সুজাত মনসুর

০৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০১:১২

কী বার্তা দিতে চায় সিলেট জেলা ছাত্রলীগ?

একটি ছবি, চমৎকার ঝকঝকে একটি পরিচ্ছন্ন ছবি। ছবিটি বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন এবং ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সিলেট জেলা শাখা ছাত্রলীগ কর্তৃক আয়োজিত বর্ণাঢ্য ও সুশৃঙ্খল একটি সারিবদ্ধ মিছিলের ছবি। সামনে দু’জন হাতে ধরে নৃত্যের ভঙ্গিমায় হাঁটছেন অনুমান করা যায়। একজন পরিচিতি মুখ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রায়হান চৌধুরী। অন্যজনের নাম না জানা থাকলেও বুঝতে পারি তিনি হবেন জেলা কমিটির সভাপতি হয়তো।

এরপরেই রয়েছে মেয়েদের সারি, যাদের পরনে লাল শাড়ী এবং মাথায় সোনালী রং-এর স্কার্ফ মোড়ানো, দেখে হিজাব হিজাব মনে হয়। তারা বহন করছেন কয়েকটি ডালিতে সাজানো সিলেট জেলা ছাত্রলীগ লেখা ব্যানার। তাও সাংগঠনিক আভিধানিক দিকে থেকে সঠিক নয়। এটা হওয়া উচিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, সিলেট জেলা শাখা। 

আমার ইনবক্সে ছবিটি পাঠিয়েছেন ছাত্রলীগের প্রাক্তন এক নেতা, যিনি সিলেট শহরেই বাস করেন এবং মাঝে মাঝে ঢাকার হাইকোর্টে গিয়ে প্র্যাকটিস করেন। পাঠিয়ে তিনি জানতে চেয়েছেন সিলেট ছাত্রলীগের এই মিছিলটি বিশেষ করে মেয়েদের মাথার সোনালী হিজাব বা স্কার্ফ এবং জেলা নেতৃদ্বয়ের নাচের ভঙ্গিমায় হাঁটা কি বার্তা বহন করছে? নতুন বছরে কি বার্তা দিতে চায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সিলেট জেলা শাখা? তাঁর মনে এ প্রশ্নেরও উদ্রেক হয়েছে, তাহলে আমরা ‘ব্যাক টু বেসিকে’ ফিরে যাচ্ছি। অর্থাৎ ছাত্রলীগ কিংবা আওয়ামী লীগের জন্মলগ্নে নাম ছিল মুসলিম ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ। তাঁর এ উদ্বেগকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছি একবিংশ শতাব্দী এসে সে সুযোগ নেই। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন তো নয়ই। তিনি আমার কথায় সন্তুষ্ট হয়েছেন।

আমাকে ছবিটি পাঠানোর অর্থ, ২০১৫ সালে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দৈনিক ভোরের কাগজে ‘ছাত্রলীগের একাল-সেকাল’ শিরোনামে একটা কলাম লিখেছিলাম এবং এবার তিনি তাঁর ফেইসবুক পেইজ ‘জয় বাঙলা’-তে পুনর্মুদ্রণ করেছেন। সে লেখায় আমি ছাত্রলীগের বর্তমান পর্যায়কে পচন পর্ব বলে যুক্তি সহকারে বর্ণনা করেছি। তাই হয়তো তিনি ভেবেছেন এই ছবিটির বিষয়টি নিয়েও লিখবো। এছাড়া আমি যখন সিলেটের ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় এবং সিলেট ছাত্রলীগের দায়িত্বে ছিলাম তখন আমাদের কাজকর্ম প্রত্যক্ষ করেছেন। সেই সুবাদে এ ব্যাপারে আমার কাছে মতামত ব্যক্ত করার প্রত্যাশা রেখেছেন।

প্রথমে ভেবেছিলাম লিখবো না। লিখেই কি হবে? ওরা কি সে পর্যায়ে আছে যে কারো কথা শুনবে বা আমলে নেবে। সবচেয়ে বড় কথা ওরা তো কোন পত্রিকাই ভাল করে পড়ে না। শুধু পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে যায়, আর দুই চক্ষু মেলিয়া খেয়াল করে নিজেদের সংবাদ ছাপা হল কি না? হলে নিজের নামটি গেল কি না? ছবি ছাপা হল কি না? এই নেতাদের কেউ গঠনতন্ত্র কিংবা ঘোষণাপত্র পড়বে কি, হাতে নিয়ে কখনো দেখেছে কি না সন্দেহ হয়। তাদের দোষ দিয়েই বা কি হবে, তারা যাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে তারা তো তাদেরকে নেতা ভজন আর অস্ত্র চালনা এবং কিভাবে অতি সহজে ও শর্টকাট পথে অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়া যায় তাই শিক্ষা দিচ্ছে।

প্রতিবছর ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এলেই প্রাণের টানে কিছু লিখতে ইচ্ছে করে, হাত নিশপিশ করে। পুরনো অভ্যাস। এবারই শুধু ব্যতিক্রম হতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া সংগঠন, বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সাথে যার রয়েছে লতায়-পাতায় সম্পর্ক, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেক জাতীয় নেতাই এক সময় ছাত্রলীগকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে কারাগারে থেকেই ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছিলেন। তাই এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটি নিয়ে লিখলে মনে হয় নিজেই গৌরবান্বিত হচ্ছি। কিন্তু এবার কেন জানি মনে হচ্ছিল, লিখে কি হবে সবই তো অরণ্যে-রোদন। কিন্তু নিজের অবস্থানে স্থিত হতে পারলাম না। দুদিন পরে হলেও লিখতে হল। লেখার উপলক্ষ আগেই উল্লেখ করেছি।

কোন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কিংবা বিশেষ দিনে অথবা জাতীয় দিবসগুলোতে বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত সংগঠনের নেতাকর্মীদের আনন্দ প্রকাশের পাশাপাশি, পোষাক-পরিচ্ছদ, ব্যানার-ফেস্টুনের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শের বার্তা জনগণকে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করা হয়। সংগঠনের নীতি-আদর্শের আলোকে র‌্যালি কিংবা সভা-সমাবেশকে সাজানো হয় নানা বর্ণে। আয়োজন করা হয় সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। প্রকাশ করা হয় বিভিন্ন প্রকাশনা। আজকাল অবশ্য প্রকাশনার বিষয়টি লুপ্ত প্রায়। পরিলক্ষিত হয় না সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের। তবে সভা-সমাবেশ আছে ঠিকই, হচ্ছে উদ্দাম নৃত্যসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হলে সেখানে নির্দিষ্ট বিষয় ভিত্তিক আলোচনা হত। প্রকাশনা হলে সংগঠনের ইতিহাস, আদর্শ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যেত। যা থেকে জ্ঞান ও মেধা ভিত্তিক কর্মীবাহিনী গড়ে উঠতো। আর এসব হচ্ছে না বলেই মেধা ও জ্ঞানের জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে পেশি শক্তি ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি। সভা-সমাবেশে চলে বক্তৃতার প্রতিযোগিতা। যার যা মুখে আসে তাই বলে যায় অবলীলায়।

এই যে মেধা-জ্ঞান হীনতা সেই কারণেই আসলে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের র‍্যালিতে অর্থহীন পোশাক, যা ছাত্রলীগের ইতিহাস-ঐতিহ্য-আদর্শকে প্রতিনিধিত্ব করে না। আমরা কি করতাম? আমরা মাথায় ছাত্রলীগের লোগো সম্বলিত পট্টি বাঁধতাম। র‌্যালি কিংবা সমাবেশে সংগঠনের বিভিন্ন স্লোগান সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুন লাগাতাম। মানুষের কাছে রাজনৈতিক ম্যাসেজ পৌঁছে দেবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এবার সিলেট জেলা ছাত্রলীগ যে মেয়েদেরকে অর্থহীন পোশাকে সজ্জিত করলো এর মাধ্যমে তারা মানুষকে কী ম্যাসেজ দেবার চেষ্টা করলো? সবার সামনে যে দুজন নৃত্যের ভঙ্গিমায় হাত ধরাধরি হাঁটলেন, তা দিয়ে কি বোঝাতে চাইলেন? তারা মুজিবকোট পরিধান করতে পারতেন না? মুজিবকোট পড়লেও না হয় অনেকটা অর্থ বহন করত।

আমি অনেক চেষ্টা করেছি তাদের এই পোষাক পরিধানের বিষয়টি অনুধাবন করতে। উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। বিষয়টিকে হালকাভাবে নেবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোন সমীকরণই মিলাতে পারিনি। তবে উত্তর একটা পেয়েছি মেধাহীন নেতৃত্ব এ ধরনের অদ্ভুত পোষাক পরে র‌্যালি করার বিষয়টি জনমনে যে ভুল বার্তা দেবে তা অনুধাবন করতে পারেনি এবং এখনো পারছে না। যদি এ অবস্থা চলতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয় না।

আমি আশাবাদী মানুষ, হতাশা আমাকে গ্রাস করতে পারে না। তাই আশায় বুক বেঁধে আছি আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক একজন মেধাবী ছাত্রনেতা ছিলেন। ছাত্রলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদকও মনে হয় মেধাবী, লেখালেখি ও পড়াশোনার অভ্যাস আছে। এ দুই নেতা মিলে ছাত্রলীগকে তার ঐতিহ্যের ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারবেন। আর ছাত্রলীগ যদি একটি আদর্শিক নেতাকর্মী সৃষ্টির কারখানায় পরিণত হয় তাহলে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সংগঠনেও তার প্রভাব পড়বে। কেননা ছাত্রলীগ হচ্ছে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সহযোগি ও অঙ্গ সংগঠনের জন্য নেতাকর্মীর তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

  • সুজাত মনসুর: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত