ভায়লেট হালদার

০৮ মার্চ, ২০১৬ ০২:০৪

মর্যাদায় গড়ি সমতা

বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে পাল্টে গেছে মানুষের জীবন ব্যবস্থা। কিন্তু নারী সম্পর্কে প্রচলিত কুসংস্কার বদলায়নি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে।

নারী যাতে স্বাবলম্বী না হতে পারে, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি না আসে নারীর উপর পুরুষের পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করার জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নেতৃস্থানীয়রা ধর্ম, ঐতিহ্য, ভাষা, পোশাক, সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, খাদ্য, রাষ্ট্র ও আইন- এগুলোকে ব্যবহার করে নারীকে একটার পর একটা শেকল পরিয়ে নারীকে বানিয়ে রেখেছে অবলা প্রাণী, সেবাদাসী ও যৌনদাসী।

মর্যাদার দোহাই দিয়ে নারীকে বন্দি করেছে চার দেয়ালের ভেতরে ও রান্নাঘরে। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানুষের কূটকৌশলে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে নারী। চার দেয়ালের মধ্যে সারাদিনের গৃহস্থালী কাজ করেও তার শ্রমের মূল্যায়ন করে না ঘরের সদস্যরা।

নারী আর কি করে- রাঁধে, বাড়ে আর খায়; বলে আমার বউ কোন কাজ করে না। উপরন্তু কোন কোন নারীকে সইতে হয় শারীরিক ও মানুষিক অত্যাচার। অনেক বাবা-মা মনে করে বিয়েই নারীর একমাত্র গতি অর্থাৎ কন্যা সন্তানটির ভবিষ্যতে খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আর্থিক সামর্থ্যবান পাত্রকে সুপাত্র বলে বিবেচনা করেন।

জীবনসঙ্গী নির্বাচনে নারীকে স্বাবলম্বী মনে করে না পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অভিভাবকেরা, বিবাহের জন্য কন্যার মতামতের কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না। মেয়েটির বয়স যাই হোক না কেন এমন সামর্থ্যবান পাত্র পেলে হাতছাড়া করতে চান না। অথচ কোন বাবা-মা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারেন না যে তাদের নির্বাচিত সুপাত্রটির সঙ্গে তার আদরের কন্যা আজীবন সুখে শান্তিতে বাস করবে অথবা কন্যাটিকে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে তাড়িয়ে দেবে না।

সমাজে বহুল প্রচলিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাক্য হলো: “মেয়েমানুষ তুমি যতই উচ্চশিক্ষিত হও না কেন খুন্তি তোমাকে হাতে ধরতেই হবে।” এই বাক্যটা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে বসবাসরত প্রতিটি মেয়েকে প্রতিদিন একাধিকবার শুনতে হয় পাড়া-পড়শি ও আত্মীয়-স্বজনদের মুখে। অর্থাৎ মেয়েটিকে একজন রাঁধুনি হতে হবে, মেয়েটির প্রধান কর্ম হবে রান্না করা; কোন হোটেল বা রেস্তরায় কুক বা শেফ হিসেবে নয়, পরিবারের নির্দিষ্ট কয়েকজন মানুষের জন্য রান্না করা। যার বিনিময়ে নারী পাবে থাকা-খাওয়া আর পরিধেয় বস্ত্র।

একবার ভাবুন তো বিয়ের পরে দু'বেলা দু'মুঠো খাবারের বিনিময়ে ঘর সংসারের গৃহস্থালি কাজের দায় কেন নারীর উপর চাপিয়ে দেয়া হবে? সংসার নারী-পুরুষ উভয়ের। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই স্ব স্ব যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র বেছে নেবে, উভয়েই সমঝোতার মাধ্যমে ঘর- গৃহস্থালির কাজ করবে।

কর্মজীবী নারী দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি ও ঘরের সচ্ছলতা আনে। যদি পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষ ব্যক্তি কখনো কোন কারণে কলাপস করে, চাকুরী হারায় তবে ঐ পরিবারের অবস্থা কি হবে? পুরো পরিবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।

নারীকে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ দিন। নারীর পছন্দ অনুযায়ী কর্মগ্রহণে উৎসাহিত করুন। অর্থনৈতিক মুক্তি শুধুমাত্র নারীকে স্বাবলম্বী করে না, সচ্ছল হয় পরিবার এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।

আমি বলছি না সকল নারীকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। নারী তার মেধা ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ করবে, সকল কুসংস্কার ঝেটিয়ে বিদায় করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। খুব বেশী লেখাপড়া করার সুযোগ না থাকলে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। টেইলারিং, হাঁস-মুরগী গবাদি পশুপালনের মত কাজ করে নিজের তথা পরিবারের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। নারীর যে হাত দুটি হতে পারে দেশের অর্থনীতির একটি অংশ সে হাত দুটিতে কোন স্বার্থে পড়ানো হয় শেকল?

এ দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী এবং সিংহভাগ নারী ঘরের বাইরে শ্রম দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই নারীদের মেধা ও শ্রম কোন কাজেই আসে না। ফলে এরা সমাজের বোঝা হয়ে দিন কাটাচ্ছে। দুবেলা দুমুঠো খাবারের নিশ্চয়তার জন্য নারীকে ছোটবেলা থেকে শেখানো হয় অন্যের বাড়ীর খুন্তি ধরার। অর্থাৎ তুমি দাসী, সমাজের পুরুষ মানুষগুলোর কথামত ওঠাবসা ও তাদের সেবা করা ও দাসত্ব করার জন্যই যেন জন্ম হয়েছে। তোমার মাঝে জাগিয়ে তোলে বিদ্যাশিক্ষার প্রতি অনীহা। পুরুষতান্ত্রিক শিক্ষার বীজ তোমার ভেতরে সুকৌশলে বপন করে দেয়া হয়, বিয়ে শব্দটি তোমার মাথায় চার দেয়ালের মাঝে বন্দি পরাধীন জীবনকে মেনে নিতে শেখায়।

নারী তুমি ভেবে দেখো, তোমার সহজ সরল ভাবনার জন্য, অসচেতনভাবে সবকিছু মেনে নেওয়ার জন্য, জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়ার জন্য তুমি হয়ে পড়েছো পরাধীন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্রীড়ানক।

নারী তুমিই পারো সব কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে তোমার শিক্ষা, মেধা, শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য অনুযায়ী ঘরের বাইরে শ্রম দিয়ে স্বনির্ভর হতে। তুমিও পারো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, সমাজ উন্নয়নে পুরুষের সমান একজন অংশীদার।

মানুষ যে মূল্যবোধ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে সে মূল্যবোধের প্রকাশ থেকে কেন বঞ্চিত হবে নারী? আসুন, নারী-পুরুষ সবাই মিলে মর্যাদায় গড়ি সমতা।

ভায়লেট হালদার : নারীবাদী লেখক ও 'আরক' পত্রিকার প্রধান সম্পাদক।

এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত