a big achievement of ours.' তখন সরল-জনগণ, তাদের দুর্বোধ্য ভাষা বুঝতে না-পেরে, হাত-তালি দিয়ে হে-হে-হে করে হাসলেও, হর্তা-কর্তাদের মিথ্যাচার দেখে, আমি সোজাসাপটা বলে দিই- 'Big achievement' ফাটবে না তো! তখন হয় তারা লজ্জা পেয়ে সত্যি-সত্যি উন্নয়ন করতে শেখেন; আর না-হয় চিৎকার করে বলে ওঠেন- "ওই, অ্যারে ধর্।" তখন আমি নিরীহ মানুষ, আমার মায়ের কথা স্মরণ করি। মা বলতেন- 'সমস্যার সমাধান চেয়ে, সমস্যায় পড়াই, অবুঝ সরোজের কাজ।'


বিগত কিছু বছর ধরে, যেকোনও শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায়-ই, 'প্রশ্নফাঁস' নামক যে অনিয়ম শুনে আসছি, সেই অনিয়ম শুনতে-শুনতে মাঝেমাঝে এমন মনে হয় যে, আমার 'কর্ণফাঁস' করে দিই যা'তে 'প্রশ্নফাঁস' আর কখনও শুনতে না-হয়। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় 'প্রশ্নফাঁস' এমন একটি ফাঁসি যে, যা শুধু প্রকৃত শিক্ষার আপাদমস্তকেই ফাঁস লাগবে না, এই ফাঁসির দড়ির অবশিষ্টাংশ মানবিক মূল্যবোধকে-ও খুব শক্ত করে চেপে ধরবে। আর এই আশঙ্কায়, রাষ্ট্রের পূর্ণশক্তি থাকতে-থাকতে, এখন-ই যদি সকল অনৈতিক ফাঁসির দড়ি টেনে ছিঁড়তে না-পারি; তাহলে আস্তে-আস্তে একসময় যখন শক্তিহীন বৃদ্ধ হবো, তখন 'কি-ই-চ-ছু' করার থাকবে না। কেননা, তখন এমন একটি সময় আসবে, যখন প্রায় সবার-ই 'প্রশ্নফাঁস'-এর সাথে গভীর বন্ধুত্ব থাকবে, আর এই বন্ধুত্বের দৌরাত্ম্যে তাদের পেছনে 'প্রশ্ন' নামক নিরীহ বস্তু উত্তরসহ দৌড়াবে। আর তখন-ই আমরা সংখ্যাকয়েক 'না' শ্রেণির মানুষেরা,

চশমা ছাড়া, প্রখ্যাত 'হুমায়ুন আজাদ'-এর একটি বইয়ের মলাটে তাকিয়ে বলবো- 'সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে।' প্রায় প্রতিটি বোর্ড পরীক্ষায়, হাজার-হাজার শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। যখন এই-সকল শিক্ষার্থীরা দিনরাত কষ্ট করে পড়ে, পরীক্ষায় না-পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে, কম মার্কস্ বা কম পয়েন্ট পায়, তখন তাঁদের অজান্তেই তাঁরা হতাশ হয়ে যায়, আর ভাবে, কী হবে পড়াশোনা করে! তখন 'প্রায়' প্রতিটি শিক্ষার্থী-ই না-পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দলে চলে আসে, আর ভাবে, কী করে না-পড়েও এ-প্লাস পাওয়া যায়। আর যাঁরা আগের বাক্যের 'প্রায়'-এর বাইরে অবস্থান করে কিংবা করতে চায়, তাঁরা ভাবে- 'আমাকে কষ্ট করেই এ-প্লাস পেতে হবে, কারণ আমার বাবার প্রশ্ন পাওয়ার মতো অর্থ কিংবা ক্ষমতা নেই।' এতে করে তাঁরা-ও এ-প্লাস পায় যাঁরা সত্যি-সত্যি পড়েছে; অন্যদিকে তারা-ও এ-প্লাস পায়, যাদের এ-প্লাস পাওয়ার যোগ্যতা নেই।

ব্যক্তিগতভাবে আমি একটা সময় ভাবতাম, বোর্ড পরীক্ষায় 'প্রশ্ন' পেয়ে এ-প্লাস কিংবা ভালো রেজাল্ট করলেও, এ-সমস্ত শিক্ষার্থীরা একটি সময় ঝরে পড়বে, যখন উচ্চশিক্ষার পরবর্তী ধাপে তারা চান্স পাবেনা। আর যখন আমি এমনটি ভাবতাম, তখন আঁতকে উঠতাম এই ভেবে যে, কী হবে এতো-এতো শিক্ষার্থীর! কিন্তু এই (২০১৫) বছরের মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসসহ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস-এর সংবাদ শুনে, আমি শুধু আঁতকেই উঠিনি, রীতিমতো কাঁপছি- ভয়, ঘৃণা, ক্ষোভ ও লজ্জায়।

মেডিক্যাল, ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় 'প্রশ্নফাঁস' হয়ে যখন যোগ্যতাহীনরা বিনাবাধায় পড়াশোনা করছে, তখন যোগ্যদের হতাশা দেখে, আমার কান্না আসে। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়, যখন আমি অনুধাবন করি শত-সহস্র যোগ্য শিক্ষার্থীরা শুধু রাষ্ট্রের ব্যর্থতার জন্য কয়েক দশকের বোনা রঙিন স্বপ্ন-কে গলা টিপে হত্যা করছে। তখন আমার বলতে ইচ্ছে হয়, যদি মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা সমান হয়; তবে, লক্ষ-লক্ষ শিক্ষার্থীর স্বপ্নভঙ্গের অপরাধ, তাঁদের জীবনহানির অপরাধসম দায়ভার রাষ্ট্রের হর্তা-কর্তাদের নিতে হবে। কিন্তু এ-জায়গায় বাস্তবে যা দেখতে পাচ্ছি, রাষ্ট্রের হর্তা-কর্তারা তাদের ব্যর্থতার দায়ভার না-নিয়ে, নির্বোধের মতো যখন বেপরোয়া মিথ্যাচার করেন, তখন তাদেরকে আমি বরাবরই রাষ্ট্রের ধ্বংসকারী উপাদান হিসেবে মনে করি।

তাদের উপর আমার ঘৃণার থুঃ থুঃ বর্ষণ করে, যখন আমি রাষ্ট্রের জনগণের দিকে তাকাই, তখন রাষ্ট্রের বোবা-অন্ধ-বধির জনগণ দেখে নিজেকে এতোটাই অসহায় মনে হয় যে, ইচ্ছে করে স্বদেশ ছেড়ে বিদেশবিভুই-এ চলে যাই। কিন্তু পর মুহূর্তেই, যখন বাঙলার ভাষা, সঙ্গীত, প্রকৃতি, আমার গর্ব বঙ্গবন্ধু, আমার অহংকার রবীন্দ্রনাথ, আমার চেতনা ৭১, আমার শ্বাসনালীতে ৫২'র উপস্থিতি অনুভব করি, তখন আমার প্রাণপ্রিয় স্বদেশ ছেড়ে বিদেশ কল্পনাই করতে পারি না; উচ্চারণে মুখে ফোটে- বি-বি-বিষ।

রাষ্ট্রের নানাবিধ জাতীয় সমস্যায় যখন রাষ্ট্রের হর্তা-কর্তারা চেঁচিয়ে তাদের সফলতা প্রচার করেন; প্রচার করেন, তাদের সরকার কিংবা তাদের দল 'কোনও দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই', তখন আমি নিরাশ হই, এ-রকম অযোগ্য স্বার্থপর হর্তা-কর্তাদের নিয়ে। আমি মাঝেমাঝে চিন্তা করি, আমাদের বাংলাদেশে অনুসরণ করার মতো কতজন যোগ্য ও সঠিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আছেন। যখন খুঁজতে-খুঁজতে হাতে গোনা এক-দু'জন পাই; তখন গভীর চিন্তায় পড়ে যাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

একটি রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ ক্ষমতাবানরা যখন তাদের নিজ নিজ ক্ষমতা ও অর্থ-প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখার জন্য, রাষ্ট্রের জাতীয় সমস্যায় মিথ্যাচারের সাথে দুর্নীতি করেন, তখন তাদের উপর ভরসা রাখা তো যায়-ই না, আমরা নিজেরাও অনিশ্চয়তা ও অনিরাপদ বোধ করি। যেমন: আমি আজ আমার এই লিখায় রাষ্ট্রের সমস্যার সমাধান চেয়ে যে নিজে সমস্যায় পড়বো না, এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। কেননা বর্তমান বাংলাদেশের ক্ষমতাবানরা চান না যে, তাদের ব্যর্থতায় কেউ আঙুল তুলুক। কারণ বর্তমান বাংলাদেশে যেভাবে জনগণ বোবা-অন্ধ-বধিরের মতো নীরব ভূমিকা পালন করছে, এতে করে ক্ষমতাবান ও ক্ষমতালোভীরা আস্কারা পেয়ে যাচ্ছে।

যাঁরা তাদের ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করে তাঁদের সমস্যায় ফেলতে কিংবা সমূলে উৎপাটন করতে। ঠিক এভাবেই একটি সময় আসবে, যখন সৎ, বিবেকবান মানুষের কোনও মূল্য থাকবে না যদিও ক্ষেত্রবিশেষে আজ কিঞ্চিৎ পরিলক্ষিত করা যায় এবং অন্যদিকে অযোগ্য, লোভী, নষ্টদের হাতে থাকবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো, আর একসময় আস্তে-আস্তে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।

এই ডিসেম্বরে-ই কোনও এক-দিনে, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের (সঙ্গত কারণেই, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সাথে কথাচলাকালে, তিনি কথাপ্রসঙ্গে বেশ দুঃখ নিয়ে বললেন- "বর্তমান আওয়ামীলীগে একমাত্র শেখ হাসিনা ব্যতীত একজনও স্বচ্ছ নেতা কিংবা নেত্রী নেই। তাহলে, দেশ আগাবে কিভাবে?" পাঠকেরা জেনে অবাক হবেন যে, আমি আমার শিক্ষকের কথায় মন থেকে দ্বিমত পোষণ করতে পারিনি। বলতে পারিনি এমতাবস্থায় দেশ কিভাবে এগিয়ে যাবে এবং আজও বলতে পারবো না। তাই এই প্রশ্নের উত্তর আমি আমার পাঠকদের কাছে জানতে চাইবো, প্রিয় 'হৃত্বিক ঘটক'-এর "ভাবো, ভাবো; ভাবার প্র্যাকটিস করো" উদ্ধৃতিটি বলে।


অনেকেই জানেন কিংবা জানেন না যে, আমাদের বাংলাদেশে একটি বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় আছে; যার নাম 'জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়'। তালিকাভুক্তির দ্বারা এটি পৃথিবীর ৫ (পাঁচ) তম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। যার অধীনে প্রতিবছর লক্ষ-লক্ষ শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণ করছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাঁরা শিক্ষাগ্রহণ করছেন কিংবা করেছেন; তাঁরা কেউ-ই খুশি হয়ে বলতে পারবেন না যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধ্যয়ন করে তাঁরা সুখে আছেন কিংবা সুখে ছিলেন। কিন্তু কেনো?

এই প্রশ্নটি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে কেউ কোনওদিন করেনি কিংবা এই প্রশ্নটির উত্তর আমি ব্যক্তিগতভাবে কতোটা বলতে পারবো, সন্দিহান। কেননা, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে মানুষের অভিযোগ শুনতে-শুনতে কিংবা আমার নিজের অভিজ্ঞতা-ই যদি লিখতে শুরু করি, তাহলে আমার মনে হয়, আমি কয়েক সপ্তাহে-ও অর্ধাংশ লিখতে পারবোনা। আমার অত্যন্ত খারাপ লাগছে যে, আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রুটিগুলোর একটি অন্যতম ত্রুটি কিংবা অনিয়ম নিয়ে লিখছি।

২০১৪ সালের শেষ দিকে, আমি যখন প্রথম শুনতে পাই যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাঁরা ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে সম্মান (অনার্স) শ্রেণিতে পড়তে ইচ্ছুক, তাঁদেরকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবেনা। এর বিপরীতে ভর্তিচ্ছুকদের এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি পরীক্ষার রেজাল্টের পয়েন্ট দ্বারা নির্দিষ্ট বিষয় দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হবে। অর্থাৎ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাঁরা সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হবে, তাঁরা তাদের অতীতের বোর্ড পরীক্ষার রেজাল্ট দ্বারা, কোনও ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না-করেই ভর্তি হবে। আমি যখন প্রথম এই দুঃসংবাদটি শুনি, তখন একদম-ই বিশ্বাস করতে পারিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন নির্বোধজনোচিত সিদ্ধান্তটি।

পরে যখন নিজ চোখে দেখলাম, তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিকল্পনা-বাস্তবায়িত হতে, তখন আমি এই নষ্ট 'জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়'-এর একজন শিক্ষার্থী হয়ে লজ্জাবোধ করছি; যেখানে আমার আনন্দ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কেনো, আমার এই-লজ্জাবোধ? বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতি আমি ঘৃণা করি, সেটি হয়তো আমার অন্য কোনও লেখায় লিখেছিলাম। আর সেই রাজনীতির অঙ্গ ছাত্র-সংগঠনগুলোর আদর্শ, কর্মকাণ্ড ও বাস্তবায়িত-নীতিমালা দেখে, আমি সেগুলোকে ক্ষমতার সন্ত্রাসী সংগঠন বলতে পারি কিন্তু কখনোই ছাত্ররাজনীতি নয়।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যেদিন ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করে, ঠিক সেদিন থেকেই আমি অস্পষ্ট এক দুর্নীতির আভাষ পাচ্ছিলাম। এর নির্দিষ্ট কিছুদিন পর, যখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সম্মান শ্রেণিতে ভর্তির ১ম মেরিট লিস্ট প্রকাশ করে, ঠিক তখন থেকেই শুরু হয় প্রকাশ্য দুর্নীতি। কিছুদিন পর যখন, তাদের ২য় মেরিট লিস্ট প্রকাশ হয়, তখন দুর্নীতির মাত্রা ক্রমশই বাড়তে থাকে। কিভাবে?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, কোনোরূপ ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই, শুধু এস.এস.সি. ও এইচ.এস.সি.-এর পয়েন্ট দ্বারা শিক্ষার্থীরা ভর্তি হবে। বুঝাই যাচ্ছে, যাঁদের পয়েন্ট কিংবা রেজাল্ট ভালো হবে শুধু তারাই সীমাবদ্ধ আসনে ভর্তি হতে পারবে। অন্যদিকে যাঁদের রেজাল্ট কিংবা পয়েন্ট ভালো থাকবে না, তাঁরা আসন পূর্ণ হয়ে গেলে ভর্তিও হতে পারবে না এবং তাঁরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে ঠিক এর উল্টোটি। যেমন: যে শিক্ষার্থীর এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি দু'টি পরীক্ষা মিলিয়ে ১০ পয়েন্টের ভেতর ৯.৮০ পয়েন্ট আছে, সে শিক্ষার্থী চান্স-ই পায়নি; অন্যদিকে যে শিক্ষার্থীর উল্লিখিত দুই পরীক্ষায় ১০ পয়েন্টের ভেতর ৭ পয়েন্ট আছে সে চান্স তো পেয়েছেই, সংশ্লিষ্ট কলেজের সবচেয়ে বেশি চাহিদার বিষয় নিয়ে পড়ার জন্য ভর্তিও হচ্ছে।

এতে করে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, দুর্নীতির হাত কতো লম্বা! এই দুর্নীতি সম্বন্ধে দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি যতটুকু জেনেছি, ততটুকু জেনেই আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেছি; এখানে অনুসন্ধানী চোখ দিয়ে দেখলে কি বাঁচতে পারতাম? অনেক শিক্ষার্থী-ই রাজনৈতিক মাধ্যমে পছন্দের বিষয় নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। আর যাদের ঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ রাজনৈতিক লিঙ্ক নেই, তারাও টাকার মাধ্যমে ভর্তি হতে পারবে, যদি তারা চায়। এবং এই বছর এটাই হচ্ছে, যা আমি দেখছি। আমার কথা হলো, শিক্ষার্থীদের সাথে এমন দুর্নীতি কেনো? ওঁরা কি দুর্নীতি শিখতেই পড়াশোনা করছে? আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, যে শিক্ষার্থী টাকা কিংবা রাজনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে ভর্তি হচ্ছে, সে-ও কোনও এক-সময় টাকা এবং নষ্ট রাজনৈতিক ক্ষমতার পেছনে সময় নষ্ট করবে।

কারণ, তাদেরকে যে তা-ই শিক্ষা দিচ্ছে, আমার দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। আমার জানামতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যে কলেজগুলো আছে, সেগুলোতে প্রতিটি বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন বরাদ্দ করা হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী তিনটি মেরিট লিস্ট প্রকাশ করা হয়। কেউ যদি এই মেরিট লিস্ট-এ চান্স পেয়ে না-থাকে, তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর রিলিজ স্লিপ নিয়ে অন্য কোনও কলেজে ভর্তি হতে পারবে, সীমিত আসনের ভিত্তিতে। এতে করে ভর্তি প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ হলেও, শিক্ষার্থীরা তাঁদের পছন্দের বিষয়সহ তাঁদের নানাবিধ সুবিধার দিক থেকে তেমন একটা লাভবান হয় না। তাছাড়া অনেক শিক্ষার্থীর ইচ্ছাও থাকে না যেকোনও কলেজে ভর্তি হবার, তাঁদের পছন্দের কলেজ ব্যতীত। এমতাবস্থায়, যদি দুর্নীতির মাধ্যমে, ভালো রেজাল্ট করা কিংবা পয়েন্টের দিক থেকে এগিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা তাঁদের পছন্দের কলেজে, পছন্দের বিষয় নিয়ে ভর্তি হতে না-পারে; তাহলে, তাঁরা কোথায় ভর্তি হবে, আমার প্রশ্নটি শিক্ষাব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট। আশা করবো, আমার লেখার জবাবে আরেকটি লিখা লিখবেন।

অনেকেই বলতে পারেন, সম্মান শ্রেণিতে চান্স না-পেলে শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি পাস কোর্স-এ ভর্তি হতে পারবে। আমি বলবো- একবিংশ শতাব্দীর এই বিশ শতকের ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিগ্রি পাস করে কি করবে প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরা? যেখানে আজ ডিগ্রি পড়তে তুলনামূলক খারাপ রেজাল্ট করা শিক্ষার্থীরাও অনিচ্ছা প্রকাশ করে, সেখানে ভালো রেজাল্ট করা শিক্ষার্থীরা শিক্ষা-দুর্নীতির শিকার হয়ে কী করবে, আমি সেটা ভেবে বড় দুঃখ পাই। যাঁরা আর্থিকভাবে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে থাকে তাঁরা হয়তো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যায়; কিন্তু যাঁদের আর্থিক ক্ষমতা নেই, তাঁরা না-পারছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে, না-পারছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের বিষয় নিয়ে অনার্স পড়তে। শুধু তাই-ই নয়, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব 'মানিক ঘোষ'-এঁর মাধ্যমে যে কয়েক চাঞ্চল্যকর তথ্য জানলাম, সেগুলো জানতে পেরে, এই রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের নিজস্ব মিথ্যা-ঢোল বাজানো শুনে, আমার মনে প্রশ্ন জাগছে- ওরা এতোটা নীচ হয় কী করে?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, আরেকটি নতুন নিয়মের মধ্য দিয়ে, তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে; সেটি হলো- এখন থেকে ডিগ্রি ভর্তি হতে গেলেও, ভর্তি পরীক্ষা কিংবা নির্দিষ্ট আসনের ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে আটকে যাবে শিক্ষার্থীরা। অর্থাৎ হাজার-হাজার শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে বেছে-বেছে (হতে পারে সেটি রাজনৈতিক লিঙ্ক কিংবা অবৈধ অর্থ কিংবা সঠিক নিয়মে) ভর্তি করা হবে শিক্ষার্থীদের। তাহলে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, এখানেও ঝরে পড়বে হাজার-হাজার শিক্ষার্থীরা। আমার প্রশ্ন হলো- যে-সকল শিক্ষার্থীরা, এই ধাপে এসে ঝরে পড়বে কিংবা পড়ার জন্য বিবেচিত হবে না, তাঁরা কোথায় যাবে? কোথায় গিয়ে পড়বে তাঁরা? কিংবা এমতাবস্থায় কী করণীয় আছে, এই নষ্ট রাষ্ট্রের?

আবার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে লক্ষ করলেও দেখা যায়, সেখানে ভর্তি হবার জন্য কষ্ট করে অর্থ-যোগাড় হলেও, পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়তে পারছে না শিক্ষার্থীরা। এর-পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে, একটি অন্যতম কারণ হলো- আসন স্বল্পতা। কিন্তু কেনো? কেনো এই অবিচার? আমি শিক্ষাব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে, তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি- দয়া করে, একটু ভাবুন এই শোষিত দেশটার জন্য। যে-সকল শিক্ষার্থী ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখছে, তাঁরা ডাক্তার হবে। ডাক্তারি পড়বে, রাষ্ট্রের সরকারি মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু আপনারা কি প্রকৃত মেধাবীদের পড়ার সুযোগ করে দিয়ে, তাঁদের সত্যিকারের রঙিন স্বপ্ন পূরণের সাথে দেশের জন্য প্রকৃত ডাক্তার যোগানের চেষ্টা করছেন। আপনারা কি চেষ্টা করছেন, প্রকৃত মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ করে দেবার? হে আমার রাষ্ট্রের দরিদ্র জনগণের, কষ্টের টাকার বেতনভোগী, আপনাদের বলছি- জনগণের টাকায় মোটা অঙ্কের বেতন নিয়ে, চকচকে গাড়ি চালিয়ে, সুন্দর-সুস্থ-নিরাপদ জীবন যাপন করতে লজ্জা করেনা? লজ্জা করেনা, দেশের জনগণের জন্য সঠিক চিকিৎসার বন্দোবস্ত না-করে, এই দেশের জনগণের টাকা নিয়ে হালকা জ্বর, সর্দি আর পাছার ফুঁড়া কাটানোর জন্য বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করতে? লজ্জা নেই, হে হারামির দল, দেশের অসহায় দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ করে না-দিয়ে, এই দরিদ্র জনগণের টাকায় আপনাদের ছেলে-মেয়েদের বিদেশে পড়াশোনা করাতে?

হে আমার রাষ্ট্রের স্বার্থান্বেষী নেতা-নেত্রীগণ, আপনারা কি বুঝতে পারেন একজন দরিদ্র বৃদ্ধ পিতার ভেজা চোখের শুষ্ক ভাষা? বুঝতে পারেন, একজন স্বপ্নাতুর মায়ের বুকের ভেতরে বুনা সহস্র রঙিন স্বপ্নের অসহায় হাহাকার? আমি আমার এ-সকল প্রশ্নের খুব শীঘ্র-ই উত্তর চাই। চাই, কলমের বিপক্ষে কলমের জবাব। আর তা-না-হলে হলে ভেবে নিবো, সবকিছু আপনাদের চক্রান্ত; আপনাদের গভীর ষড়যন্ত্র এই দেশটাকে ধ্বংস করার। যদি 'প্রশ্নফাঁস'-এর মতো একটি গর্হিত অপরাধের পরও আপনারা প্রকাশ্যে মিথ্যাচার করতে পারেন; বলতে পারেন- "না, 'প্রশ্নফাঁস' হয়নি।" তখন আমি বলবো- এই 'প্রশ্নফাঁস'-এর মধ্য দিয়েই আপনারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার সূচনা করছেন। প্রথমে 'প্রশ্নফাঁস' করে একদল নষ্টদের প্রশ্ন সরবরাহ করেছেন; তারপর এই সকল নষ্টদের ধারাবাহিকভাবে মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষাক্ষেত্রে পড়ার সুযোগ করে দিয়ে, দেশের প্রকৃত মেধাবীদের বঞ্চনার সাথে তাদের প্রতি অন্যায়, অবিচার করছেন। এবং পড়াশোনা পর, অবশেষে এই-সকল নষ্টদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নিয়োগদান করে, রাজনীতিসহ সর্বক্ষেত্রেই নষ্টদের বিচরণের মধ্য দিয়ে, আপনারা দেশটাকে ধ্বংস করবেন।

এই-সকল নষ্টদের সাথে আপনাদের গভীর সখ্য। দোহাই আপনাদের, সকল নষ্টামির খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসুন। দেশের অসহায় জনগণের জন্য ভালো কিছু করুন, আপনারা ওঁদের শেষ আশ্রয়স্থল। আপনারা জানেন না, ওঁরা কতোটা ভালোবাসে, কতোটা শ্রদ্ধা করে আপনাদের। ওঁদের ভালোবাসার মূল্য দিতে শিখুন; মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে, আপনাদের প্রতি ওঁদের শ্রদ্ধাবোধ-কে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না। আপনারা তো জানেন-ই মিথ্যার মধ্য দিয়ে অতীতে কেউ কখনও-ই চূড়ায় উঠতে পারেনি; পারলে-ও জনগণের বাস্তবিক অভিশাপে ধ্বংস হয়েছে সকল মিথ্যার পাহাড়। দোহাই আপনাদের, এই দরিদ্র দেশের লক্ষ-লক্ষ দিগভ্রান্ত তরুণ-তরুণীদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠ আদর্শবান হবার চেষ্টা করুন। এই-সকল তরুণ-তরুণীরা বঙ্গবন্ধু, সোহরাওয়ার্দী, গান্ধীজী, আবুল কালাম, নেলসন, ওবামার মতো শতশত অবর্তমান আদর্শবানদের অনুভব করে, অনুসরণ করে। দোহাই লাগে, ওঁদের বর্তমান শ্রেষ্ঠ আদর্শবান হতে চেষ্টা করুন।


আমি খুব-ই উদ্বিগ্ন, আমার দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে। আমি ভাবি, একটি দুর্নীতিগ্রস্থ রাষ্ট্রের নিকট তরুণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের কতোটা অসহায়বোধ করে এবং পরিবারের কাছে কতোটা বোঝা হয়ে যায়, তা-ভেবে, আমি স্বাভাবিক থাকতে পারি না। তখন আমার অজান্তেই মনে প্রশ্ন জাগে, দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 'জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়', এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে, আমার দেশের যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আছেন, উনার কি মাঝেমাঝে মনে হয় না, এই অসহায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিছু করার? যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়ে জড়ানো নৈতিকতার বস্ত্রগুলো, একে একে রাষ্ট্রের ক্ষমতাবানরা খুলে নিয়ে যাচ্ছে, সেই বস্ত্রগুলো ফিরিয়ে কিংবা দান করার জন্য কি কেউ নেই? তখন আমার সুপ্ত হৃদয়, মহামান্য রাষ্ট্রপতিসহ রাষ্ট্রের মুখ্য ব্যক্তিদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বাস্তবতাকে প্রশ্ন করে- "ওঁরা কি তবে রাষ্ট্রের রাজপথ ফাঁকা করে, রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স আটকে রেখে জনগণকে যাতনা দিয়ে রাস্তায় পূর্ণ প্রোটোকল নামক অশান্তির সৃষ্টি করে সুন্দর চকচকে গাড়িতে করে যাবার জন্যেই?

বর্তমান বাংলাদেশের চাকরির বাজারের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ডিগ্রি পাস করা হাজার-হাজার শিক্ষার্থীরা ভালো কোনও চাকরির জন্য আবেদন-ই করতে পারছেন না; কেননা, আজকাল লক্ষ-লক্ষ এ-প্লাস প্রাপ্ত অনার্স, মাস্টার্স করা শিক্ষার্থীদের ভিড়ে ডিগ্রিপাস করা শিক্ষার্থীদের কোনও মূল্যই নেই। তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগে, কী লাভ অনার্স, মাস্টার্স-এ আসন বৃদ্ধি না-করে শিক্ষাব্যবস্থায় ডিগ্রির জন্য আসন বরাদ্দ রাখার? তখন অনেকেই বলতে পারেন, এ-সব ভাবনা সরকারসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের ব্যবস্থাপকরা ভাববেন। আর ঠিক তখন-ই আমি তাদের উদ্দেশে বলি- সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তাদের কী আর এগুলো নিয়ে ভাবার সময় কিংবা সুযোগ আছেরে, ভাই! সরকার তো তাদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করণের বড় বড় প্রজেক্ট নিয়েই ব্যস্ত। যেরকমটা বাংলাদেশে সব সরকার-ই করেছিল। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় তো ছোট-ছোট ক্লাসের 'প্রশ্নফাঁস' দমনসহ 'প্রশ্নফাঁস'-এর ব্যর্থতা ধামাচাপা দিতেই অস্থির হয়ে যাচ্ছে; উচ্চশিক্ষার উন্নয়ন কিংবা শিক্ষাখাতকে কিভাবে আধুনিক, যুগোপযোগী কিংবা আন্তর্জাতিক মানের করা যায়, এগুলো ভাবার সময় কই?

আমার এই লেখাটি পত্রিকা কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে পড়ে, আমার আত্মীয়স্বজন কিংবা অন্যান্যরা অন্যবারের মতো হয়তো বলতে পারেন, "কেনোরে ভাই, দেশের সমস্যার কথা বলে, নিজের উপর সমস্যার সৃষ্টি করছিস? দেশের সমস্যা, দেশের জনগণকে সমাধান করতে দে।" তাঁদের উদ্দেশে আমি পূর্বে যা বলতে পারিনি, আজ বলবো- এই দেশটি আমার, আমাদের। আমার দেশের বেশিরভাগ জনগণ-ই তাদের নিজেদের নিয়েই ভাবতে পারেন না; সেখানে তাঁরা কী করে দেশকে নিয়ে ভাববেন! আমি যেহেতু ভাবতে পারছি, লিখতে পারছি; দোহাই আপনাদের ঈশ্বরের, আমাকে ভাবতে দেন, আমাকে লিখতে দেন। তখন আমার আত্মীয়রা, আমার অনিরাপদ ভবিষ্যৎ ভেবে, আমাকে অনেকটা ধমকের সুরেই বলতে পারেন- "নিজেকে নিয়ে ভাবো, নিজের পরিবারকে নিয়ে। বিপদ ডেকে এনে নিজের ও নিজের পরিবারের ক্ষতি করোনা। তাদের মতো জীবনটা চালিয়ে নাও, যারা পড়াশোনা করে, ভালো চাকরি-টাকরি করে, সকল সমস্যা সহে, কোনও প্রতিবাদ না-করেই জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছে, তাদের মতো হও।"

তখন আমি আমার আত্মীয়দের প্রতি শেষবারের মতো বলবো- পরাধীন, ভীরুদের মতো কাপুরুষজনোচিত জীবন আমার প্রয়োজন নেই। আমি জাতির পিতার সন্তান, আমি আমার পিতার আদর্শ বিরুদ্ধ হতে পারিনা।

তখন হয়তো তাঁরা বলবেন- "তাহলে, ৭৫-এর ১৫-ই আগস্ট মাথায় রেখে প্রস্তুত হও।"

তখন আমি হেসে হেসে বলবো- আছি-ই তো।

সরোজ কান্তি দাশ: শিক্ষার্থী। 

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত