সহুল আহমদ

২৩ জুলাই, ২০১৬ ০১:০১

তাজউদ্দীন আহমদ: যিনি লড়েছিলেন স্রোতের বিপরীতে

১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই দিবাগত রাতে দরদরিয়া গ্রামে কান্নার তীব্র চিৎকারে যে শিশু তার আগমন বার্তার খবর শুনিয়েছিল, তাকেই আমরা আরো ৪৫ বছর পর নতুন এক স্বাধীন দেশের ঊষালগ্নে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখতে পাব।

সারাজীবন স্রোতের বিরুদ্ধে সাতার কাটা এই মহান লোকের নাম-ধর্ম-জাত সবকিছুই বিকৃত করে দিয়েছিল তখনকার শাসক-শোষকরা। তারা রটিয়ে দিয়েছিল যে, তিনি কোন মুসলমান নয়, তিনি একজন ভারতীয় হিন্দু, আসল নাম তেজারাম। পাকিস্তানকে ভাঙ্গার জন্যেই তিনি পাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন। এমনকি ১৯৭১ এ একজন পাকিস্তানি অফিসার তাঁর শশুরকে জিজ্ঞেস করেছিল, “ সৈয়দ সাহেব, আপনি ছিলেন আরবি প্রফেসর এবং ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধেও আপনার অগাধ জ্ঞান রয়েছে। অথচ আপনার মেয়ের কি না বিয়ে দিলেন এক হিন্দুর সঙ্গে”।

আরেক কুখ্যাত পাকিস্তানি জেনারেল  রাও ফরমান আলী বলেছিলেন, “He hated West Pakistan and perhaps Pakistan itself. He was reputed to have a Hindu up to the age of 8. I do not think this story was correct but it revealed his mental make – up”

যাকে পাকিরা বারেবারে হিন্দু বলে আখ্যায়িত করছিল, তিনি ছিলেন একজন কোরআনে হাফেজ; নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি মৌলভী বাবার কাছ থেকেই এটা আয়ত্ত করেছিলেন। তিনি ছিলেন আমাদের স্বপ্ন সারথি, আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অগ্রদূত শেখ মুজিবের চরম ভরসার পাত্র ‘বঙ্গতাজ’ তাজউদ্দীন আহমদ। বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে এক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন; প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন প্রথম হয়ে। বিনিময়ে পেয়েছিলেন মূল্যবান পুরষ্কার – দেড় পয়সার কালির দোয়াত এবং সাড়ে আট পয়সার একটি কলম। সেই থেকে এক মহামানবের যাত্রা শুরু।  

পাকিস্তানিরা তাঁকে এমনি এমনি হিন্দু কিংবা ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে নি, তাজউদ্দীন আহমদের ধীরস্থির মস্তিষ্কের প্রতি তাদের একটা ভয়াবহ ভীতি কাজ করত।  ৭১ এ মুজিব – ইয়াহিয়া বৈঠকের সময়কালে ভুট্টো তখন একবার উত্তেজিত কণ্ঠে বলেছিলেন, "আলোচনা বৈঠকে মুজিবকে  আমি ভয় পাই না। ইমোশনাল অ্যাপ্রোচে মুজিবকে কাবু করা যায় কিন্তু তাঁর পেছনে ফাইল বগলে চুপচাপ যে নটোরিয়াস লোকটি বসে থাকে তাঁকে কাবু করা শক্ত। This Tajuddin, I tell you, will be your main problem"।

পাকিস্তানিদের এই ভয়ও অমূলক ছিল না। যে লোকটি পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কিংবা স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সহ সব ধরণের আন্দোলনের সহিত সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন তাকে ভয় পাওয়ারই কথা। ছাত্র জীবনেই শুরু হয়েছিল তাঁর রাজনীতির পথে হাঁটা।

বাংলাপিডিয়া থেকে তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের সময়টুকু এবার একটু দেখে নেয়া যাক –

“১৯৪৩ সাল থেকে তিনি মুসলিম লীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি  সক্রিয়ভাবে করেন। তাজউদ্দিন আহমদ বাংলা ভাষার অধিকার, বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সকল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মুসলিম লীগ সরকারের গণবিচ্ছিন্ন রাজনীতির প্রতিবাদে তিনি এ দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের (১৯৪৯) অন্যতম উদ্যোক্তা। তিনি ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ববাংলা ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে তিনি ভাষা আন্দোলনকালে গ্রেফতার হন এবং কারা নির্যাতন ভোগ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য এবং ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন এবং পরে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

তাজউদ্দিন আহমদ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে কাপাসিয়া থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছরই তিনি ৯২-ক ধারায় গ্রেফতার হন। ১৯৫৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারির পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে তাজউদ্দিন আহমদ গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৯ সালে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬২ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি কারাবরণ করেন।

১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন”।

ভাষা আন্দোলনে তিন শুধু সক্রিয়ভাবেই জড়িত ছিলেন না, প্রতিদিনকার ঘটনাগুলো যে ডায়রিতে তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন সেগুলো আজ ইতিহাস চর্চার এক অসাধারণ উপকরণ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। ভাষা আন্দোলন নিয়ে যারাই কাজ করছেন তারা সকলেই তাঁর ডায়রির প্রতি ঋণ স্বীকার করেছেন। বদরুদ্দীন উমর, যিনি ভাষা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ একটি ইতিহাস দাঁড় করিয়েছেন, তিনি তো বলেই দিয়েছেন, ‘এই ডায়রির গুরুত্ব অপরিসীম’। একদিকে সৃষ্টি করছেন ইতিহাস, অন্যদিকে সেটা লিপিবদ্ধ করার কাজও করছেন নির্মোহভাবে – এ এক অনন্য তাজউদ্দীন আহমদ!

১৯৫৯ সালে পহেলা বৈশাখের দিনটাতেই তাজউদ্দীন আহমদের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে সৈয়দা জোহরার। এবং মাত্র দশ দিন পরেই তারা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন দুজন। সৈয়দা  জোহরা নাকি তাজউদ্দীনকে বলেছিলেন, কোন সোনার গয়না পছন্দ না বরং বেলি ফুলের গয়না দিয়েই যেন তাদের বিয়ে হয়। সেই কথামতো তাজউদ্দীন আহমদ একরাশ বেলী ফুল নিয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন। প্রাকৃতিক শুভ্রতায় ঢাকা পড়ে যায় কৃত্তিমতার চাকচিক্য।

২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানিদের অতর্কিত হামলার পরপরই পালিয়ে যেতে হয়েছিল; পরিবারের সাথে দেখাও করতে পারেন নি ভাল মতো। দু দিন পর শুধু স্ত্রীর উদ্দেশে একটি ছোট চিরকুট পাঠিয়েছিলেন, ‘লিলি আমি চলে গেলাম। যাবার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিও। আবার কবে দেখা হবে জানি না... মুক্তির পর। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে মিশে যেও।’

তার কাছে দেশই ছিল তাঁর পরিবার, সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যেকেই সে পরিবারের অংশ। এপ্রিলে গঠিত প্রবাসী সরকারের হাইকমান্ডের প্রত্যেক সদস্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, দেশকে মুক্ত না করা পর্যন্ত তারা কেউই পারিবারিক জীবনে ফিরে যাবেন না ।

অসুস্থতাজনিত বিভিন্ন কারণে ধীরে ধীরে সকলেই পরিবারের সাথে থাকা শুরু করলেও তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন শেষ পর্যন্ত। বলতেন, ‘যুদ্ধরত অবস্থায় যোদ্ধারা যদি পরিবারবিহীন অবস্থায় থাকতে পারে আমি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তা পারব না কেন?’

৮ নম্বর থিয়েটার রোডে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মূল কার্যালয় ছিল। সেখানেই একটা কক্ষে নয় মাস কাটিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ। সেখানে ছিল মাত্র একটা চৌকি, কাঠের স্ট্যান্ডের ওপর দিয়ে আটকানো একটা মশারি, একটি বালিশ, একটি মাদুর, একটি কাথা এবং একটি চাঁদর। আর ব্যক্তিগত জিনিস বলতে দুটো ট্রাউজার, দুটো হাওয়াই শার্ট, কয়েকটি গেঞ্জি, মোজা ইত্যাদি। মাত্র দুটো শার্ট পরেই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন রণাঙ্গন, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প, শরণার্থী শিবির; সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিদেশী সাংবাদিকদের। সাধারণের মাঝেও অসাধারণ তিনি।

২৫ শে মার্চ সন্ধ্যায় গণ্ডগোলের আশংকা করে শেখ মুজিব তাজউদ্দীনকে ঢাকার শহরতলিতেই আত্মগোপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন ‘শীঘ্রই তারা পুনরায় একত্রিত হতে পারেন’।  পরবর্তীতে আক্রমণের তীব্রতা দেখে যখন নিশ্চিত হলেন যে দেখা করার কোন আশাই নেই, তখন সহকর্মী আমিরুল ইসলামকে সঙ্গে করে ঢাকা ত্যাগ করেন। ৩০ মার্চ যখন ভারতের সীমান্তে গিয়ে হাজির হন, তখন তার পরণে শুধু একটা ময়লা গেঞ্জি আর লুঙ্গি।   

৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তবে এর পূর্বে তাকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

একটি সাধীন সরকার গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে সেই সরকারের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত হওয়ার আগে কোন দেশ থেকে সাহায্য ও সহযোগিতা আশা করাটা নিরর্থক। তাই সবার আগে তাকে দেখাতে হবে  শেখ মুজিবের  আদেশেই সরকার গঠন করা হয়েছে। ইন্ধিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের আগের দিনই তিনি নিশ্চিত হন যে, তারা এ সংক্রান্ত কোন খবরই জানে না। বৈঠকের দিনই শুরুতেই তাই তিনি বলেন যে, ২৫/২৬ মার্চে আক্রমণের শুরুতেই বাংলাদেশকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডের সদস্যদের দ্বারা সরকার গঠন করা হয়েছে। যেহেতু, অন্যান্য সদস্যরা জীবিত কি মৃত সেটা নিশ্চিত ছিলেন না, তাই নিজেকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাজউদ্দীন আহমদের সেদিনের উপস্থিত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রারম্ভেই এক ঐতিহাসিক কূটনৈতিক সাফল্যের পরিচয় বহন করে।

পরবর্তীতে তিনি নিজেই বলেছেন,

“আগে ভাবিনি যে, আমার মতো সাধারণ কর্মীর ওপর জাতির ঐতিহাসিক  দায়িত্ব পড়বে। দেশবাসী সম্ভবত তা পূর্বে কখনো ভাবে নি। আসলে নেতৃত্ব হচ্ছে জনগণের মনের আশা – আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। ধনতন্ত্রের পথে কিংবা কোন যুদ্ধ জোটে যাব না – এই মনোভাব নিয়েই ১৯৭১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করি। সাধীনতা সংগ্রামে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি বিরাট সাফল্য”।     

শুরুতেই বলেছিলাম তাজউদ্দীন আহমদকে সারাজীবনই স্রোতের বিপক্ষে লড়তে হয়েছে। দেশের এমন পরিস্থিতির মধ্যেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অনেকেই তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। যুবনেতা ফজলুল হক মনি অবশ্য মন্ত্রীসভা গঠনেরই বিরোধীতা করেন এবং ১১ এপ্রিল থেকে শিলিগুড়ির এক অনিয়মিত বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার হওয়া বক্তৃতা ও বিবৃতি বন্ধ করারও দাবী জানান। মে মাসে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে শুরু হয় জোর প্রচারণা। মন্ত্রীসভার ভেতর – বাইর দু জায়গা থেকেই সমানভাবে চলতে থাকে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার।

তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশী অপপ্রচারে লিপ্ত ছিলেন খন্দকার মোশতাক। মন্ত্রীসভার বাইরের অনেকেই প্রকাশ্যে বক্তৃতায় দলীয় সম্পাদকের পদ থেকে তাজউদ্দীনের ইস্তফা দাবী করেন এবং বলেন যে, এর চাইতে বরং দেশে ফিরে গিয়ে যুদ্ধ অথবা আপোষ করাই শ্রেয়।

সেপ্টেম্বরের দিকে খন্দকার মোশতাক প্রচারণা চালাতে লাগলেন যে, ‘হয় স্বাধীনতা, নয় শেখ মুজিবের মুক্তি; দুটো একসাথে অর্জন করা সম্ভব নয়।’ এর উত্তরে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতাও চাই, মুজিবকেও চাই। একমাত্র স্বাধীনতা এলেই মুজিবকে পেতে পারি’।

পরবর্তীতে তাজউদ্দীন আহমদের একক সিদ্ধান্ত ও প্রচেষ্টায় মুক্তিবাহিনীতে বামপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা কিনা আওয়ামী লীগের একাংশের মধ্যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এর মধ্যে ভারত – সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি এবং সোভিয়েতের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন প্রদান তাজউদ্দীনের আহমদের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগগুলো হ্রাস করতে সাহায্য করে। তবে তখন নতুন নতুন অভিযোগ তোলা হয় তাঁর নামে।

অক্টোবর এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মূলত তিনটি:
ক) তাঁর মুক্তিযুদ্ধের নীতি ভ্রান্ত
খ) ভারতের ভূমিকা অস্পষ্ট ও ক্ষতিকর এবং
গ) সোভিয়েতের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সোভিয়েত-ভারতের ভূমিকা স্পষ্ট হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে,
ক) তিনি আওয়ামী লীগের দলগত স্বার্থ নিদারুনভাবে অবহেলা করছেন এবং
খ) বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে উপেক্ষা করে লীগ বিরোধী শক্তিদের জোরদার করছেন।

এমনকি, মুজিব বাহিনী তাজউদ্দীন আহমদকে খুন করার জন্যে লোকও পাঠিয়েছিল। সেই লোক নিজেই এসে তাজউদ্দীন আহমদের কাছে আত্মসমর্পন করে সব কিছু খুলে বলে। এ নিয়ে পরবর্তীতে ইউনিটগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়তে পারে, তাই ব্যাপারটি তাজউদ্দীন আহমদ সম্পূর্ণ গোপন করেন।

একদিকে দেশ যুদ্ধে আক্রান্ত, মানুষ মারা যাচ্ছে, নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে –সে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ, অন্যদিকে সামরিক চাহিদা মেটানোর জন্যে পর্যাপ্ত অস্ত্রের অভাবসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত তাজউদ্দীনের আহমদকে ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’র  মতো সামলাতে হচ্ছিল নিজের ঘরকেও। এত কিছুর পরও চলতে হচ্ছিল সবাইকে নিয়ে। আমাদের সৌভাগ্য যে, পাহাড়সম প্রতিকূলতার বিপক্ষে লড়াই করে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার মত একজন তাজউদ্দীন আহমদকে পেয়েছিলাম।

এজন্যেই পি এন হাসকার বলেছিলেন, "Tajuddin was found to be the only person who had right political ideas for the task Bangladesh has set before itself."।

পরবর্তীতে ডি.পি.ধর ও একই মত ব্যক্ত করেন, " Only Tajuddin was mentally equipped to lead Awami league out of a situation like this (liberation struggle)"

উপরোক্ত কারণে মন্ত্রীসভার ভেতরে তথ্যের নিরাপত্তার অভাব এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর মাঝে-মধ্যেই অভিমানহত আচরণের জন্যেই দেখা গিয়েছে যে, নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত – বাংলাদেশ সরকারের সকল সামরিক সিদ্ধান্ত মূলত তাজউদ্দীন আহমদকে একাই নিতে হয়েছে।

তাঁর ভাষায়,

“আমি ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনায় যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা বাংলাদেশ ও এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বার্থেই নিয়েছিলাম। বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষা আর বাচা – মরার প্রশ্নকে সেদিন সবচেয়ে উঁচুতে স্থান দিয়েই আমি কাজ করে গিয়েছি। আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে এবং একজন খাটি বাঙালি হিসেবে আমার দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে পালন করতে পারায় আমি খুশি”।

ডিসেম্বরের ছয় তারিখ ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দান করে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান যেন হতে চলছে ধীরে ধীরে। যেই লোকটা নয়মাস যাবত ব্যক্তিগত সকল আবেগ অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রেখেছিল, যুদ্ধাক্রান্ত দেশের সাড়ে সাত কোটি নির্যাতিত মানুষের আবেগ যার ব্যক্তিগত আবেগ হয়ে গিয়েছিল সেই লোকটা এই সংবাদ শুনে অবোধ শিশুর মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। জন্মের প্রথা মেনে এটা ছিল যেন এক নতুন দেশের আগমনী বার্তার কান্না। সাংবাদিকের সামনে সেদিনও আফসোস করছিলেন তাঁর মুজিব ভাইকে নিয়ে। স্বচক্ষে এই সোনালী মুহূর্তটা দেখতে পারলেন না বলে।

সেদিন সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় কি বলছিলেন, জানেন?

‘যাদেরকে হারিয়েছি স্বাধীন দেশের পতাকার মধ্য তাঁদের খুঁজে পাব। আমাদের স্বাধীনতা – সার্বভৌমত্বের মাঝে তাঁরা বেঁচে থাকবেন। আর ভবিষ্যতে যাদের জন্ম হবে, কোন পরাধীন দেশে তাঁদের জন্ম হবে না। তারা আর গোলাম হয়ে জন্মগ্রহণ করবে না। স্বাধীন দেশের মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করবে। এটাই আমাদের পরম পাওয়া, পরম সান্তনা’।

[সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় কাঁদছেন তাজউদ্দীন আহমদ]


তাজউদ্দীন আহমদের কিছু ভাবনা:
তাজউদ্দীন আহমদের চিন্তা –চেতনায় সর্বদা কাজ করত দেশ, দেশের মানুষ, তাদের জীবনধারা। তাঁর চিন্তাচেতনার কিছু ছিটেফোঁটা এবার তুলে ধরব।

সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার যন্ত্র নিয়ে তার কিছু মতামত:

“আমরা বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব, যা সোভিয়েত রাশিয়া কিংবা চীনের ধরণের হবে না, বরঞ্চ তা হবে আমাদের নিজেদের মতো। আমরা গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যে একটি সুষম সমন্বয় ঘটাব, যা বিশ্বে একটি অসাধারণ ব্যাপার হবে”।

“সমাজতন্ত্র যান্ত্রিক উপায়ে রাতারাতি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। জনগণের অধ্যবসায় ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এক অর্জন ও প্রতিষ্ঠা করতে হয়। শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি প্রয়োজন। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিঃস্বার্থ কর্মীদের সাহায্য প্রয়োজন। এসব কর্মীকে সকল প্রকার লোভ ও বৈষয়িক লাভের উর্ধ্বে থাকতে হবে ও আদর্শের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।

“সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলই বিকল্প সরকার। বিরোধী দলগুলোকে এমন হতে হবে যেন তারা জনগণের পূর্ণ আস্থা লাভ করতে পারে। তা না হলে দেশের জনগণ হতাশার শিকার হবে। বাংলাদশের জনগণকে নৈরাজ্যের শিকারে পরিণত করার অধিকার কোন বিরোধী দলেরই নেই”।
“গণতন্ত্রে প্রত্যকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে এবং এ ক্ষেত্রে মতামতের বিভিন্নতাও একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এই পার্থক্য আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও লক্ষ্য বিরোধী হলে চলবে না। জাতীয় প্রশ্নে আমাদের দলমত নির্বিশেষে একটা অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত”। 

এর পাশাপাশি এটাও বলতেন,  

“যত সুন্দর ভাষা ও শব্দ দিয়ে সংবিধান লেখা হোক না কেন, জাতির জীবনে তা প্রয়োগ না হলে সেটা অর্থহীন হয়ে পড়বে”। 

মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে তার কয়েকটা মন্তব্য:

  • “একটি কঠিন যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক ও ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যুদ্ধ আরও কঠিন”।
  • “মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলতে পারলেই স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের স্মৃতির প্রতি যথার্থ মর্যাদা দেওয়া হবে”।
  • “বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জনগণই সৃষ্টি করেছে। একা কেউ এ ইতিহাস সৃষ্টি করেনি। এই ইতিহাসকে সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে”।
  • “বাঙালি জাতি বড় বেশী তাড়াতাড়ি সব কিছু ভূলে যায়। তাই আমরা স্বাধীনতা পাওয়ার মাত্র দুই বছরের মধ্যেই শোকাবহ ঘটনাকে ভুলতে বসেছি। এই মুহূর্তে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সার্বিক ইতিহাস রচনা করতে হবে। যদি সঠিক ইতিহাস রচিত না হয় তবে আগামী দিনে জাতি আমাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবে না”।

যুবসমাজ নিয়ে ভাবনা:

  • “তরুণ সমাজ অদম্য শক্তির অধিকারী, এই শক্তিকে যদি সুষ্ঠু পথে পরিচালনা করা না যায়, তাহলে সেই শক্তিটা যদি বিপথে যায় বা উদ্দেশ্যবিহীন, লক্ষ্যবিহীন হয়ে যায় তবে অবস্থা মারাত্মক হয়ে দাঁড়াবে”।
  • “বর্তমানে দেশে বিবেকের সংকট দেখা দিয়েছে। একমাত্র দেশের যুব সমাজের নিষ্কলুষ মানসিকতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নেতৃত্বের মাধ্যমে এই সংকট কাটানো যেতে পারে”।

আমাদের জন্যে কিছু উপদেশ:

  • “স্লোগান দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যায় না, দুর্নীতি দূর হয় না, বুলি আউড়িয়ে প্রবৃদ্ধি আনা যায় না, জনসাধারণকে সর্বকালের জন্য ধোঁকা দেওয়া চলে না”।
  • “আমরা সামন্তবাদী অবস্থা ও পরিবেশ থেকে এখনও পূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থায় পৌঁছাতে পারিনি। সামন্ত প্রভু আজ নেই সত্য – কিন্তু সামন্ত মনোবৃত্তি এখনও রয়েছে। আগে মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে”।
  • “দেশের কাছে কিছু চাওয়ার আগে দেশকে আপনি কতটুকু দিয়াছেন, তা বিচার করেন”।
  • “দুর্বৃত্ত দুর্বৃত্তই, সে যে পদেরই হোক না কেন। যদি তাজউদ্দীন কোন প্রতারণা করে অথবা একজন নক্সালি কোন ডাকাতিতে জড়িত হয়, তবে তাদের রাজনীতিক না বলে দুর্বৃত্ত বলেই আখ্যা দিতে হবে। দুষ্কৃতিকারী ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তাকে রাজনৈতিক রূপ যেন না দেয়া হয়। রাজনৈতিক রূপ দিলে সে আশ্রয় পেয়ে যায়। দুষ্কৃতিকারী রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী নয়। দুষ্কৃতিকারী সে যেই হোক তাকে ক্ষমা করা চলবে না”।

যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে কখনো তাজউদ্দীন আহমদের চিন্তা ভাবনাকে বিশ্লেষণ করে লিখব ভবিষ্যতে, আশা রাখি। তবে তার আরো বিবৃতি ও বক্তৃতার উদ্ধৃতি পড়তে পরেন সিমিন হোসেন রিমি’র “তাজউদ্দীন আহমেদ আলোক ভাবনা : উদ্ধৃতি সংকলন” নামক বই থেকে।


দেশ তখন মুক্ত হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর মন্ত্রীসভা নিয়ে দেশে ফিরবেন।

এয়ারপোর্টে তাদের বিদায় দিতে আসেন ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী প্রধান রুস্তমজী, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার গোলক মজুমদার সহ অনেকেই। রুস্তমজি বললেন, ‘আশা করি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্ব চিরকাল অক্ষুণ্ণ থাকবে”।

নম্র স্বভাবের তাজউদ্দীন তখন উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, সমতা সহকারেই বন্ধুত্ব হতে পারে”।

তাজউদ্দীন আহমদ দেশে ফিরলেন, এক মুক্ত স্বাধীন দেশে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও প্রত্যাবর্তন করলেন তার প্রিয় দেশে। অনেক কথাই হওয়ার কথা ছিল দুজনের মধ্যে; শেখ মুজিবকেও অনেক কিছু বলার ছিল তাজউদ্দীনের। হয়েছিল কি না সেটাও অন্য গল্পের, অন্য দিনের বিষয়।

১৯৭৫ এর আগস্টে বাংলা আবারো রক্তস্নান করে তার সূর্যসন্তানদের দ্বারা। ১৫ আগস্ট নিহত হন শেখ মুজিব সপরিবারে। এর ঠিক মাস দুয়েক পর ৩ নভেম্বর জেলের মধ্যে নিহত হন তাজউদ্দীন আহমদ।

বাগান করার বড় শখ ছিল বোধহয় তাঁর। জেলের মধ্যে পচা নর্দমা ভরাট করে সেখানেই গড়ে তুলেছিলেন মৌসুমী ফুলের বাগান; রক্তলাল জবা ফুলের একটা গাছও নাকি ছিল সেখানে। এমন সুন্দর বাগান তৈরির কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন আজীবন।

বিঃদ্রঃ তাজউদ্দীন আহমদের মত নেতা আমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেটা আমাদের পরম ও চরম সৌভাগ্যের। এই নেতা আজ দেশের কাছে, এমনকি তার দলের কাছেও প্রাপ্য মূল্যায়নটুকু পান নি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একজন ছাত্র প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে তাজউদ্দীন সস্পর্কে শুধু এটাই জানে যে, তিনি মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, এর বাইরে কিছুই জানে না। এটা হতাশার, দুঃখের, কষ্টের, লজ্জার! ইতিহাস জানতে হলে, ইতিহাসের চেতনাকে বুঝতে হলে, ইতিহাস স্রষ্টাদেরকেও জানতে হবে, বুঝতে হবে।  

তথ্যসূত্র:
১) তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা – শারমীন আহমদ
২) মূলধারা ৭১ – মইদুল হাসান
৩) একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথামালা – নজরুল ইসলাম
৪) পাকিস্তানি জেনারেলদের মন – মুনতাসির মামুন
৫) বাংলাদেশের জন্ম – রাও ফরমান আলী
৬) তাজউদ্দীন আহমদ – প্রত্যয় জসীম
৭)  তাজউদ্দীন আহমদ আলোক ভাবনা : উদ্ধৃতি সংকলন- সিমিন হোসেন রিমি

আপনার মন্তব্য

আলোচিত