রুহেল আহমেদ

০৮ মে, ২০১৬ ১৯:০৪

আমার মা এখন ভয় পায়...

আজ মা দিবস। অনলাইনের সকলে যেভাবে স্রেফ আজকের দিনটাতেই মাকে স্মরণ করছে, দেখে মনে হলো আর বাকি ৩৬৪ দিন নিশ্চয় ছেলে দিবস। আমার অবশ্য স্পেসিফিক্যালি বছরের একটা দিন আলাদা করতে মাকে স্মরণ করতে হয় না।কারণ সারা বছরই মা আমার খোঁজ খবর নেন। চিন্তা করেন, দোয়া করেন, ফোন করে মনে করিয়ে দেন, "গরম পড়েছে অনেক পানি খেতে হবে... কম করেও ৮ গেলাস প্রতিদিন", "গুরুপাক কোন খাবার খাবিনা"। "বেশি খাবার খাবিনা", "মানুষ মরে না খেয়ে, অথবা বেশী খেয়ে, কম খেয়ে কেউ মরেনা। সব সময় কম করে খাবি, অন্তত ১০ কেজি ওজন কমাতে হবে...

আর ওই রাজাকারদের নিয়ে এত কিছু লিখবিনা... সরকারকে নিয়েও কিছু লিখবিনা... সত্যি কথা লিখার জন্য নতুন প্রজন্ম রয়ে গেছে, ওদের উপর ছেড়ে দে... তুই আর তোর বাকী ভাই বোন সবাই তো যুদ্ধ করেছিস, এখন নতুনের পালা।

মা আমার আজকাল প্রচণ্ড ভয় পান আমাকে নিয়ে। ডজনের ওপর হার্ট এটাক হয়ে গেছে অলরেডি, ভয় পান কবে আবার আর একটা হার্ট এটাক হয়... ভয় পান কবে কোন কাপুরুষের দল পেছন থেকে "আল্লাহু আকবর" বলে চাপাতি চালায়। ভয় পান কবে সরকারের "৫৭" ধরে বসে।

আমাকে নিয়ে মা সবসময় ভয় পান, সব সময়...

কিন্তু ছোটবেলা মাকে কক্ষনো ভয় পেতে দেখিনি। একাত্তরের ২৫শে মার্চ রাতে যখন ক্র্যাক ডাউন হল, মানুষ ছুটছে দিগ্বিদিক,হতবিহবল, স্রেফ প্রাণটা বাঁচানোর তাগিদে, তখন বাসায় ফিরে দেখি সবাইকে আগলে রেখে আমাদের বাড়ীর করিডরে বসে আছেন আমাদের মা। সেই যে শুরু হল সবাইকে আগলে রাখা, এরপর নয়টা মাস মানুষের সেই স্রোত আর থামেনি। সেটা দেখার জন্য আমি অবশ্য বাড়ি ছিলাম না, কারফিউ উঠে যেতেই আমাকে,ছোট ভাই সোহেল,বন্ধু সেলিম, বন্ধু বাচ্চুকে মার অমোঘ নির্দেশ, দেশ স্বাধীন না করে ঘরে ফিরবি না, দেশটা স্বাধীন করতে হবে, মাতৃভূমির ডাক আসছে, যুদ্ধে যাও!"

হয়তো বোকাই ছিল আমার মা'টা। দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধরে কি অপরিমেয় ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধেই না এনেছিল আমাকে এই পৃথিবীতে, দেশমাতার বিপদে স্নেহের সেই অচ্ছেদ্য বন্ধনটারও পরোয়া করেনি। বুকে দুশমন পাথর বেধে কি অবলীলায় কড়া চোখে তাকিয়ে বলেছিল, দেশটা স্বাধীন না করে ঘরে ফিরবি না...আজ এতদিন পর সেই অদ্ভুত ভয়ের সময়টার কথা মনে হলে বড্ড অবাক লাগে। অবাক বিস্ময়ে ভাবি, মাতৃহৃদয়ের সীমাহীন অপত্যস্নেহের ঊর্ধ্বে উঠার এমন অমিত সাহস এই ছোটখাটো মানুষটা পেল কোথায়?

আকাশে চিল আসলে একটা মুরগী যেমন তার কচি বাচ্চাগুলোকে পাখার আড়ালে লুকিয়ে রাখে, ঠিক সেইভাবে আমার মা মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রেখেছিল। শুধু তাই নয়, সাহাবাবুর পুরো পরিবারকে, গোপেশ মালাকারের স্ত্রী-পুত্র-সন্তানদের পরিবারগুলোকে একাত্তরের নয়টা মাস লুকিয়ে রেখেছিল যক্ষের ধনের মত। পাকিস্তানী পশুগুলো প্রায়ই গন্ধ শুঁকে চলে আসতো, মায়ের পাথরকঠিন ব্যক্তিত্বের সামনে ওরা সুবিধা করতে পারতো না, চোখ রাঙ্গানির কাঠিন্যের মুখে কুঁকড়ে গিয়ে পালিয়ে যেত। নিজের দুটো মেয়ে এবং বাসা ভর্তি যুবতী মেয়েগুলোকে ,কল্পনাও করতে পারেনি তারা, তাদের নাকের ডগায় কি অসম্ভব সাহসের সাথে আমার মা মেয়েগুলোকে আগলে রেখেছিল।

নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর গেরিলা দলটার নির্ভরযোগ্য হাইডআউট ছিল এই বাড়িটা। ঢাকার লিজেন্ডারি ক্র্যাক প্লাটুনের এই দলটা পাকিস্তানি সেনাদের নিরন্তর টহলের মাঝেই রাতের বেলা অস্ত্র-গোলাবারুদ এনে তুলতো,হিসেবে একচুল এদিকওদিক হবার উপায় ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দিন এখানেই থেকেছে কত্তদিন। নির্ভরতার প্রতীক হয়ে অসমসাহসী মা আমার সব সামলেছে। দীর্ঘ এই সময়টার যেকোনো মুহূর্তে পাকিস্তানী আর্মি আমাদের বাড়িতে রেইড করতে পারতো, (একবার এসেও ছিল) মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেবার অপরাধে হয়তো মুহূর্তের মাঝে একরাশ বুলেটের ব্রাশফায়ার স্তব্ধ করে দিতে পারতো তাঁকে,অকুতোভয় মা আমার এক মুহূর্তের জন্যও ভয় পায়নি... এক মুহূর্তের জন্যও না।

ক'দিন আগে মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আসার সময় মা আমার আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললো।"বাবা, আমার কথাটা রাখো, আর লেখালেখি করো না। কি হবে লেখালেখি করে? রাজাকারদের বিরুদ্ধে যারাই লিখেছে, যারাই রাজাকারের ফাঁসি চেয়েছে, তাদেরই জবাই করেছে ওরা। তুমি আমাকে আজকে কথা দাও, আর লিখবা না"

কি কাতর অনুনয় আমার মায়ের... কি অসম্ভব ভয় তার ছেলেকে নিয়ে। অথচ এই মা ২৫শে মার্চের রাতে ভয় পায় নাই। ছেলেকে যুদ্ধে যাওয়ার আদেশ দেবার সময় ভয় পায় নাই। নয়টা মাস কত গুজব ছড়াইছে, কতজন এসে বিশাল বিশাল গল্প বানাইছে আমার মৃত্যুর গুজব ছড়ায়ে, মা আমার একটা মুহূর্তের জন্যও ভয় পায় নাই, বিশ্বাস করে নাই কোন গুজবে।

পাকিস্তানীদের আমার মা ভয় পায় নাই। কারণ তারা ছিল প্রকাশ্য শত্রু, তার ছেলের সামনাসামনি লড়াই করার সাহস তাদের ছিল। কিন্তু আজকের এই মৌলবাদী ধর্মান্ধ কীটগুলো ঠিক সেই একাত্তরের ছদ্মবেশী রাজাকারগুলোর মত, সেই একাত্তরের মতই ধর্মকে পুঁজি করে ধর্মের অজুহাতে এরা কাপুরুষের মত পেছন থেকে কোপায়, একাত্তরের রাজাকার সাইদি-নিজামী-মুজাহিদ-গোলাম আজমদের বাঁচাতে এরা জবাই করে স্রস্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে, তারপর তাকে নাস্তিক হিসেবে প্রচার করে জায়েজ করে হত্যাকে। অশিক্ষিত, বর্বর, মূর্খ এই নর্দমার কীটগুলো, মুনাফিকগুলো ইসলামের ছদ্মবেশে আমাদের মধ্যেই মিশে থাকে, সামনে এসে কোপানোর সাহস নেই, পেছন থেকে কাপুরুষের মত জবাই করে বেহেশত পেতে চায়।

আমার মায়ের ভয় এই অন্ধকারের শকুনগুলোকে। আমার মায়ের অসহায়ত্ব সবকিছু এই নষ্টদের দখলে চলে যাওয়া দেখে। এমনকি যার উপর সবচেয়ে ভরসা ছিল, সেই শেখ হাসিনাও কেন যেন সব মেনে নিচ্ছেন। যার পিতা ছোটবেলায় আমাকে আদর করে কোলে তুলে নিয়েছিলেন, যুদ্ধে পা হারানোর পর সরকারী খরচে জার্মানিতে পাঠিয়েছিলেন চিকিৎসা করতে, সেই বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা যখন এই ধর্মান্ধ খুনিদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে সংশয় বোধ করেন, রাজাকারের ফাঁসি চাওয়া ছেলেগুলোর জবাইয়ের বিচার হয় না বছরের পর বছর, তখন হয়তো আমার অসমসাহসী মাও আর ভরসার জায়গা খুঁজে পান না, ভয় পান তার সন্তানকে নিয়ে... অব্যাখাতীত অনির্বচনীয় ভয়...

কে আমার মায়ের সেই অমিত সাহসটুকুন কেড়ে নিলো? যুদ্ধ করে যে স্বাধীন বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনলাম, সে বাংলাদেশে আজ সন্তানের জীবনের নিশ্চয়তা নিয়ে আমার মাকে এতো ভয় পেতে হবে কেন? কার কাছে এর উত্তর পাবো, বলতে পারেন?

রুহেল আহমেদ : মুক্তিযুদ্ধের চার নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত