মাসুদ পারভেজ

০৮ মার্চ, ২০১৭ ১৭:২৮

সভ্যতার উত্তরণ ও নারীর অধিকার হরণ

আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী হচ্ছে সভ্যতার সবচেয়ে নিষিদ্ধ কিন্তু আকর্ষণীয় উপাদান। যেটা নিয়ে নির্মল আনন্দের উপলক্ষ পাওয়া যায়। পুরুষ শাসকের মোড়কে খোলসবন্দি নারী, যেখানে নারী অতি-নিষিদ্ধ, নারীর অধিকার দাবি যেখানে বিদ্রোহ, যেখানে নারী শুধু মাত্র দাসী ও ভোগ্যসামগ্রী। প্রথা মানতে গিয়ে আমরা নারীবন্দির বোতলের ছিপি টাকে নিত্যদিন টাইট করছি। নারী এখনো ও পৃথিবীর অনেক স্থানে বিপদজনক, নারী আবার কখনো কখনো অচ্ছুত ও হয়ে যায়। যেমন – ঋতুস্রাবের সময় নারীকে অনেক দূরে ঠেলে দেওয়া হয়, ক্ষেত্র বিশেষে তাকে অপবিত্র বলে অপবাদ দেওয়া হয়। তাছাড়া পুরাণ বা ধর্মগ্রন্থেও একে অত্যন্ত অশুচি বলা হয়েছে। আদিম সমাজে নারীদের ঋতুকালে নারীকে স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হত। বর্তমান সভ্য সমাজেও তেমন ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে না! কিন্তু এ সময়ে তাদের আপনজনদের সঙ্গ দরকার। নারীর ঋতুকালে যে যন্ত্রণা ভোগ করে তা শুধুমাত্র মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক বা প্রাকৃতিক কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তা যেন ঘৃণ্য! ধিক এ ভণ্ডামিকে, মরচে পড়ুক এ ধরনের নষ্ট কু-মানসিকতায়।

ঠিক উল্টো পথে আবার নারী সে কুমারী হোক বা অন্য কিছু হোক পুরুষের পরম আরাধনার বিষয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে নারীর ভালো-মন্দ নির্ভর করে পুরুষ তাকে নিয়ে কি ভাবছে? যে নারীকে পুরুষরা অপবিত্রের অপবাদ দিয়ে দূরে ঠেলে দিচ্ছে তা আবার নিজের প্রয়োজনেই, নিজের উত্তেজনা নিবারণ করার জন্য বুকে টেনে নিচ্ছে। কেন এ বিপরীত চিত্র?

প্রায় সব ধর্মে নারীর অধিকার এর কথা বলা হয়েছে, তবে তা পুরুষের অধস্তনেই। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তা এখন কতটুকু ন্যায্য তা বিবেচনার কি দাবি রাখে না? সৃষ্টির শুরু থেকেই নারীই যেন সমস্ত পাপের মূল, মনে হয় আগমনী দরজা। নারীকে দোষারোপ করা হয়েছে কারণে-অকারণে। সেটি আদমের স্বর্গ থেকে বিতাড়ণ বা ট্রয় নগরী ধ্বংস হোক। সবখানে নারীর অপবাদ, সবক্ষেত্রে নারীকে নিয়ে ছেলেখেলার নির্মম ইতিহাস। এই যেমন- ‘জেনা’ করা সব ধর্মেই পাপ। কিন্তু শাস্তি নারী-পুরুষ ভেদে ভিন্ন। এবং আমাদের সমাজে মূল্যায়ন ও দুই রকম হয় এক্ষেত্রে। এক জন পুরুষ তার কাম উত্তেজনা নিবারণ করার জন্য বেশ্যালয়ের খদ্দের হতে পারে, হতে পারে দু-চারটা মেয়ের শয্যাশায়ী, কিন্তু মেয়ের ক্ষেত্রে? তদ্রূপ পুরুষরা চাইলে হালি হালি বিয়ে করতে পারে, একের অধিক মেয়ের সাথে রাত কাটালেও এখানে সেটা তার পুরুষত্বের প্রমাণ, কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে? আমাদের প্রথা মানা সমাজ এটাই অনুসরণ করে আসছে! তাহলে বুঝাই যাচ্ছে নারী ভোগ্য হয়েই যাবে আর পুরুষ তার রস আস্বাদন করবে। নারী চিরকালই রস দিয়ে যাবে, সন্তান উৎপাদনের বাক্স হয়ে থাকবে এমন ভাবধারায় মরচে পড়ুক। নব সভ্যতায় চির বিদায় নিক এইসব ভ্রান্ত ধারনার।

কথা হচ্ছে নারী স্বাধীনতা নিয়ে বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধিকার নিয়ে। প্রথা বিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের মতে একমত হয়েই বলছি- “কেউ নারী হয়ে জন্মগ্রহণ করে না, ক্রমশ নারী হয়ে উঠে”। প্রথাসিদ্ধ সমাজই দায়ী যতটা না দায়ী নারী নিজেই। রবি ঠাকুরের মতে- শুধু বিধাতার সৃষ্টি –নহ তুমি নারি, পুরুষ গড়েছে তোর সৌন্দর্য সঞ্চারী। তার মানে এটাই প্রতীয়মান হয় যে – নারীর রূপ লাবণ্য নির্ভর করে পুরুষ নারীকে কিভাবে দেখছে তার উপরে! এখানে পুরুষের অহমিকা, কামনার প্রকাশ পেয়েছে প্রবলভাবে। কোন পুরুষকে যদি গালি দেওয়া হয়, যেমন- লম্পট, চোর , বদমাশ কিন্তু যখনি বলা হয় তুই একটা নারী, সাথে সাথে তার সম্মানে আঘাত লাগে। এ থেকে বুঝা যায় নারী পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে কেমন! পুরুষ নারীকে তার অবস্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটি অনেকক্ষেত্রে আদম হতে হাওয়ার সৃষ্টি, সহবাসের সময় নারীর অবস্থান, বা পরিবারে নারীর সেবা দাসীর ভূমিকা। যে নারীর মাংস পুরুষের কাছে সু-স্বাদু, যে নারীর পাঁজরে পড়ে থাকে পুরুষ, কিন্তু উত্তেজনা কেটে গেলে সে নারীকেই পুরুষ প্রতিবন্ধী মনে করে! কি মিল শুধুমাত্র প্রয়োজন আর সময়ের তফাত।

ধর্মগ্রন্থে আছে – “স্ত্রীগণদের সদুপদেশ দাও কেননা পাঁজরের হাড় দ্বারা তারা সৃষ্টি, এটিকে সোজা করতে চাইলে ভেঙে যাবে, আর ছেড়ে দিলে আরও বাঁকা হবে” !!

নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যা যা করা দরকার তার সবটুকু পুরুষের হাতে বিদ্যমান। নারী চিরকালই ভোগ্যবস্তু, তার উত্তেজনা পুরুষ ছাড়া অর্থহীন। সে সবসময় অধস্তন, সেটা হোক কর্মক্ষেত্রে, হোক সেটা রাষ্ট্রে বা সমাজে, সমান পরিশ্রম করলেও মজুরী কিন্তু সমান না। তার উপর আবার বসদের খুশি রাখা! সভ্যতার কি চোখ ধাঁধানো নিদর্শন? ধিক এ সমাজ; এ প্রথা !

সিমোন দ্য বোভোয়ার এর মতে – “ইতিহাস ভরে নারী পরিণত হয়েছে পুরুষের সামগ্রীতে, নারীকে তৈরি করা হয়েছে পুরুষের অপরূপে, অস্বীকার করা হয়েছে তার নিজস্বতা এবং নিজ দায়িত্ব গ্রহণের অধিকার”

“পুরুষ শিকারি, নারী শিকার “ এমন ভাবধারাই মরচে পড়বে এ আশাই আছি।

নারী নির্যাতনের কারণ বহুমুখী তবে প্রধান কারণ আর্থিক। নারী মুক্তি নিয়ে যে ব্যাপারটা সবচাইতে বেশি দরকার তা হল নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। এক জন নারী আর্থিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল হওয়াটা একই সাথে নারীটি সামাজিক বা রাষ্ট্রিক বা নীতি নির্ধারণমূলক সকল কাজেই পুরুষের উপর নির্ভরশীল। সে রোজগার করে না এর অর্থ এই যে সে সকল বিষয়ে তার মতামত দেওয়ার অধিকার হারিয়েছে। আর সাধারণত নারীও ভাবে যে আমি যেখানে নিজে রোজগার করি না সেহেতু সাংসারিক বা অন্য কোন কাজেই আমার মতামত দেওয়াটা শোভা পাই না। এভাবেই নারীরা আস্তে আস্তে নিভৃতেই চলে যায়। আর এটাকে অধিকাংশ নারীরা তার নিয়তি বলে মেনে নেই।

আসলে অধিকাংশ পুরুষ চাই না নারীরা আর্থিকভাবে সচল হোক। আর এটা তাকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রাইমারী পর্ব। তার ই ফলশ্রুতিতে অনেক পড়ালেখা করার পরেও বলা হয় তোমার চাকরি করার কি দরকার। আমি কি কম কামাই করি , আমাদের কিসের অভাব সব কিছুই আছে সো তোমার আর কষ্ট করে ৯-৫ টা অফিস করার দরকার নেই , তার চাইতে তুমি আমার ছেলেমেয়েদের মানুষ কর , সেটাই বেশ কাজে দিবে।

এখানে উল্লেখ্য যে তাকে চাকরি করতে বলাটা মাসে শুধু মাত্র ১০-২০ হাজার টাকা বেতন না, সে চাকরি করার সূত্রে অনেক কিছু সম্পর্কে জানবে, জানবে তার অধিকারের কথা, তার মানসিক চিন্তার বিকাশ ঘটবে। আশে পাশের অনেকের সাথে তার না বলা অনেক কিছুই শেয়ার করবে। এক জন অন্য জন সম্পর্কে জানবে। এখন যদি চাকরির সূত্রে এমন এক জনের সাথে তার পরিচয় হয় যে নারী মুক্তি নিয়ে ভাবে, ভাবে সমাজ পরিবর্তন নিয়ে, ভাবে রাজনীতির আদ্যোপান্ত নিয়ে আর এমন ভাবে ভাবনার দোলে দোল খেতে খেতে তার মনে জেগে উঠবে চেতনার কথা, আশে পাশের নিগৃহীত নারীদের কথা সর্বোপরি সকল ভালোর সাথে তার একধরনের আধ্যাত্মিক, মানসিক সম্পর্ক তৈরি হবে – এটাই পুরুষের আসল জায়গা যে জায়গায় সে নারীদের দেখতে চাই না। সে চাই নারীরা ঘরকুনো হয়েই থাকুক। ঘর সংসার নিয়ে ভাবুক।

তাই বলা চলে নারী মুক্তি অনেকাংশে নিহিত অর্থনৈতিক মুক্তিতে।

মোদ্দা কথা, নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। নারী পরিচিত হোক তার নিজস্বতা দিয়ে, পুরুষের চোখে নয়, নারী শুধু কাম-উত্তেজনা নিবারণেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, থাকবে না শুধু মাত্র সেবা দাসীর ভূমিকায়। নারীর পদচারণায় মুখরিত হোক জানা-অজানাতে, সকল কিছুতেই, সকল প্রান্তে।

  • মাসুদ পারভেজ: কবি ও প্রাবন্ধিক; ইমেইল: [email protected]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত