শায়লা শারমিন ঈশিতা

০৫ মে, ২০১৬ ১৮:৩৭

ফেইসবুকের বিভ্রান্তি ও আমাদের সমাজ

প্রতিদিন সকালবেলা পত্রিকা পড়তে গিয়ে কিছু সংবাদের বেলায় মনে হয়, এটা তো গতকালই ফেইসবুকে দেখেছিলাম ছবি তথ্য প্রমাণসহ। কোনো কোনো সময় তো অধিকাংশ খবরই চেনা লাগে ফেইসবুকের বদৌলতে। হ্যাঁ, ফেইসবুকের কল্যাণে অনেক কিছুই আমরা সহজে করতে পারছি। যেমন যেকোনো সংবাদ তাৎক্ষণিক প্রচার, যেকোনো বিষয়ে তথ্যবহুল আলোচনা, পড়াশোনা সংক্রান্ত সকল কিছু একে অপরের সাথে শেয়ার, কোন বস্তু বা কোন প্রাণী বা মানবীয় আচরণ সম্পর্কে প্রকাশিত গবেষণার ফল সহজ ভাষায় প্রকাশ, বন্ধুদের সাথে প্রয়োজনীয় আড্ডা ইত্যাদি।

এটা যেমন সত্য যে, ফেইসবুকের কল্যাণে অতি সহজে সব কিছু জেনে নেয়া সম্ভব, তেমনি এটাও সত্য যে, ফেইসবুকের মাধ্যমে ভুলভ্রান্তি ছড়ানোও অতি মাত্রায় সহজ। তার প্রধান কারণ হচ্ছে উদরপূর্তি করার বেলায় আমরা যতটা ভেবে চিন্তে খাদ্যগ্রহণ করি, মস্তিষ্কের তথ্য ভাণ্ডার পূরণ করার বেলায় কোনটা নেব, কেন নেব, কীভাবে নেব বা কতটা নেব সেসব একেবারেই ভাবি না।

আমি যখন কোনো একটা বিষয়ে পড়াশোনা করছি তখন ভাবি কোন বইটা পড়লে বা কার লেখা পড়লে পরীক্ষায় নির্ভুল তথ্য উপাত্তযোগে লিখতে পারবো। তাছাড়া রেফারেন্সসহ সঠিক তথ্য সমৃদ্ধ এসব জ্ঞান আমাকে পরবর্তী সময়ে বিভিন্নভাবে সাহায্য করবে। কিন্তু ফেইসবুকে প্রচারিত রেফারেন্সবিহীন যে-কারো প্রচারিত তথ্য আমরা যেভাবে গ্রহণ করি এবং প্রচার করি, তাতে আমরা নিজের এবং দশের বিপদই ডেকে আনছি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্প্রতি প্রচারিত একটি তথ্যের কথা। সেখানে প্রচারিত হলো সবুজ চাঁদ দেখা যাবে। কে কখন কী মনে করে এই তথ্য প্রচার করেছে জানি না, ছোট বড় নির্বিশেষে সবাই অপেক্ষা করে বসে আছে সবুজ চাঁদ দেখার জন্য। আমার দেখা অধিকাংশ মানুষ জানতেও চাইলো না আসলেও এই ঘটনার কোনো ভিত্তি আছে কিনা! সংবাদপত্র বা টিভি সংবাদে এমন কোনো ঘটনার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে কিনা!

আরও একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। কিছুদিন আগে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হলো। এর আগ মুহূর্তে প্রচারিত হলো যে, রবীন্দ্রনাথের লেখা সর্বজন প্রিয় ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি বিশাখা নামের একজন অগ্নি-দেবতাকে আহ্বান করে গাওয়া হয়। যে কিনা নতুন বছরে এসে সবার দুঃখ-গ্লানি মুছে দেবে এই প্রত্যাশা করে অগ্নি-উপাসকেরা! অথচ এই গানটি রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রকৃতি পর্যায়ের অন্তর্গত একটি রূপক গান, যা নতুন বছরকে স্বাগত জানায় এবং প্রত্যেকে যাতে পুরনো ব্যর্থতা দুঃখ ভুলে গিয়ে কল্যাণের পথে এগুতে পারে- এমন প্রত্যাশা করে গাওয়া হয়। বছরের নতুন সূর্য ওঠার সাথে সাথে আনন্দের সাথে এই গান গাওয়া হয়। আর এই গান গেয়ে অগ্নিদেবের পূজার কোনো ইতিহাস আমার জানা মতে নেই।

অদ্ভুতভাবে এই ধরনের তথ্যপ্রকাশের সংখ্যা যেমন দিন দিন বাড়ছে, তেমনই মানুষের মধ্যে এসব গ্রহণের প্রবণতাও বাড়ছে।  আমরা ভাবি যে, একটি তথ্য দেখলাম, সেটা আমার পছন্দ হলো আর আমি শেয়ার দিলাম। তাতে এমন কী হলো? কার কী ক্ষতি করলাম? জ্বি, আপনি ক্ষতি করছেন। আপনি নিজে না জেনে-বুঝেই একটি মিথ্যা তথ্য গ্রহণ করেছেন এবং শেয়ার করার মাধ্যমে আপনাকে যারা বিশ্বাস করে তাদের মধ্যেও একটি ভুল ধারণাকে রোপণ করে দিলেন আর তাদের মাধ্যমে আরও মানুষের মধ্যে বিষয়টি ছড়িয়ে গেল। আপাতদৃষ্টিতে আপনার কাছে বিষয়টা এমন যে, যারা এটা বিশ্বাস করার করবে, আর যারা বিশ্বাস করবে না, তাদেরকে কেউ জোর করছে না বিশ্বাস করার জন্য। এভাবে আমরা একটি ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দুই দলে ভাগ হয়ে যাচ্ছি! একজন অন্যকে ঘৃণার চোখে দেখছি। এক দল সরল মনে একটি আনন্দের গান গাইছে, আর অন্য দল মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ঐ নির্দিষ্ট গানটি গাওয়া ঘৃণ্য পাপ হচ্ছে বিবেচনা করে ছি ছি করছে, ঘৃণা প্রকাশ করছে! ব্যাপারটা ভেবে দেখছি কি?

আমরা নিজেরাই আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, আচার-আচরণের ধারক এবং বাহক। সবসময় ধর্মের সাথে সংস্কৃতি মেলে না, সংস্কৃতির সাথে আচরণ মেলে না। বিচার-বিবেচনা এবং জ্ঞানের ভিত্তিতে আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিই কোনটা করবো আর কোনটা করবো না। কোনো কিছু বর্জন করতে হলে তার পেছনে সঠিক তথ্য উপাত্ত ও এর খারাপ বা ক্ষতিকারক দিকগুলো প্রচারের মাধ্যমে আমরা একে অপরকে সাবধান করতে পারি। কিন্তু মিথ্যা বা ভুল তথ্য কখনো কোনো ভালো কাজের ভিত্তি হতে পারে না।
বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা, ফেইসবুক পেইজ তাদের মনগড়া সংবাদ ও তথ্যপ্রকাশ করে ভিউয়ার্স বাড়ানোর জন্য। আমরাও অতি সহজে তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছি। ব্যাপারটা এমন- কান নিয়েছে চিলে, আর চিলের পেছনে দৌড়ানো হচ্ছে সবার। হয়তো চিল ঠিকই উড়ছে, কিন্তু সে আসলেও কান নিয়েছে কিনা সেটা যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করি না আমরা।  ‘তোমরা সত্যের সাথে মিথ্যা মিশ্রিত কোর না’- এই কথাটা কজন মানি?

পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে নিম্ন-আয়ের মুসলমান রোহিঙ্গাদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার হয়েছে এই সংবাদ আমাদের জানা। অন্য দেশের কিছু ঘটনার ছবি মিয়ানমারের ঘটনার সাথে জোড়া দিয়ে এই সংবাদ অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। বৌদ্ধ সম্প্রদায় মুসলমানদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে বা নির্মূল করতে চাচ্ছে এই বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত হয়। এর সাথে যুক্ত হয় ফেইসবুকে আল-কুরআন অবমাননার অভিযোগ। একদল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর ক্ষিপ্ত হন তো, অন্য দল এই ঘটনা আদৌ সত্য কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। একসময় ঘটনাটি ধর্মসংক্রান্ত আক্রোশে পরিণত হয়। ঘটে যায় অন্যতম ঘৃণ্য ঘটনা, কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি গ্রামে স্মরণকালের ভয়াবহ হামলা হয়। হামলায় ঐতিহাসিক মূল্যবান বহু সম্পদ হারায় বাংলাদেশ। এর পেছনের একমাত্র কারণ ছিল উস্কানিমূলক বিভিন্ন মন্তব্য এবং না বুঝে-জেনে সেসব মন্তব্যকে সমর্থন দেয়া। প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেই ভালো-মন্দ দু’ধরনের মানুষই থাকে, দু-একজন বা একটি গোষ্ঠীর মানুষের আচরণ দিয়ে সকল অনুসারীদের আমরা বিচার করতে পারি না। রামুর সেই ঘটনায় শুধু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ক্ষতি হয়নি, পুরো বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছে। চোখের পানি ঝরেছে আমাদেরই।

আমাদেরকে বুঝতে হবে যে ফেইসবুক সবার জন্য উন্মুক্ত মতপ্রকাশের একটি জায়গা, যেখানে একজন স্কলার যেমন তার মতামত বা জানা বিষয়গুলি সবার সাথে শেয়ার করতে পারেন, তেমনই একজন সন্ত্রাসীও তার কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার সকল চেষ্টা করতে পারে। রেফারেন্স ছাড়া যেকোনো তথ্য রং-চং মেখে প্রকাশ করা যে কারো পক্ষেই সম্ভব। শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত হোক দু’ধরনের মানুষই ভালো-মন্দ দুই দিকই ধারণ করে। সুতরাং যে কারো ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট বা যেকোনো ফেইসবুক পেজ আমাদের ভরসার জায়গা হতে পারে না। তথ্য জানতে, সংবাদের আপডেট পেতে নির্ভরযোগ্য বই রয়েছে, অনলাইন সাইট রয়েছে, পত্রিকা রয়েছে, টেলিভিশন রয়েছে, রয়েছে বিভিন্ন মাধ্যম। আমরা কেন এসব যেনতেন অবিশ্বাস্য রেফারেন্সবিহীন সংবাদ বা তথ্যের ওপর আস্থা রাখবো? এতে হয়তো আপাতদৃষ্টিতে কোনো সমস্যা চোখে না পড়লেও মনের অজান্তেই আমরা বড় ধরনের কোনো বিপদকে সহজে আমাদের ভেতর জায়গা নিতে দিচ্ছি।

তাই এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষ্যে এখনি জনসচেতনতা জরুরি, নয়তো ভুলে ভরা উস্কানিমূলক তথ্য যেমন আপনার এককভাবে ক্ষতি করছে, তেমনই জাতিগতভাবে আমরা নিজেদের অজান্তেই অন্যের পছন্দ করে দেয়া পথে চালিত হচ্ছি। সুতরাং কোনো কিছু নিজে ধারণ করার আগে এবং অন্যকে জানানোর আগে তা সম্পর্কে ভালোভাবে নিশ্চিত হয়ে নেয়া আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাহলেই কিছু ভুল আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলতে পারবে না।

ফেইসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে যেন আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হই, এইসব মাধ্যম যেন আমাদের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো এতটা শক্তিশালী না হয়ে ওঠে।

শায়লা শারমিন ঈশিতা : সংস্কৃতিকর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত