ফারজানা মৃদুলা

০৮ মে, ২০১৬ ০০:৩৪

ভাল থাকুন ‘মা’

মাকে নিয়ে এরকম করে লিখতে বসব, তা ভাবিনি কোনদিন। তাই বলে মাকে নিয়ে যে আগে লেখা হয়নি বিষয়টা সেরকমও নয়। বরং আমার ডায়েরীর পাতা জুড়ে মা’ই তো এসেছেন ঘুরে ফিরে বারবার। নীরবে, নিভৃতে আমার স্কুল হোস্টেলের একাকী বেড়ে উঠার দিনগুলোতে। দূরে থাকা মাকে নিয়ে ডায়েরীর পাতার পর পাতাজুড়ে কত কথাই না লিখেছি তখন। আনন্দের কথা, বেদনার কথা, দীর্ঘশ্বাসে চাপা পড়া কষ্টের কথা। তবে সেসব ছিল একান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতিমালা। কাউকে দেখতে দেইনি কখনও, এমনি কি মাকেও না।

কিন্তু আজ মাকে নিয়ে লিখছি সবাইকে দেখানোর জন্য, জানানোর জন্য। মাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। যে কথাটি কোনদিন মুখ ফুটে বলা হয়নি, আজ সেকথা বলতে চাইছি।

মা আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। যদি দুঃসময় আসে, যদি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আমার বিপক্ষে চলে যায়, আমি নিশ্চিত জানি একজন আমার পাশে ঠিকই থেকে যাবেন- তিনি আমার মা। ছোট্ট জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছি, অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে। মুখোশ পরা সমাজের আড়ালের বীভৎস চেহারাটাও দেখা হয়ে গেছে। এমনও দিন গেছে, মনে হয়েছে এ জীবন বয়ে বেড়ানোর মানে কী? বিশেষ করে গেল বছরের দিনগুলো। সেই দুর্বিষহ দিনগুলোতে মা ছিলেন মাথার উপর ছায়া হয়ে। মেয়েকে সংকট থেকে তুলতে কতই না মরিয়া চেষ্টা করেছেন। অথচ বুঝে না বুঝে এই মাকে কতবার কষ্ট দিয়েছি জীবনে বহুবার, কাঁদিয়েছি। আজ ‘মা দিবস’ এর বিশেষ দিনে গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, মা তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

আমার মা পৃথিবীর সবচেয়ে পরিশ্রমীদের একজন। ঘুম থেকে উঠার পর ঘুমুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁকে ঘরে-বাইরে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। অফিস-ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি বাসার সবকিছু সামলাতে হয় একহাতে। মাঝে মাঝে ভাবি, সারাদিন ব্যবসার চাপ সামলে ঘরে ফিরে আবার গৃহস্থালি কাজ, রান্নাবান্নায় মন দেন কেমন করে।

আমার দেখা পৃথিবীর ভালো মানুষটি আমার মা। নিজের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কত মানুষের উপকারের চেষ্টা করেন। কত মানুষ তাঁর ধারা উপকৃত হয়। অথচ আমি অনায়াসে বলে দিতে পারি তিনি পৃথিবীর সুখী মানুষদের একজন নন। তাঁর অনেক দুঃখ আছে। প্রায়ই একা একা কাঁদেন। তখন আমার মন খারাপ হয়। সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি। নিজেও মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলি। নিজের দুঃখের ভাগ তিনি কখনই আমাদের দেন না। কিন্তু সুখের ভাগ ঠিকই দিয়ে দেন আমরা চাওয়ার আগেই।

আমার মা নুরুন্নাহার বেবী তাঁর কর্মজীবনে সফলতা পেয়েছেন, দেরিতে হলেও কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন। জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এবছর সিলেটের শ্রেষ্ঠ জয়ীতা নির্বাচিত করা হয়েছে তাঁকে। গেল এপ্রিলের ২৬ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর হাতে সেই স্বীকৃতি তুলে দেওয়া হয়। সেদিন মঞ্চে উপস্থিত বরেণ্য অতিথিরা যখন মায়ের প্রশংসা করেছেন নিজের অজান্তে আমার চোখ বেঁয়ে তখন অশ্রু নামছিল। সারাজীবন নীরবে কঠোর পরিশ্রম করে যাওয়া একজন মানুষ যখন স্বীকৃতি পান তখন তা তো আবেগাপ্লুত করবেই। আর আমার জন্য তো বটেই। কারণ ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, এই মানুষটি কত কষ্ট করেছেন, কত কঠিন কঠিন বাঁধার মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু হার মানেননি। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ এমন মায়ের সন্তান করে পাঠিয়েছেন বলে।

আমি জানি, আমি বেঁচে আছি আমার মায়ের জন্য। তাঁর মুখে হাসি ফুটাতে পারলে আমার খুব ভালো লাগে। আমার কারণে যখন মা গর্ব করেন তখন নিজেকে খুব সার্থক মনে হয়।

ইদানিং একটা বিষয় খেয়াল করে মনটা খারাপ হয় প্রায়ই। ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যেতে চায়। কিছুদিন আগে হঠাৎ খেয়াল হলো, মায়ের বয়স বাড়ছে। অসুস্থতার সাথে সখ্যতাও যেন একটু বেড়েছে। বিষয়টি একজন সন্তানের জন্য কতটা বেদনাদায়ক অনুভূতি তা কি আর লিখে বুঝানো যায়। ব্যাপারটি চোখে পড়ার পর থেকে প্রার্থনা করছি, মায়ের আগে যেন আমার মৃত্যু হয়। তা না হলে আমি এই ভার সহ্য করব কেমনে।

মাকে নিয়ে অনেককিছু লিখব ভেবে কলম নিয়েছিলাম। কত কিছুইতো লিখার আছে। কিন্তু কোনটা রেখে কোনটা লিখি। একবার মনে হয় আসলে মাকে নিয়ে আলাদা করে লেখা সম্ভব নয়। কারণ অস্তিত্বের পুরোটা জুড়েই তো মা। মনে পড়ছে একবার পরীক্ষায় ঘুরয়ে ফিরিয়ে জানতে চাওয়া হচ্ছিল, তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? আমি বলছিলাম, আমার মা-বাবা যেন ভালো থাকেন। আরেকবার একজন প্রশ্ন করেছিল, কাকে সবচেয়ে ভালোবাসো? বলেছিলাম, মাকে। আসলেই, মাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, নিজের চেয়েও। সবারই উচিত মাকে ভালোবাসা। কারণ মা তো মা’ই। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে অবলীলায় জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারেন তো কেবল মা’ই।

পৃথিবীর সব ‘মা’ ভালো থাকুন।

ফারজানা মৃদুলা : সংবাদকর্মী ও প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত