জাহানারা নুরী

১৯ মে, ২০১৬ ১০:৩৯

ধর্মানুভূতি যখন ‘চর্মে’

ধর্মানুভূতি যখন চরমে ওঠে তখন ধর্মচেতনায় সামান্য হাওয়া লাগলেও পা পড়ার অনুভূতি হয়। কিন্ত্তু ধর্মানুভূতি যখন চর্মে, তখন যে কোনও দৃশ্য অদৃশ্য স্পর্শেই যখন তখন তা আঁতকে উঠতে থাকে।

এমন এক প্যারানইয়ার ভেতর বাস করা ধর্মান্ধদের জঙ্গীবাদিতার নগ্ন প্রচারণার কভার পেজ আজ বাংলাদেশ। চরমপন্থী চিন্তাধারা এদেশে আজ নগ্নভাবে নাগরিকের অধিকারকে পদদলিত করছে, জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে, মানবিক অধিকারকে বেআইনীভাবে নির্লজ্জভাবে লঙ্ঘন করছে। ইসলাম ধর্মানুভূতি আজ এ দেশে এমন চরম আকার ধারণ করেছে, যে দর্শনরূপে  ইসলামের অসহায়ত্বের এমন গ্লানিকর সময় বাংলায় আর দেখা যায় নি। ইসলাম ধর্মানুভূতিকে ব্যবহার শুরু করেছিল ৭১ পূর্বে পাকিস্তানী সরকার, ৭১ এ পাকি  সেনাবাহিনী, আলবদর এবং জামায়াতে ইসলাম, স্বাধীন দেশে জামায়াত ও সাথে সাথে তাদের নানা পরিকল্পনার সাথে জড়িত অন্যান্য ইসলামী দলগুলো।  ইসলামের নামে ধর্মীয় চরমপন্থীরা ক্রমাগত চাপাতি চালিয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের সংখ্যা কমিয়ে আনার চেষ্টায় উন্মাদ এখন।  

২.
২০১৩ থেকেই এবং হেফাজতের ঢাকায় লংমার্চের পর আরো জোরেশোরেই  চরমপন্থা সরকারের নিয়ম নীতির অংশ হয়ে ওঠে। ৫৭ ধারা বলবৎ করার মাধ্যমে যার এক ধরণের আইনি চেহারা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৬-তে এসে দেখা যাচ্ছে যে কোনও ব্যক্তি যে কোনও সুয়োগ নিতে ‘ধর্মানুভূতি আঘাত পাওয়ার’ নামে চরম পন্থাকে ব্যবহার করছে। ৫৭ ধারায় সবচেয়ে নিগৃহীত হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষ, মুক্তচিন্তা, স্বাধীন চিন্তা, ন্যায়বোধ থেকে জেগে ওঠা প্রতিবাদী মানুষগুলো। কিন্ত্তু তা থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে জঙ্গিরা এবং চরমপন্থার সুযোগ নিতে তৎপর নানা দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তি যারা এই ফাঁকে ভাগ্য কিংবা সরকার বদলের জন্য হন্যে হয়ে আছে। মাঝে দেখা যাচ্ছে একমাত্র যারা রাজপথে পড়ে মার খাচ্ছে তারাই শান্তি ও সহিষ্ণুতার পতাকা এখনও ধরে রেখেছে। তার মার দিচ্ছে না। খাচ্ছে। তাদের প্রতিবাদ এখনও রাজপথে; শ্লোগানে, মিছিলে জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে নিয়োজিত।

৩.
আপনারা যারা শাহবাগে দণ্ডায়মান মশাল হাতে মানুষগুলোকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে অভ্যস্ত তাদের বলছি, যত দ্রুত পারেন আপনি ঐ শান্তির মশালধারীদের সাথে যোগ দিন। অন্ততঃ ধর্মান্ধের, ধর্ম ব্যবসায়ীর ও ধর্মের জাত মেরে আখের গুছিয়ে নিতে তৎপর ‘চতুর শেয়ালদের’ জাল আপনাকে ধরে ফেলার আগেই বেরিয়ে পড়ুন। তড়িঘড়ি শুরু করুন ভাবুন কি শেখাবেন আপনার ঘরের তরুণদের। শেখান তাদের শিল্প সাহিত্য, মানবতা, বোধবুদ্ধি, মায়া মমতা, অর্থ নয় শান্তির জন্য চাই অন্য কিছু। বলুন তাদের আজ দূর প্রত্যন্ত গাঁয়ের এক মাদ্রাসার শিক্ষকগণ নিজেদের কান ধরে দাঁড়িয়ে বলেছে শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তের অপমানে আমরাও অপরাধি, ক্ষমাপ্রার্থী। বলুন তাদের এই বাংলাদেশ সুন্দর। এই বাংলাদেশ গড়তে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াও আজ।  নইলে চোখ থাকতে অন্ধ সাজতে হবে না আমার তোমাদের চোখই গেলে দেবে ওরা। ঐ ধর্মান্ধরা যখন মানুষ হত্যা হয় তখন কত ইঞ্চি গভীর হলো চাপাতির কোপ তা নিয়ে রীতিমতো অসুস্থ গবেষনায় মাতে। এই ইঞ্চির হিসাব আপনার জন্য মোটেও প্রীতিকর হবে না, তাই এর উদাহরণ উপস্থাপন করলাম না।

কেন আমি ঐ কথা বলছি? কারণ ঐ রাজপথে যারা দাঁড়াচ্ছে তাদের কাছেই এখন বাংলাদেশের গণতন্ত্র বাঁচতে হত্যে দিয়ে পড়েছে। গণতন্ত্রের আর কোনো আশা নেই। আপনারা যারা সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ আছে’, ‘রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম’ বলে বাংলাদেশ এখন বাদশাহ আলমগীরের রাজত্বের নিয়ম অনুযায়ী চলবে এ জাতীয় রূপকথা লাগাতার প্রচার করে বেড়াচ্ছেন, আর নতুন নতুন আবদার চালু করার চেষ্টা করছেন, এ সব অযৌক্তিক আকাম ছেড়ে  লাইনে আসুন।

৪.
বাংলাদেশের সংবিধান সুনির্দিষ্টভাবে সুস্পষ্ট উচ্চারণে প্রতিটি মানুষের ধর্ম পালনের অধিকার স্বীকার করে। তা এও বলে যে রাষ্ট্র ও সমাজ ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং মুক্তচিন্তার, যুক্তিবাদীদের সমভাবে প্রতিনিধিত্ব করে না এটা রাষ্ট্রের ও সমাজের সীমাবদ্ধতা কিন্ত্ত সংবিধান কোনো নাগরিকের প্রতি ধর্মের কারণে অসম আচরণ করা আইনসম্মত নয় বলেই ঘোষণা করে। এ কথা বলে সংবিধান মূলতঃ রাষ্ট্রকেই তার সীমাবদ্ধতা মোচনের দায়িত্ব নিতে বলে। এই সংবিধানকে ধারণ করে যে প্রজন্ম রাজপথে মশাল হাতে নেয় তারা রাষ্ট্রের যোগ্য নাগরিকের দায়িত্বই পালন করে যাচ্ছে।

তাদের লড়াই প্রজাতন্ত্রের মানুষদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার লড়াই।  কোনও ব্যক্তির অধিকার কেড়ে নিয়ে যে কেউ ঐ নাগরিকের ন্যায্য স্থান, পাওনা, অবস্থান থেকে তাকে সরাতে চাইবে তা হবে বে আইনী।

৫.
এখন দেখুন এই বেআইনী অবস্থানে গিয়ে পৌঁচেছে কারা? ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা দলগুলো জানা কথা গণতন্ত্র মানে না। তারা বেআইনি রাস্তায় চলছে আগাগোড়াই। রাষ্ট্রের পোষ্য তারা এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে তারা তাদের সেই লোককে শাসকের ভূমিকায় দেখতে চায় যে বা যারা তাদের নিজস্ব মতানুযায়ী দেশ চালাবে। অর্থাৎ ইসলামী শাসন চায় ওরা। তাদের ইসলামী শাসন চেতনা যে কোনও কথাতেই ‘ধর্মের অনুভূতিতে লেগেছে’ বলে চেঁচিয়ে উঠছে ক্রমাগত। সাথে সাথে একদিকে তাদের অনুসারীরা ফোনকল ও মেসেজ পেয়ে ছুটে গিয়ে ইসলাম রক্ষায় সামাজিক নৈরাজ্য তৈরি করতে অভিযুক্তের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, অন্যদিকে তারা কুরানের  বাণী না বলে সোজা স্ল্যাংয়ের মাধ্যমে একে নাস্তিক তাকে জালিম, ওকে ফেরাউন ওদের কোথায় কি ঢুকাতে হবে বলে সামাজিক মাধ্যমে নরক গুলজার করে তুলছে।

ধর্মান্ধদের অনলাইনের বেশিরভাগ কথাই একদিকে কুরানের বাণী, মাঝখানে হত্যার হিসাব নিকাশ ও অন্যদিকে খিস্তিতে পূর্ণ। একই সাথে বাণী, হত্যার উল্লাস, মানুষের অপমানে অট্টহাসি ও পর্ণের বিভৎস সমাবেশ। এ সব প্রচারণার কারণ না হয় বুঝলাম; বিশৃঙ্ক্ষল ঘটনা বারবার ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারলে তাদের লাভ-তারা যে কোনও উপায়ে হোক দেশে একটা অরাজকতা ঘটাতে চাইছে, যার ফাঁক দিয়ে রক্তপাতের ধারায় পিছলে তাদের ইসলামী রাষ্ট্র চলে আসবে বাংলাদেশে। তারা তাই ধারণা করছে।

৬.
আমার ধর্ম যে মানে না তাকে কতল করতে হবে নতুবা আমার ধর্ম তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য করতে হবে, অথবা তাকে জিজিয়া কর দিতে বাধ্য করা হবে- এমন ভাবনা নিঃসন্দেহে চরমপন্থী। তার কাছে শ্রদ্ধার তার ধর্মপ্রবক্তা। কিন্ত্তু আর সবাই সেই প্রবর্তিত ধর্মের অনুসারী না হলে তারা যে শ্রদ্ধা দেখাতে বাধ্য নয় এই বাস্তব যুক্তিটা এরা বুঝবে না। তারা মুত্যু ভয় দেখিয়ে মানতে বাধ্য করবে বা কতল করতে গুপ্ত ঘাতক লেলিয়ে দেবে।

৭.
কিন্ত্ত ধর্মের অনুভূতি নিয়ে যখন সরকারে থাকা জোটের সাংসদেরা খেলা শুরু করে তখন এর পেছনে কি মানসিকতার ও হিসাব নিকাশ কাজ করছে তা ভেবে দেখা দরকার। এসব মনোভাবই চরমপন্থী। ক্রমে এ চরমপন্থী চিন্তা জলপাই পোশাক পরা এক্স-আর্মিম্যানের গঠিত দলের লোকের মাথাতে খেলা করতে সাহস করছে কেন?

সরকার কি জানার চেষ্টা করবে কি কারণে এরশাদের দলের একজন সাংসদ চরমপন্থী স্টাইলে একজন শিক্ষকের মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের সাহস করলেন এবং তা করতে গিয়ে ধর্মের অনুভূতির আঘাতের নাটকটি যারা সাজালো তাদের সাথে তিনি একাট্টা হয়ে একটি অন্যায় পদ দখল রূপ ঘটনা আড়াল করলেন?  

৮.
খেয়াল করলে দেখতে পাবেন টেকনোলজি শিক্ষিত জিহাদি জঙ্গিরা অল্প শিক্ষিত কুরআন মুখস্থ করা মাদ্রাসা ছাত্রদের মাথা থেকে ধর্মের অনুভূতি নিয়ে যাচ্ছে এবং যত্রতত্র ব্যবহার করছে নিজ মনগড়া জিহাদী জোশ দিয়ে, আর্থিক, রাজনৈতিক ও দলীয় ফায়দা লোটার অবস্থানে পৌঁছবার চেষ্টা করছে এবং এদের ব্যবহার করছে।

এরশাদের দলের একজন সাংসদ যখন এই চরিত্রে আবির্ভূত হন তখন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে জাতীয় পার্টির পক্ষে সেলিম ওসমান কোনও একটি পরিস্থিতির নায়ক হয়ে উঠতে চাইছে না তো যেখান থেকে  আজ দু’জনার দু’টি পথ… দু’দিকে বেঁকে যেতে পারে’। এরশাদের পকেট হাতিয়ে দেখা যেতে পারে এক্স-আর্মিম্যানের আর্মি কানেকশন ব্যবহারের চেষ্টা কেউ করছে কি না। আপনি বলবেন জাতীয় পার্টি ভালো বিরোধি দল হিসেবে মাঠ পাবে না। কিন্ত্ত সে তো আপনি আমি ভাবছি, তারা তো ভাবে উল্টোটা। পশ্চাতে অন্য কোনও রোল-প্লে থাকলে, আফগানিস্তান বানাতে যারা সচেষ্ট তাদের সাথে দেশপ্রেমহীন, অগণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন এক ব্যক্তির, কোনও আশ্বাসে সমূহ স্বাভাবিক ডিগবাজি খাওয়া অস্বাভাবিক নয়।  বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা যখন তার পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়, বুঝতে হবে ওদের এদিকে ছাতা ধরার কারণ ঘটেছে।

এই লেখা যখন লিখছি তখন আমাদের সময়ে একটি প্রতিবেদনে একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছে যাতে সেলিম ওসমানের পক্ষ নেয়া একজন টুপীধারী আঙুল উঁচিয়ে শাসাচ্ছে ও বলছে সেলিম ওসমানের বিরোধিতা করা নাকি ধর্মের বিরোধিতা।

সুকৌশলে ৫৭ ধারাকে ব্লাসফেমি আইনকে পূর্ণাঙ্গরূপ দিতে সচেষ্ট একটি গোষ্ঠী। এটা নিয়েই তারা খেলবে এখন। আওয়ামী লীগের জন্য এ আইন বুমেরাং হয়ে উঠবে অচিরেই। তারা ইচ্ছে করলেই এটা বাতিল করতে পারবে না। ইসলামীকরণ করে হলেও ক্ষমতায় থাকতে বদ্ধপরিকর দলের স্বাধীন মনোবৃত্তিসম্পন্ন সাংসদ মহোদয়গণ নিশ্চয়ই এতদিনে এটা বুঝে গেছেন। জবাই কাদের হতে দেবেন আপনারা তা বুঝে গেছে জাতি। কিন্ত্তু একজন নাগরিকেরও বাঁচার অধিকার, প্রাণ ধারণের অধিকার লুট হলে আপনার সংসদে থাকাটা অবৈধ হয়ে যায়। কারণ তাতে প্রমাণ হয় আইন প্রণেতারা হয় তার নাগরিকের বাঁচার পক্ষে আইন প্রণয়ন করেন নি, নতুবা আইন তাদের নিজের প্রয়োজনে মানুষের বিপক্ষে কাজে লাগাতে করেছেন। দুটোই আপনার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধি থাকাটাকে অন্যায্য প্রমাণ করে।

সাংসদ মহোদয়গণের কর্তব্য সেলিম ওসমানের ঘটনার ভেতরের ঘটনা খুঁজে বের করা। তবে একই সাথে একজন নাগরিকের, একজন মানুষ তৈরির কারিগরের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ ও তারা গ্রহণ করবেন আশা করি। অন্ততঃ তাকে ভাতে ও পানিতে মারার যে চক্রান্ত চলছে সে নিষ্ঠুরতা থেকে একজন শিক্ষক ও তার পরিবারকে উদ্ধার করা হোক।

এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত