ঝুমুর রায়

০৭ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৯:২৪

সেই সময়, এই সময়

চূড়ি লাগব নি? লাগব নি গো চুড়ি?... গলির মুখ থেকে এমন ডাক ভেসে আসত মেয়েলি গলায়। ছোটবেলার সেই রোদেলা সকাল কিংবা নিঝুম দুপুরে চুড়িওয়ালির সে ডাক সময়গুলোকে বড্ড সুন্দর করে দিত। পাশের বাড়ির দিদিদের বারান্দায় চুড়িওয়ালি তার সম্ভার সাজাত। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ... রংগুলো যেন কাঁচের চুড়িতেই নামের সার্থকতা তুলে ধরে বেশি! গাঢ় রংয়ের চুড়িগুলো মন টেনে নিতো কোথায় যেন!

আজকাল 'শপিং মল' নামক বিরাট যত কিছুই গড়ে উঠুক না কেন, আমাদের শৈশব, কৈশরের সেই চুড়িওয়ালি কিংবা লেইসফিতা ওয়ালার বাক্সের মোহনীয় রূপ কোথাও খুঁজে পাই না!

"আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম"... আহা, চিঠি! এক সময় নাকি কবুতরের পায়ে চিঠি বেঁধে ছেড়ে দেয়া হত। কবুতর কীভাবে চিঠির প্রাপক খুঁজে বের করত, সে আমার মনে আজও বিস্ময় জাগায়! কবুতর যুগ পাই নি, তবে আমরা চিঠি লিখতাম, চিঠি পড়তাম। সাদা কিংবা রঙ্গীন কাগজে কালো বা নীল, সবুজ কালির বুননে মালার মত সাজানো থাকত কথার গাঁথুনি। নতুন চিঠি বার বার পড়লেও পুরানো হত না। দোরঘন্টা বাজলেই প্রতীক্ষার চাহনি, ডাকপিয়ন এল বুঝি! এই ডাকপিয়ন ছিল আমাদের দেবদূত। স্বর্গের বার্তা বয়ে আনত সে। চিঠির সাথে একবার যার সখ্যতা হয়েছে, মনের গহীনে তার আজো বেঁচে আছে সেই নীল, সবুজ কথামালা।

'পত্রমিতালি' বলে একটা শব্দ ছিল, মিষ্টি শব্দ। সেই পত্রমিতালীর যুগে কতজন যে কত মিতা খুঁজে পেল। হয়ত কোন পরিচয়ই নেই, একেক জনের বসত একেক জায়গায়, দু'জনের ভাবনা, দু'জনের চাওয়া, না বলা কথাগুলো একাকার হয়ে দু'প্রান্তের দু'জনকে এক করে দিত এই পত্রলিখন। বন্ধুতায়, সখ্যতায়, প্রেমে, প্রণয়ে, চিঠি ছিল এক উজ্জল মাধ্যম।

এখনকার হোয়াটস অ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার যতই প্রযুক্তি সৃমদ্ধ হোক না কেন আমাদের সেই হাতে লেখা চিঠির মাঝে লুকানো এক রাশ ভাল লাগা, হৃদ্যতা, এ শুধু তারাই অনুভব করবে চিঠির সাথে সখ্যতা হয়েছিল। আমরা টেপ রেকর্ডারে গান শুনতাম, শুনতাম রেডিও। এক সকালে গান না শুনলে মনে হত যেন বিশাল কিছু বাদ পড়ে গেল। রেডিওতে অনুরোধের আসর হত, মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা নিয়ে অনুষ্ঠান হত, কী ভাল লাগা আমাদের! একা না, ভলিউম বাড়িয়ে টেপ রেকর্ডারে গান শুনতাম পাড়াশুদ্ধ। মাঝে মাঝে ক্যাসেটের তার প্যাঁচিয়ে গেলে তা খোলার জন্য কত কসরত! আর সেই সময়ের গানগুলো ফিরত সবার মুখে মুখে। ছোট থেকে বড় সবাই পরিচিত ছিল হিট গানগুলোর সাথে। একই গান বারবার শুনতেও ক্লান্তি ছিল না,বরং ভাল লাগা ছিল। ছিল ক্যাসেট কেনার ধুম। কোন ক্যাসেট বের হল, কী নতুন গান এল, প্রিয় শিল্পীর কোন ক্যাসেট এল... এসবে আগ্রহের কমতি ছিল না কোন! কী মধুর সময় ছিল! এখন হাতের মুঠোয় সব, গান বাজে এখন সিডিতে, কম্পিউটারে। কোন গান হিট হয়, তার রেশ ক'দিন থাকে, সিডির দোকানে ভিড় এখন কেমন, সে খবর জানি না। তবে এটা জানি যে আমাদের সেই গান শোনার দিনগুলো হারিয়ে গেছে!

এই প্রজন্ম হয়ত ভাবতেই পারবে না যে আমরা একসময় বিটিভির মুগ্ধ দর্শক ছিলাম। হুম, বিটিভি, বাংলাদেশ টেলিভিশন। কী টানত আমাদের বিটিভি! এখন এত এত চ্যানেলের মাঝে কোথাও সেই ভাল মানের নাটক দেখি না যা বিটিভি আমাদের দেখিয়েছে। এইসব দিনরাত্রি, সকাল-সন্ধ্যা, ঢাকায় থাকি, অয়োময়, রূপনগর, বার রকম মানুষ, যত দূরে যাই, গ্রন্থিকগণ কহে, কোন কাননের ফুল, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই,সংশপ্তক..., আরো কত নাটক! চরিত্র আর সংলাপের সাথে অভিনেতা অভিনেত্রীরা হয়ে উঠেন আমাদের আপনজন, কাছের মানুষ যেন! আমাদের একজন 'ম্যাকগাইভার' ছিল, প্রতি বুধবার আমরা তার অপেক্ষায় থাকতাম, রাত নয়টায়। ছিল 'ছায়াছন্দ', 'আনন্দমেলা' ছিল, 'মাটি ও মানুষ' 'ইত্যাদি', 'শুভেচ্ছা', 'ভরা নদীর বাঁকে'... এখনো গেঁথে আছে মনে।

আমরা ভিডিওতে সিনেমা দেখতাম।ক্যাসেট ভাড়া করে আনা হত, যাদের বাসায় ভিডিও নেই, তারা ভিডিও আনতাম ভাড়া করে। পাড়ার কোন এক বাসায় আজ ভিডিও দেখা হবে, তো আশেপাশের কয়েকটা বাসায় ভিডিও দেখার নিমন্ত্রণ। সবাই মিলে সিনেমা দেখা। 'অঞ্জলি,' 'ছোট বউ', 'গুরুদক্ষিণা', 'শুভ কামনা', 'আশা', অমর প্রেম', 'অমর সঙ্গী', 'আক্রোশ', 'একান্ত আপন'... আমার ভিডিওতে সিনেমা দেখার তালিকাটা বেশ বড়। দু'দিন বা তিনদিন পরে যেদিন ভিডিও ফেরত দেয়া হল, বাসায় সেদিন শোক দিবস যেন! সিনেমার গানগুলো, সংলাপগুলো বার বার মনে পড়ত। পাড়ার ক্লাবে বা কোন অনুষ্ঠানে রাতে ভিডিও দেখানোর ব্যবস্থা থাকত তখন! ইশ, কী সময়টাই না কাটিয়েছি আমরা!

লিখতে গেলে এমন আরো কত গল্প লেখা যায়! সময় বদলায়, বদলাবেই, নিয়মই এই। আমাদের সেই রঙ্গীন শৈশব, প্রাণবন্ত কৈশোর, অনেক পিছনে পড়ে আছে। তবু যেন এই সময়ের সাথে সেই সময়কে মিলালে মনে হয়, প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে ঠিকই, সময় এক লাফে এগিয়েছে অনেক খানি, হাতের মুঠোয় বন্দী করেছি আমরা বিশ্বকে, কিন্তু সেই সময়ের লেইসফিতা, চিঠি, টেপ রেকর্ডার, রেডিও, নাটক... এমন অনেক কিছুর যে মধুরতা, সবাই মিলে ভাগ করে নেবার আনন্দ, যুগের হাওয়া বদলের সাথে সেই 'মধুরতা' হারিয়েছে অনেকটাই।

আমরা জীবনের যে স্বাদটুকু পেয়েছি ছোটবেলায়, এখনকার শৈশব, কৈশোরে অনেক সীমাবদ্ধতা। খোলা আকাশ নেই, নেই খোলা মাঠ, অকৃত্রিম যে জগতে আমাদের বেড়ে উঠা, এই প্রজন্ম নানা কারণেই তা থেকে বঞ্চিত। বদলে যাবার চাহিদা আছে, সেই চাহিদায় বদলাচ্ছে পরিবেশ, হারাচ্ছে অনেক কিছু, আবার নতুন অনেক কিছু পাচ্ছিও আমরা। আজকালকার শিশুদের কাঁধে বইয়ের বোঝা, বড় হওয়ার পথে বিনোদন নেই-ই বলতে গেলে। কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা সেই নির্মল আনন্দ পাচ্ছে কী যেমন পেয়েছি আমরা! আমাদের আগামী প্রজন্ম বেড়ে উঠুক সকল সীমাবদ্ধতা জয় করে, বেড়ে উঠুক ভালবাসায়, বাঁচুক হৃদ্যতায়..

আপনার মন্তব্য

আলোচিত