তোফাজ্জেল অভি

২৪ মার্চ, ২০১৬ ১২:২১

ধর্ষক, দর্শক ও তনুরা

একটি সমাজে যখন কোন অপরাধ বা অপকর্ম হয়ে থাকে তখন যদি জনগণ আর প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে ধরে নিতে হবে এমন ঘটনা বারবার পুনরাবৃত্তি হওয়ার পথ তৈরি হল এবং তাই হয়ে থাকে সাধারণত। অপরাধী যতটা অপরাধ প্রবণতার কারণে অপরাধের প্রতি আকৃষ্ট হয় তার চেয়ে বেশি হয় আশপাশের নীরবতায়, বিচারহীনতার কারণে। পূর্বের অভিজ্ঞতা,দৃষ্টান্ত এক্ষেত্রে অপরাধ প্রবণতার মাত্রা নির্ধারণ করে দিতে বড় ভূমিকা পালন করে।

পূর্ব অভিজ্ঞতা যদি হয় অপরাধী পার পেয়ে যাওয়ার,অভিজ্ঞতা যদি হয় বিচারহীনতার কিংবা আক্রান্তের নিরাপত্তাহীনতার তখন সে অপরাধ বা অপকর্ম বারবার চর্চা হতে থাকে। ন্যায় বিচারের অভাবে যেমন বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠে, তেমনই দৃষ্টান্তমূলক বিচার ভবিষ্যতে অপরাধ প্রবণতার হার কমিয়ে দেয়।

লক্ষ্য করে দেখেছি ধর্ষণ, হত্যা, ছিনতাইয়ের মত যত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আছে সবগুলোর মধ্যে একটি প্রক্রিয়াগত মিল রয়েছে। যখন কোন অপরাধ হয় এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন তখন একটি অংশ ধরেই নেয় এমন অপরাধ করলে তাকে কেউ কিছু করতে পারবেনা, যার ফল স্বরূপ তারা সে অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়। ভাবতে অবাক লাগে একটি সমাজে ঠিক কতটুকু নৈতিক অবক্ষয় হলে হত্যা-ধর্ষণের মত মানবতা বহির্ভূত কাজ নাওয়া-খাওয়ার মত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে।

আমরা দিন দিন অপরাধ-সহিষ্ণু হয়ে উঠছি। এই দেশ অপরাধীদের জন্য নিরাপদ স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে, অপরাধী অপরাধ করার আগে কিংবা পরে যখন নিজেকে নিরাপদ মনে করে তখন সে দেশ বা সমাজ মানুষের জন্য অনিরাপদ আর বসবাস অযোগ্য হয়ে উঠে। সব কিছু দেখে-শুনে বোবা বধির হয়ে থাকার চেষ্টা কিংবা আমরা ভালোই রপ্ত করেছি কিংবা আমরা ধরেই নিয়েছি বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার কাছ থেকে কিছু আশা করার নেই, এর থেকে উত্তরণের কোন পথ নেই। তাই চুপ করে থাকাই ভালো। বিচারহীনতার অজুহাত দেখিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার ভালই উপায় বের করেছি আমরা।

সম্ভবত আইনস্টাইনের উক্তি  “এই পৃথিবী কখনো খারাপ মানুষের খারাপ কর্মের জন্য ধ্বংস হবে না , যারা খারাপ মানুষের খারাপ কর্ম দেখেও কিছু করেনা তাদের জন্যই পৃথিবী ধ্বংস হবে”। আসলেই, পৃথিবীতে খারাপ মানুষের সংখ্যা খুবই কম, কিন্তু অল্প মন্দের খারাপ কর্মে ভালো মানুষগুলোর নীরবতার কারণেই তাদের আধিপত্য সবখানে। একটি সমাজ যদি ধর্ষক আর দর্শকে ভরে উঠে তখন সে সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠা অস্বাভাবিক কিছু না। আমাদের বিচার চাওয়াটা যদি নাক ছিটকানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, দেশপ্রেম কিংবা দেশ নিয়ে ভাবনা “এই দেশের কিছু হবেনা” বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তবে এই বিচার ব্যবস্থার দোষ আমি দিবনা। দোষ আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের, দোষ আমাদের অচেতনতায়। অধিকার/ ন্যায় কেউ কাউকে আপনা আপনি দিয়ে দেয় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়।

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ইসলামের ইতিহাস ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনুর কাপড়ে কি অসামঞ্জস্য ছিল?  মেয়েটিকে কেন এভাবে মরতে হল?  কিংবা এর আগে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি গার্লস হাই স্কুল এন্ড কলেজের ক্লাস ওয়ানের এক ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়েটির কাপড়ে কি অসামঞ্জস্যতা ছিল? তাকে এভাবে কেন মরতে হয়েছিল নরপশুর থাবায় আক্রান্ত হয়ে? ঘটনার শুরু বর্ষবরণের নারীর উপর নারকীয় গণলাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে,  গারো তরুণীকে মাইক্রো-বাসে জোর করে তুলে ৫ জন পুরুষের নির্বিচারে যৌন আক্রমণ সচেতন মানুষদের হতবাক করলেও নীরবতা আর বিচারহীনতা আমাদের তা ভুলিয়ে দিয়েছে।

পুরো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেন উঠেপড়ে লেগে আছে নারী লাঞ্ছনায়। এর আগে বর্ষবরণে নারী লাঞ্ছনার প্রতিক্রিয়ায় মিডিয়া ব্যাপক প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করলেও অদ্ভুত কারণে তনুর ঘটনায় মিডিয়ার লজ্জাজনক ভূমিকা লক্ষ্য করছি । ক্রিকেট উন্মাদনার মধ্যে এমন নিউজে চাহিদা না পাওয়ার ভয়ে এমন নীরবতা নাকি ঘটনাস্থলের আগে সেনানিবাস শব্দটি থাকায় এই নীরবতা সে হিসেব এখনো মেলাতে পারছিনা। সভ্য বিশ্বে আইন, বিচার,শাসনের পর মিডিয়ার ভূমিকা অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়। সুষ্ঠু আইন,বিচার,শাসন প্রতিষ্ঠাতেও মিডিয়ার ভূমিকা অপরিহার্য। কিন্তু সে মিডিয়া যখন হয় পিঠ-বাঁচানো ভূমিকা পালন করে তখন জনগণের করণীয় নিজেদেরকেই ঠিক করে নিতে হয় । বিচার, সরকার, মিডিয়া কে বাধ্য করতে হয় অন্যায় প্রতিরোধের, ন্যায় প্রতিষ্ঠার।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে মেডিকেল ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় পুরো ভারতে তোলপাড় হয় তখন আমাদের দেশেও সেই ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছিল। সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু অবাক হতে হয় নিজ ভূমিতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার পরেও আমরা নির্বাক।

কিছুই যেন করার নেই, মানব-বন্ধন,মিছিল এগুলো কেমন জানি এখন হাস্যকর আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে প্রশাসন আচরণে যেন অন্যায়কারী/­ যৌন-নিপীড়কদের ভূমিকা গ্রহণ করে। প্রশাসনের ভূমিকা দেখে বুঝার উপায় থাকেনা তারা অন্যায়কারীদের দমন করতে চায় নাকি তাদের রক্ষা করতে চায়। নারীকে তেঁতুল বলে অবমানকারী ধর্মীয় গুরুর আড়ালে নারী বিদ্বেষীরা যে সমাজ বা দেশে রাজনৈতিক ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পায়, জনগণের মনোনীত নেতৃত্ব যখন এদের কাছে দোয়া চাইতে যায় তখন প্রশাসনের এমন মনোভাবের রহস্য অনেকটা ধারণা করা যায়।

এই সমাজ এখনো নারীকে ভোগ্যপণ্য মনে করে। বিশ্বাস করতে চায়না ঘরের বাইরেও নারীর আলাদা জীবন থাকতে পারে। নারীর ধর্ষিত হওয়ার কারণ হিসেবে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির দিকে আঙ্গুল না তোলে এখনো নারীর পোশাকের দিকে আঙ্গুল তোলে দেখায়। এখনো বেশিরভাগ পরিবার নিজের মেয়েকে স্বামীর ঘরে রাণীর মতো দেখতে চায়, কিন্তু ছেলের বৌ কে কাজের মানুষ হিসেবে প্রত্যাশা করে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে টইটুম্বুর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মধ্যে তাই বিচার চাওয়াটা হাস্যকর মনে হয়, ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করাটাও। এই বিচার ব্যবস্থাও-তো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বাইরে নয়। তাই তনুদের  শুধুমাত্র একটি দেহ হয়েই বাঁচতে হয়, মরতেও হয় একটি দেহ হয়ে।

লেখক: অনলাইন এক্টিভিষ্ট, চট্টগ্রাম

আপনার মন্তব্য

আলোচিত