আমিনা আইরিন

১০ জানুয়ারি, ২০১৬ ০১:৪৬

ডিজিটাল বাংলাদেশ বনাম সাইবার ক্রাইম

বর্তমান যুগ আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয় এমন পদক্ষেপের।

আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে, বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার আবশ্যক। ঘরে বসে বাস বা ট্রেনের টিকেট সংগ্রহ, অনলাইনে ভর্তি আবেদন, আউটসোসিং এর মাধ্যমে সচ্ছল হওয়া, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি নানা বিষয়ে সবধরনের তথ্য পাওয়া, দূর দেশে থাকা স্বজনের শুধু কণ্ঠস্বরই নয় জীবন্ত ছবি দেখতে পাওয়ার মত আনন্দও উপভোগ করা যাচ্ছে প্রযুক্তির প্রসারের কারণে।

পৃথিবীতে সবকিছুরই ভালো-মন্দ দুটি দিক থাকে। ঠিক তেমনি তথ্য প্রযুক্তিরও ভালো-মন্দ দুটি দিক আছে। এই তথ্য প্রযুক্তি একদিকে যেমন আমাদের জীবনকে সহজ সরল সাবলীল করে তুলছে ঠিক তেমনি এর বহুল ব্যবহারের ফলে দিন দিন বেড়ে চলছে সাইবার ক্রাইম।

কি এই সাইবার ক্রাইম? সহজ কথায় বলতে গেলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে সংঘটিত হওয়া অপরাধগুলোই মূলত সাইবার ক্রাইম। বর্তমান বিশ্বে বহুল আলোচিত কয়েকটি সাইবার ক্রাইম হলো - ১. সাইবার পর্ণোগ্রাফী ২. হ্যাকিং ৩. স্প্যাম ৪. বোমাবাজি ৫. একশন গেম ইত্যাদি|

আমাদের দেশেও সাইবার ক্রাইম ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। আজকাল প্রায় সবার হাতেই র্স্মাট ফোন, অতি সহজেই ল্যাপটপ কম্পিউটার পাওয়া যায়। ইন্টারনেট ব্যবহারের সহজলভ্যতা একদিকে যেমন আমাদেরকে সাহায্য করছে এগিয়ে যেতে, তেমনি এর অন্ধকার জগতের হাতছানি গ্রাস করছে অনেককেই।

নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আর তরুণ বা শিশুদের সেই আকর্ষণ থাকে বেশি। যার ফলে আমরা একটু লক্ষ্য করলে দেখব সংঘটিত হওয়া সাইবার ক্রাইমের বেশিভাগ অপরাধী যেমন তরুণ তেমনি ভুক্তভোগীও কিন্তু এই তরুণ।

প্রযুক্তি ব্যবহারের সহজলভ্যতা এবং এই ব্যবহারের গতিবিধি নির্ধারণের যথাযথ কোন ব্যবস্থা না থাকায় যে কেউ ইন্টারনেটের বিশাল জগতে যেখানে ইচ্ছা সেখানে বিচরণ করতে পারে। যে বয়সে তরুণ বা শিশুদের মানসিক বিকাশ ঘটে, সেই বয়সে তাদের অনেকেই যেমন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিত্যনতুন বিষয় জানতে ও শিখতে পারছে, একইভাবে হয়ত ভুলবশত কিংবা কৌতুহলবশত নিজের অজান্তেই পরিচিত হয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের সাথে। যা তাদের মানসিক বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যার ফলে বাড়ছে বিকৃত মানসিকতা।

তাছাড়া আমাদের বর্তমান যুগের অভিভাবক যেমন কখনো খুব সচেতন, কখনোবা আবার খুব খামখেয়ালি হয়ে ওঠেন। তারা দ্রুত পাল্টাতে থাকা সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে কখনো নিজেদের সন্তানদের খুব শাসন করছেন আবার কখনো খুব সীমিত করে দিচ্ছেন। যার ফলে তাদের সাথে ঠিক বন্ধুত্ব কখনো গড়ে ওঠে না। তাই তারা নিজেদের মনে জাগা প্রশ্ন কিংবা কৌতূহল নিজেদের মত করে মিটিয়ে নেয়। তারা ভালো-মন্দের গোলক ধাঁধাঁয় আটকা পরে যায়।

এইসব তরুণরা কিংবা শিশুরাই কিন্তু পরবর্তীতে জড়িয়ে পরে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে। ২০১৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে সাইবার ক্রাইম এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। বিশ্বের অন্য দেশের মতো আমাদের দেশেও সাইবার ক্রাইম আইন আছে। বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইমের পরিচিতি বা এ সংক্রান্ত অপরাধ দমনের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ আমাদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়। এই আইনে ইন্টারনেট অর্থ এমন একটি আন্তর্জাতিক কম্পিউটার নেটওয়ার্ক যার মাধ্যমে কম্পিউটার, সেলুলার ফোন বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতি ব্যবহারকারীরা বিশ্বব্যাপী একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্যের আদান-প্রদান এবং ওয়েবসাইটে উপস্থাপিত তথ্য অবলোকন করতে পারে।

তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৬ ধারায় বলা হয়েছে, (১) যদি কোনো ব্যক্তি জনসাধারণের বা কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে বা ক্ষতি হবে মর্মে জানা সত্ত্বেও এমন কোনো কাজ করেন, যার ফলে কোনো কম্পিউটার রিসোর্সের কোনো তথ্যবিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তিত হয় বা তার মূল্য বা উপযোগিতা হ্রাস পায় বা অন্য কোনোভাবে একে ক্ষতিগ্রস্ত করে। (২) এমন কোনো কম্পিউটার সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করার মাধ্যমে এর ক্ষতিসাধন করেন যাতে তিনি মালিক বা দখলদার নন, তাহলে তাঁর এই কাজ হবে একটি হ্যাকিং অপরাধ। কোনো ব্যক্তি হ্যাকিং অপরাধ করলে তিনি অনূর্ধ্ব ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন বা উভয়দণ্ড দেওয়া যেতে পারে।

তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে বা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে।

আমাদের দেশের অনেকেই এই সাইবার আইন সম্পর্কে জানেন না। আর যারা জানেন তারা সমাজের ভয়ে নিজের বা আপনজনের সাথে সংগঠিত হওয়া অপরাধের ব্যাপারে চুপ করে থাকে। যার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীর সাজা হয় না। তবে এই আইনকে আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন।

স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশের বড় বাধা এই সাইবার ক্রাইম। তাই সামাজিক অবক্ষয় রোধে এবং স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশে জন্য এই সাইবার ক্রাইমের প্রতিকার ও প্রতিরোধ প্রয়োজন। অপরাধীদের জন্য প্রয়োজন আরো কঠোর আইন এবং শাস্তি বাস্তবায়ন।

অপরপক্ষে ইন্টারনেটের অন্ধকার দিকগুলোর দরজায় তালা লাগানোটাও জরুরী। তাছাড়া অভিভাবকদের সচেতনতা, তরুণ প্রজন্মের সঠিক মানসিক বিকাশই কেবলমাত্র এই সাইবার ক্রাইম বন্ধ করে পারে।

(প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত