সঞ্জীবন সুদীপ

০২ ফেব্রুয়ারি , ২০১৬ ১১:০৮

এই ফাল্গুনে দ্বিগুণ হবো; বই কিনবো, পড়বো

কিছুদিন আগে আমাদের দেশে চাকমা ভাষায় একটি সিনেমা নির্মিত হয়েছিল। সিনেমাটির নাম "মর থেংগারি", My Bicycle। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষায় এই জনপদে এটাই প্রথম সিনেমা। সেন্সরবোর্ড সেই সিনেমাটিকে ছাড়পত্র দেয়নি। যুক্তি, বলা ভালো কুযুক্তি দেখিয়েছিলো, বাংলা অথবা ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষার চলচ্চিত্র অনুমোদনের নিয়ম নেই।এর বিরুদ্ধে তেমন জোরালো প্রতিবাদ হয়নি।ফেসবুকে দু চারজন হাউকাউ করেছিল, তাতে সেন্সরবোর্ডের বড়কর্তাদের কিছু এসে যায়নি। যতদূর জানি, এখনো ছাড়পত্র পায়নি মর থেংগারি। অথচ আমরা সেই জাতি যারা রক্ত দিয়ে ভাষার অধিকার কিনেছিলাম। এ নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই অথচ সেই রক্তস্নাত বিজয়ের ৬৩ বছর পর আমরাই ভিন্ন জনগোষ্ঠীর কণ্ঠরোধ করছি, কেড়ে নিচ্ছি মাতৃভাষায় তার শিল্পচর্চার অধিকার। এখনো ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পায়না। যতদিন পর্যন্ত আমরা প্রত্যেককে গলা ছেড়ে তার মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ নিশ্চিত না করতে পারছি, ততদিন পর্যন্ত রফিক-সালাম-বরকত-জব্বারের আত্মদানের ইতিহাস নিয়ে বড়াই আমাদের সাজেনা।


তখন নটরডেম কলেজে পড়ি। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে দেখতাম কলেজে পড়ুয়া প্রত্যেক ভাষাগোষ্ঠীর ছাত্র তার মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ পেত। তার মাইক হাতে কিছু বলতো। সেইসব কথামালার বিন্দুবিসর্গ না বুঝলেও সেই অনুষ্ঠানের অভিনবত্ব ও উচ্চদর্শন মুগ্ধ করেছিল। এরকমই তো হবার কথা ছিল। জানিনা এখনো সেই আয়োজনটি হয় কিনা।


বাংলা ভাষার বিকৃতি; এই বিষয়টি নিয়ে প্রায়শ কথাবার্তা দেখি। এফএম রেডিও, চটুল নাটক হয়ে ভাষা বিকৃতির যে বিষবাষ্প ঢুকেছিল, তা এরই মাঝে মারণব্যাধি হয়ে ছড়িয়েছে।সাথে আছে ভারতীয় আর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির যৌথ আগ্রাসন, সেই অত্যাচারে দ্রুত রঙ হারাচ্ছে বাংলা ভাষা। সম্প্রতি বাংলা নাটকে হাস্যরসের নামে এমন এক তিতকুটে ভাষার প্রচলন হয়েছে যে ভাষায় আদতে কেউ কথাই বলেনা! মা হয়ে যাচ্ছেন মম, মাম্মি, বাবা হচ্ছেন ড্যাডি আর সুন্দরতম ভালোবাসা হয়ে গিয়েছে লাভ।কারো কারো মত, ভাষা পরিবর্তন হবেই, প্রবহমানতাই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখে। হয়তো তাই। তবে আমি আমার মাকে মম ডাকতে পারবোনা। আমার আশঙ্কা হয় মম ডাকলে আমি সেই পরিচিত ঘেমো ঘ্রাণ পাবোনা, তার বদলে কড়া পমেটমের গন্ধ আমাকে অতল বিস্মৃতিতে ডুবিয়ে দিবে। নদীর প্রবহমানতা বজায় রাখার জন্য আমি তাতে কারখানার ড্রেন যুক্ত করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনা।


বইমেলা শুরু হলো আজ। এবারের বইমেলা নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। গতবছর এই মেলা থেকে ফেরার পথেই খুন হয়েছিলেন অভিজিৎ রায়।আমাদের সবচেয়ে বড় দুই সার্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসব বর্ষবরণ ও বইমেলা। এ দুটো আমাদের শক্তির সবচেয়ে বড় জায়গা বলেই মৌলবাদীদের ভীতি এবং প্রধান দুই টার্গেট। অনেকবারই তারা এই দুই উৎসবকে টার্গেট করেছে। নাশকতা করে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে, ভয় দেখিয়ে মানুষকে বিমুখ করার নীলনকশা করেছে।রমনার বটমূলে বোমা হামলা করেছে, বইমেলা থেকে ফেরার পথে কুপিয়ে জখম করেছে হুমায়ূন আজাদকে, খুন করেছে অভিজিৎ রায়কে, যৌননিপীড়ন করেছে বর্ষবরণের আনন্দযজ্ঞে।এবারের মেলাও আসছে বুক দুরুদুরু আশঙ্কার মেঘ উড়িয়ে।

আশঙ্কা আছে, এক বছরেও অভিজিৎ রায়ের খুনের সুরাহা হয়নি, আছে তার অভিমান আর ক্ষোভ। তাই বলে কি বইমেলা বর্জন করবো? কোনোভাবেই না। যারা দীপনকে খুন করেছে, অভিজিতকে খুন করেছে, টুটুলকে খুন করতে চেয়েছে তারা তো এটাই চায়, আমরা যেনো মেলায় না যাই, আমরা যেনো বই না পড়ি, আমরা যেনো অন্ধকারে তলিয়ে যাই, যেনো মুক্তচিন্তা করতে ভুলে যাই। আমরা তাই মেলায় যাবো। এই ফাল্গুনে যাবো দ্বিগুণ হয়ে। বই কিনবো, বই পড়বো, বই উপহার দিবো আর কবর খুঁড়ব চাপাতিবাদের, মৌলবাদের।


চমকে ওঠার মতো রকটা তথ্য দেখলাম, গড়ে প্রতি পনেরো দিনে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে!

যখন কোনো ভাষায় কথা বলা শেষ ব্যক্তিটি মারা যায় তখন ভাষাটিও পৃথিবীতে মৃত হয়ে যায়। এরকম করে অজস্র ভাষা হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাবে আরো অনেক ভাষা। মন থেকে চাই পৃথিবীর সকল ভাষা বেঁচে থাকুক, প্রিয় পৃথিবী বেঁচে থাকুক তার বৈচিত্র্য নিয়ে।

ভাষার মাসের শুভেচ্ছা।

সঞ্জীবন সুদীপ: প্রগতিশীল আন্দোলন ও গণজাগরণ মঞ্চ কর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত