সুজাত মনসুর

০৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ ২২:১৩

বরুণ রায়, সেনগুপ্ত এবং তথ্য বিকৃতির রাজনীতি

তথ্য বিকৃতি, মিথ্যাচারের রাজনীতি, ইতিহাস নিয়ে যার যেমন ইচ্ছে কিসসা-কাহিনী রচনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। আর এসব যারা করেন তারা সবাই মোটামুটি নষ্ট-ভ্রষ্ট রাজনীতিবিদ। ইতিহাসকে, রাজনীতিকে নিজেদের মতো করে বর্ণনা করা তাদের মজ্জাগত স্বভাব। শুধু রাজনীতিবিদ কেন অনেক লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীকেও দেখা যায় রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় ইতিহাস বিকৃতিকারীদের তালিকায় না লেখাতে। তবে ইতিহাস বিকৃতিটা করা কিন্তু হয় মূলত: ঐ সব ব্যক্তির ক্ষেত্রে যারা ইহলোকে বেঁচে নেই। কিন্তু যারা করেন তারা কি একবার ভেবে দেখেন যাদের নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি বা মিথ্যাচার করা হচ্ছে তিনি জীবিত না থাকলে কেউ কেউ না নিশ্চয় জীবিত আছেন কালের সাক্ষী হয়ে। আর যদি কেউ যদি বেঁচে নাও থাকেন সেখানে কিছু কিছু বিষয় লিপিবদ্ধ কোথাও আছে যা থেকে একদিন না একদিন সত্যটা বেরিয়ে আসবে।

আমি নিজে কালের সাক্ষী সে ধৃষ্টতা প্রদর্শনের বয়স কিংবা জ্ঞান কোনটাই আমার নেই। তবে ইতিহাস নির্ভর বই-পুস্তক পড়ার অভ্যাস চিরকালের। ইদানিং বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারকে আমার লেখার বিষয় হিসেবে বেছে নেবার কারণে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ বিভিন্ন বই পড়ার চেষ্টা করছি, যেখান থেকে প্রকৃত ও সত্য নির্ভর রসদ সংগ্রহ করা যায়। যখনই সুযোগ পেয়েছি তখনই সমসাময়িক রাজনৈতিক নেতাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। অনেক গল্প-কাহিনী শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। উনসত্তরের পর থেকেই রাজনীতির সাথে হাটি হাটি পা পা করে যুক্ত হবার কারণে নিজেই কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছি। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী আমার কাছে বাইবেলতুল্য, নিত্যদিনের সঙ্গী। তাই যখনই কেউ বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের কোন ঘটনা নিয়ে তথ্য বিকৃতির চেষ্টা করে, তখনই মন বিদ্রোহী ওঠে, মেনে নিতে পারে না। আর তা যদি হয় কোন একজন সম্মানিত ও সৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে তখন বড়ই কষ্ট লাগে। আমার বিশ্বাস পাঠক, আপনারাও একমত হবেন যে, কারো সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মহান করা যায় না, বরং ছোটই করা হয়। বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শেষ পর্যন্ত তাই করেছেন। তিনি ইতিহাসের তথ্য বিকৃতি ঘটিয়েছেন।

তাহলে ঘটনাটা খুলেই বলি। আর্কাইভ খুঁজতে গিয়ে ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৪ সিলেটটুডে২৪.কম-এর একটি সংবাদের প্রতি (লিংক এখানে) আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। সংবাদটিতে মি. সেনগুপ্তের বক্তৃতার কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হয়েছে। উদ্ধৃতিগুলোর অধিকাংশ তথ্যই সঠিক কিন্তু একটি তথ্যের সত্যতা মেনে নিতে পারলাম না যৌক্তিক কারণে। মনে হয়েছে তিনি তথ্য বিকৃতি ঘটিয়েছেন এবং যাকে মহান করতে গিয়ে তিনি এই বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছেন তাঁকে প্রকারান্তরে খাটো করেছেন। সেনগুপ্ত কমরেড বরুণ রায়ের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে, সিলেটস্থ সুনামগঞ্জ জেলা সমিতি আয়োজিত স্মরণসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ তথ্য বিকৃতি ঘটান। তিনি বলেছেন, 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দীর্ঘ ১৪ বছর জেল খেটেছেন বরুণ রায়। জেলের ভেতর বরুণ রায় গান গেয়ে শোনাতেন বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতাদের`

বঙ্গবন্ধুর জীবনে জেল-জীবন প্রায় চৌদ্দ বছর। এরমধ্যে তিনি একাধারে দীর্ঘ সময় কারাগারে ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সময় এবং আইয়ুবের শাসনামলের শেষভাগে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত। সর্বশেষ কারাভোগ করেন প্রায় নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের সময়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে তখন কমরেড বরুণ রায় হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে। আর নয়মাস যুদ্ধের সময় তিনিতো ভারতেই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কারণে। শুধুমাত্র এই একটি মাত্র উদাহরণ দিয়েই বলা যায়, সেনগুপ্তের বক্তব্য যে কত অসাড় আর তথ্যবিকৃতিতে ভরপুর। কেননা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আর মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন সময় মিলিয়ে না হলেও তিন-চার বছর যদি আমরা বাদ দেই তাহলে তো বাবু সেনগুপ্তের চৌদ্দ বছর কমে দশ/এগারো বছরে চলে আসে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তাঁর জেল জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনার বর্ণনা দেবার চেষ্টা করেছেন। কারাগারে তাঁর সঙ্গীদের কথা উল্লেখ করেছেন। কই কোথাও কমরেড বরুণ রায়ের কথার উল্লেখ নেই। তিনি যদি বঙ্গবন্ধুকে গান শুনিয়ে থাকেন তাহলে তো উল্লেখ থাকার কথা। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে মূলত: জন্ম থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত সময়কাল বর্ণিত হয়েছে। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু না হলেও সব মিলিয়ে ৪/৫ বছর জেল খেটেছেন। সুতরাং যেহেতু বঙ্গবন্ধু কোথাও এই সময়কালে তাঁর সাথে রাজবন্দি হিসেবে বরুণদার কথা উল্লেখ করেননি, তাই স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় ঐ সময়ে বরুণ রায় বঙ্গবন্ধুর সাথে জেলে ছিলেন না এবং যেহেতু জেলে ছিলেন না সুতরাং গানও শোনাননি। অতএব দশ থেকে যদি আমরা আরো চার বছর বাদ দেই তাহলে থাকে ছয় বছর। বাকী ছয় বছরের কাহিনী নিয়ে অনেক বই রচিত হয়েছে। অনেক প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। বরুণ রায় নিজে সহ আরো অনেকেই ঘরোয়া আলোচনা, সভা-সমিতিতে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। বেশিদিন না হলেও কিছুদিন হলে বরুণদার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সাথে চৌদ্দ বছর জেলে ছিলেন, তাঁকে গান গেয়েছেন এরকম ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা তাঁর মুখে শুনিনি। বরুণদা মহান ছিলেন, এরকম গৌরবময় একটি ঘটনা তিনি চেপে যাবেন, আর কিছু না হোক এ ব্যাপারে সামান্যতমও লিখে যাবেন না তা বিশ্বাস করি কি করে। আর বঙ্গবন্ধু এতকিছু লিখলেন, আর বরুণদার কথা ভুলে গেলেন কি করে? সেনগুপ্ত বরুণদার মতো একজন মহান ব্যক্তিকে ১৯৭৯ সালে কি করে ষড়যন্ত্র করে পরাজিত করলেন? যাকে তিনি নেতা বলে উল্লেখ করেছেন। যে বরুণদার সেক্রিফাইসের কারণে সত্তরে তরুণ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে একমাত্র বিরোধীদলীয় সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তাহলে ঘটনাটা খুলেই বলি। যা আমার আগের লেখায় ইচ্ছে করেই চেপে গিয়েছিলাম। গল্পটি আমার দিরাই-এর সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রয়াত ক্ষিতিশচন্দ্র নাগের কাছে শোনা। পরিবার-পরিজনহীন দুখু সেনকে যারা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বানিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই মহান ব্যক্তিটির সান্নিধ্যে আসার। একদিন গল্পচ্ছলে সেনদার সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছিলেন। তন্মধ্যে একটি গল্প হল, সত্তরের নির্বাচনের সময় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকার কারণে দিরাই-শাল্লা-ধরমপাশা-জামালগঞ্জ আসনে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুস সামাদের বিরুদ্ধে(তখনও তিনি আজাদ হননি) ন্যাপ থেকে বরুণ দাকে নমিনেশন দেবার কথা হয়। আর প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের অক্ষয়কুমার দাশের বিপরীতে ন্যাপের গুলজার আহমেদ। কিন্তু সেনগুপ্তের কিছু অনুরাগী/বন্ধু বরুণ দাকে অনুরোধ করেন তিনি যেন নির্বাচন না করে জাতীয় সংসদে গুলজার আহমেদ ও প্রাদেশিক পরিষদে সেনগুপ্তকে নমিনেশন দেন। বরুণদা তাদের অনুরোধ ফেলতে পারেননি। তাঁর ত্যাগ স্বীকারের ফলে দুখু সেন এমপি হয়ে বিশ্বে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরূপে পরিচিতি লাভ করেন। সেই বরুণদাকে সেনগুপ্ত প্রতিদান দিয়েছিলেন ৭৯ সালের নির্বাচনে ষড়যন্ত্র করে পরাজিত করে।

মি. সেনগুপ্ত তাঁর বক্তৃতায় আরো উল্লেখ করেছেন, আব্দুস সামাদ আজাদ এবং আবুল মাল আব্দুল মুহিতের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পৃক্ততা ছিল কিন্তু তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন না। তিনি যে কমিউনিস্ট ছিলেন তা সবাই জানে। তবে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কাঁধে ভর দিয়েই কিন্তু প্রথমবার জয়ী হন। দ্বিতীয়বার ৭৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন ছিল বলেই সামাদ আজাদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর ৭৯-এর নির্বাচনের কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি। তিনি বরুণদাকে তাঁর নেতা বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তথ্য বিকৃতির মাধ্যমে নেতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলেন নাকি অসম্মান করলেন তিনিই ভালো বলতে পারবেন। আর যদি বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কাছে তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে কোন বাস্তবভিত্তিক কোন তথ্য থাকে তাহলে তা প্রকাশ করে জাতিকে কৃতার্থ করবেন বলেই বিশ্বাস করি।

  • সুজাত মনসুর: সাংবাদিক ও কলাম লেখক। ইমেইল: [email protected]
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত