তুষার গায়েন

১৯ আগস্ট, ২০১৬ ১৭:৫৬

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ

“ঠাকুর, বউ গেলে বউ পাইব, কিন্তু আমার ভাই ফাঁসি গেলে আর তো ভাই পাইব না।”

সুন্দরবনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের অবস্থা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ‘শাস্তি’ গল্পের ছিদামের মত। এই দারুণ সংকটপূর্ণ সংসার জীবনে তাকে একজনকে ছাড়তে হবে, হয় বউ না হয় ভাই ! আহা, কী মর্মন্তুদ অবস্থা!
বিদ্যুৎরূপিনী বউ তার সংসারের আলো; আর আশৈশব রক্ত সম্পর্কের সাথী, ফুসফুসের মত অপরিবর্তনযোগ্য ভাই তার বিস্তৃত বনভূমি। কাকে রেখে সে কাকে ছাড়বে? কিন্তু তার একজনকে ছাড়তে হবে! তাই বুকে কষ্ট চেপে তরুণী ভার্যাকে সে ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে ঠেলে দিল। সে খুব হিসাবী, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে নৈর্ব্যক্তিক।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রসরমান একটি দেশ আর এই উন্নয়নকে বেগবান করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার বিদ্যুৎ। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে কী অপ্রতিস্থাপনযোগ্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় অনন্য রক্ষাকবচ, বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবনকে ধ্বংস করে দিতে হবে? রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রশ্নে, পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক কথাই হচ্ছে। যারা সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে সোচ্চার তারা তথ্য, উপাত্ত এবং পৃথিবীর নানা দেশের উদাহরণ টেনে দেখাচ্ছেন যে কয়লানির্ভর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে সুন্দরবনের ধ্বংস অনিবার্য। অপরপক্ষ তার বিপরীতে নিজেদের যুক্তি ও তথ্যমালা পেশ করছেন। আমরা আমজনতা কীভাবে এর ভেতর থেকে সত্যকে নির্ধারণ করব? খুব সোজা!

ভারত যদি তার নিজের দেশের সুন্দরবনকে রক্ষা করতে ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে এ ধরণের কোনো স্থাপনা হতে দিতে নারাজ থাকে; তাহলে (সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না এই আশ্বাস দিয়ে) বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকার ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চাওয়ার অর্থ কী? উপরন্তু এই বিদ্যুৎ চুক্তি অসম যেখানে বেশি বিনিয়োগ করেও বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বিদ্যুৎ পাবে কম। তাহলে এমন একটা চুক্তির মধ্যে বাংলাদেশের যাওয়ার কী দরকার? এটা তো ঠিক যে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিকল্প কোনো পথ নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে গেলে তা আর পাওয়া যাবে না! পৃথিবীর কোনো সুস্থ এবং দেশপ্রেমিক জাতি এই ধরণের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না, এটা নিশ্চিত। তাহলে সারাদেশ জুড়ে এত প্রতিবাদ সত্ত্বেও বর্তমান সরকার কেন এই ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়নে বদ্ধ পরিকর? এর পিছনে যে-সব সম্ভাব্য কারণ আছে বা থাকতে পারে বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়ে থাকে, তা হচ্ছে :

১] বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর বিভিন্নভাবে আধিপত্য বিস্তার ও শোষণ করে যার ধারাবাহিকতায় রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি ও প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশকে বাধ্য করা হচ্ছে।

২] আওয়ামীলীগের শাসন ক্ষমতা ভারতের সমর্থন ও সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল, তাই ভারতকে খুশী করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এসব ক্ষতিকর প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে আওয়ামীলীগের উপায় নাই।

৩] দেশ ও কাল নির্বিশেষে পুঁজিবাদ তার মুনাফার জন্য পৃথিবীর সম্পদ এবং পরিবেশ ধ্বংস করতে দ্বিধা করে না, তাই দেশী ও বিদেশী পুঁজি বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে নিজেদের মুনাফার জন্য সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে এতটুকু বিচলিত নয়। শাসকগোষ্ঠী সেই পুঁজিবাদীদের প্রতিনিধি হিসেবে একচক্ষু অন্ধ-উন্নয়নের পশ্চাদ্ধাবন করছে মাত্র।

উপরোক্ত কারণগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কিছুই হয়ত বলা যাবে; তবে সাধারণভাবে এটা সত্য যে অপেক্ষাকৃত শক্তিমান তার থেকে দুর্বল ব্যক্তি-সম্প্রদায়-সমাজ-রাষ্ট্রের উপর শাসন ও শোষণ করে থাকে। উপমহাদেশীয় অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, ইংরেজ আমলে শিক্ষা-দীক্ষা-অর্থ-সম্পদে হিন্দু সমাজের তুলনায় পিছিয়ে পড়া মুসলিম সম্প্রদায় তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে, নিজেদের বিকাশের কথা ভেবে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছিল। পশ্চিমা পাকিস্তানী শাসকদের শাসন-শোষণ এবং নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি স্বাধীন সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে, রাষ্ট্র-প্রশাসন-রাজনৈতিক দল এবং ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মৌনতার সুযোগ নিয়ে দেশীয় দখলদার শ্রেণী দেশের সমতল এবং পাহাড়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে হত্যা-নির্যাতন, সহায়-সম্পদ দখল ও তাদের ক্রমাগত বাস্তুচ্যুত করে চলেছে।

আওয়ামীলীগের সাথে ভারতের পারস্পারিক নির্ভরশীলতা যেমন ঐতিহাসিক সত্য, পাশাপাশি এটাও সত্য যে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দেশের বৃহত্তম দল হিসেবে আওয়ামীলীগ ভারতের সাথে পানিচুক্তিসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক চুক্তির ক্ষেত্রে দর কষাকষি করে যতখানি আদায় করতে সক্ষম, সেটা বিএনপিসহ অন্য কোনো দলের পক্ষে করা সম্ভব না বা হয় নি।

দেশে দেশে পুঁজিবাদ তার মুনাফার জন্য পরিবেশসহ যে-কোনো ধরণের ধ্বংসাত্মক কাজে নির্লিপ্ত থাকে; কিন্তু ক্রমবর্ধমান পরিবেশবাদী আন্দোলন, সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও মানুষের সচেতনতার কারণে সেই পাগলা হাওয়ায় লাগামও পড়ে।

সম্পর্ক পরিবর্তনশীল, তাই মুক্তিযুদ্ধে একদা সহায়তা দানকারী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আকাঙ্ক্ষিত পরম বন্দুর মত আচরণ নাও করতে পারে। ছোট রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতের কাছ থেকে কতখানি আদায় করে নিতে পারবে বা কী রকম মর্যাদা নিয়ে পাশাপাশি বাস করতে পারবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণভাবে নিজেকে কীভাবে প্রতিষ্ঠা করছে ও বিশ্ববাসীর সামনে তার ইমেজ কেমন হচ্ছে, তার উপর। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে বেশ উন্নতি করলেও, বিভিন্ন ব্যাপারে তার জন্মকালীন অঙ্গীকার থেকে দূরে সরে এসেছে যা একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হবার ক্ষেত্রে বড় বাধা। স্বাধীনতা বিরোধী এবং সামরিক ছাউনিতে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে জাতির আশা করার কিছু থাকতে পারে না, কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ও অংশগ্রহণকারী ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ এবং মহাজোটের কাছে মানুষের প্রত্যাশা থাকা স্বাভাবিক। মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কথা বললেও কার্যত তার প্রতিফলন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অনুপস্থিত; দুর্নীতি, লুটপাট, ক্ষমতা ও কালো টাকার দাপট, আইন-শৃঙ্খলার ক্রমাবনতি, রাজনৈতিক গডফাদারদের দৌরাত্ম্য, বিভিন্ন অপরাধ ও হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ।

এসব অল্প-বিস্তর পৃথিবীর সব দেশেই হয়ত আছে, কিন্তু বাংলাদেশে তা সীমা অতিক্রম করেছে এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এর থেকেও বড় সমস্যা হচ্ছে সব ধর্ম, সম্প্রদায় এবং চিন্তার মানুষরা নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারে এমন একটি অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ যেখানে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, চোখের সামনে ধর্মীয় মৌলবাদের বাড়-বাড়ন্ত হচ্ছে দেখেও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা এবং বিশ্ব রাজনৈতিক বাস্তবতায় জঙ্গি মৌলবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটেছে। একদিকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসি কার্যকরের মত সাহসী ভূমিকা নেয়ার পাশাপাশি মৌলবাদের সাথে আপোষের নীতিগ্রহণ, অর্থাৎ স্ববিরোধী এবং বৈপরীত্যমূলক আচরণ বাংলাদেশের চলার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে।

একে একে মুক্তচিন্তার লেখক, ব্লগার, অধ্যাপক, প্রকাশক, পুরোহিত এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে হত্যা, নির্যাতন ও উচ্ছেদের খোলা লাইসেন্স দেয়ার নীতি বাংলাদেশকে নৈতিকভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই নৈতিক দুর্বলতাকে সামনে রেখে শক্তিশালী দেশ যখন অসম চুক্তি ও ক্ষতিকর প্রকল্প চাপিয়ে দেয়, তখন খুব বেশি কিছু বলার থাকে না। এরপরেও যদি আত্মবিশ্বাস নিয়ে এই প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হতে বাংলাদেশ অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করত, তাহলে ভারত আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের উপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিত, এমনও মনে হয় না। কেননা ভারতের উপর বাংলাদেশের যেমন নির্ভরতা আছে, তেমনি বাংলাদেশের উপরে ভারতেরও কিছু কিছু বিষয়ে নির্ভরতা আছে। বিশেষত উপমহাদেশব্যাপী আল কায়েদা-তালেবান-আইসিস মার্কা জঙ্গি মৌলবাদকে ঠেকাবার জন্য দু’দেশেরই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার বিকল্প নাই যেখানে আওয়ামীলীগই ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু।

এবার কিছু কথা সুন্দরবন রক্ষাকারী আন্দোলনকারীদের নিয়ে। আমরা যদি সুন্দরবনকে ক্ষতি করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র না চাই, তাহলে সুন্দরবন রক্ষাকারী আন্দোলনকারীদের সমর্থন না দেয়ারও কোনো কারণ নাই। কিন্তু একখান কথা আছে ! যারা দেশকে ভালোবাসে, তারা তো দেশের অন্যান্য জ্বলন্ত ইস্যুতেও কথা বলবেন, এমনটা আশা করা যায়! একজন অগ্রসর মানুষ হিসেবে যিনি ভাবছেন দেশের বন ধ্বংস হলে পরিবেশ বিপর্যয় হবে, প্রাণ বৈচিত্র্যের ক্ষতি হবে; তার ভাবনায় কী এইকথা আসে না যে দেশে মানব বৈচিত্র্য ধ্বংস হলে মানব সমাজ ধ্বংস হবে, দেশের বহুত্ববাদী সমাজ ও সংস্কৃতি ধ্বংস হলে জাতি ধ্বংস হবে? তাহলে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন নিয়ে যারা এত তৎপর, দেশের ভূমিপুত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যখন প্রতিদিন আক্রান্ত ও নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের সহায়-সম্পদ দখল করে বাস্তুত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে, তখন তারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন কেন? তাদের নিয়ে তো কোনো মানববন্ধন, কোনো জোরদার আন্দোলন করতে দেখি না; এমনকি সামাজিক মাধ্যমে জোর গলায় প্রতিবাদও করতে দেখি না।

জঙ্গি ইস্যুতে আশ্চর্য নীরবতা পালন করতেও দেখা যায় তাদের অধিকাংশকে ! সমাজে বঞ্চিত শ্রেণীরা জঙ্গি হয় বা এসব শুধুই ইহুদী-নাসারাদের চক্রান্ত বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোশেশ করতেও দেখা যায়। এসব কারণেই সুন্দরবন আন্দোলনকারীদের ব্যাপারে অনেকেই দ্বিধামুক্ত নয়, মনে করা হয় আন্দোলনকারীদের মন তত পরিষ্কার না। একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনের পাশাপাশি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রক্ষা, জঙ্গিবাদ নির্মূলের আন্দোলন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সম-সাময়িক ইস্যুতে সমানভাবে আন্তরিক হবেন, এমন প্রত্যাশা করাই স্বাভাবিক। কারণ সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং তারা একইসাথে মনোযোগ ও অংশগ্রহণ দাবী করে।

তুষার গায়েন : কবি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত