সুজাত মনসুর

০৯ মার্চ, ২০১৭ ০১:২০

আন্তর্জাতিক সিলেট উৎসব এবং জালালাবাদ এসোসিয়েশন

আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর প্রতি কোন সময়ই আমার আগ্রহ বা মোহ ছিল না। কেন না, আমি হলাম শতভাগ জাতীয়তাবাদি, নিরেট বাঙালি জাতীয়তাবাদি। যে জাতীয়তাবাদ প্রস্ফুটিত হয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে সালাম-জব্বার-রফিক-বরকতদের রক্তের বিনিময়ে। এই জাতীয়তাবাদ জিয়াউর রহমানের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে আবিষ্কৃত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নয়।

সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী বলে মাঝখানে কয়েক বছর চেষ্টা করেছিলাম আন্তর্জাতিকতাবাদি হতে পারি কি না? পারি নি। কারণ, বিশ্বে আন্তর্জাতিকতাবাদের মূলত: মৃত্যু হয়েছে। এ মতবাদে যারা বিশ্বাস করতেন তাদের অনেকে হয় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ অথবা বাঙালি জাতীয়তাবাদে দীক্ষা নিয়েছেন। কেউবা সেজেছেন আঞ্চলিকতাবাদি। যেমন জালালাবাদ এসোসিয়েশনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ জগলুল পাশা, এক সময় কমিউনিস্ট পার্টি করতেন এবং আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস করতেন।

আমরা যখন সিলেটে লেখাপড়া করতাম তখন তেমন কোন আঞ্চলিক সংগঠনের নাম শোনা যেত না। তবে ঢাকা কেন্দ্রিক জালালাবাদ এসোসিয়েশনসহ জেলা ভিত্তিক অন্যান্য জেলার বাসিন্দাদের সংগঠনও ছিল। এখন তো ঢাকাতেই আছে সিলেট বিভাগের অনেকগুলো সংগঠন। কিন্তু প্রবাসে বিশেষ করে বিলেতে তো ভয়াবহ অবস্থা। সারা বিলেতব্যাপি কয়েকশ আঞ্চলিক সংগঠন রয়েছে বাঙালি নিয়ন্ত্রিত। এমনকি পাড়াভিত্তিক সংগঠনও আছে। এবং প্রতি বছরই তার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সংখ্যা বৃদ্ধির মুল কারণই হলো চেয়ার নিয়ে কামড়াকামড়ি।

এত উন্নয়ন সংস্থা আর শিক্ষা ট্রাস্ট আছে যে, যদি সত্যিকার অর্থেই নামের সাথে কাজের মিল থাকতো তাহলে বাংলাদেশে বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে সরকারের কোন প্রকার আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াই ব্যাপক উন্নয়ন আর শিক্ষার হার আর মান বেড়ে যেত। এইসব আঞ্চলিক সংগঠনগুলো করার আরেকটি অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রীর বুঝিয়ে দেয়া আমার পেছনে দল ছাড়াও এলাকাভিত্তিক সংগঠন আছে, সুতরাং নমিনেশনটা আমার প্রাপ্য। আছে মন্ত্রী-এমপি কিংবা আমলাদের সংবর্ধনার নামে ছবি তোলা আর তেলবাজি। আছে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির বিষয়টি। নব্বুই দশকের মাঝামাঝি বিলেতে পদার্পণ করতে না করতেই আমাদের এলাকার নবগঠিত একটি আঞ্চলিক সংগঠনের কমিটি গঠন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল গত একুশ বছরে আর দ্বিতীয়বার ঐ দিকে পা বাড়াইনি।

ফিরে আসি জালালাবাদ এসোসিয়েশন বিষয়ক আলোচনায়। আগেই উল্লেখ করেছি এদের ব্যাপারে একটা বিরূপ ধারনা পোষণ করার কারণেই কখনোই আগ্রহ বা মোহ সৃষ্টি হয়নি। তারা কি করে, না করে তা নিয়েও মাথা ঘামাইনি পণ্ডশ্রম বিবেচনায়। কিন্তু এবারই দ্বিতীয়বারের মতো এই সংগঠনটির ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আগ্রহ হলো। মনে করলাম লিখি না কিছু। আর এই আগ্রহের কারণ হলো জালালাবাদ এসোসিয়েশন কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক সিলেট উৎসব। এই সংগঠনের সাথে আমার এক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুসহ পরিচিত অনেকেই জড়িত আছেন দেখলাম। ঐ বন্ধুটির স্ট্যাটাসেই দেখলাম তারা আন্তর্জাতিক সিলেট উৎসব করছে। যেহেতু আমরা প্রবাসী সুতরাং আন্তর্জাতিক শব্দ শুনলেই মনে হয়, ওখানে আমাদের অংশিদারিত্ব আছে। তারপরও কিছু লিখিনি, ব্যস্ততাই মূল কারণ।

তারপর দেখলাম আমার আরেকজন ফেইসবুক বন্ধুর আন্তর্জাতিক সিলেট উৎসবের শেষ পর্যায়ের প্রস্তুতি বিষয়ক স্ট্যাটাস। মন্তব্য কলামে জানতে চাইলাম, প্রবাস থেকে, বিশেষ করে বিলেত থেকে কারা কারা যোগ দিচ্ছেন এবং কোন ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত হয়েছেন? উত্তরে তিনি জানালেন, প্রবাসে যেখানেই জালালাবাদ নামে সংগঠন আছে তাদের প্রতিনিধিরা যোগদান করবেন। উত্তরে বললাম, বিলেতে তো জালালাবাদ নামে কোন সংগঠন নেই তাহলে, এখান থেকে কারা যোগ দিচ্ছেন?

জানালেন তিনি সঠিক বলতে পারবেন না। জানতে হলে যেন মুল কর্তাব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করি। অথচ উনার স্ট্যাটাস পড়ে মনে হয়েছিল তিনিও কর্তাব্যক্তিদের একজন। পরে উৎসবের ছবি দেখে মনে হয়েছে আমার ধারনা অমূলক নয়। এই কিঞ্চিৎ পরিমাণ লুকোচুরি খেলায় আমার আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। একটু মজা করার জন্য জালালাবাদ এসোসিয়েশন বিষয়ক আমার দ্বিতীয় স্ট্যাটাস দিলাম।

দ্বিতীয় স্ট্যাটাস এ কারণে বললাম, সম্ভবত গত বছর একটা সংবাদ পড়েছিলাম, জালালাবাদ এসোসিয়েশন সিলেটে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবে। সে কারণে সাধুবাদ জানিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। তবে প্রকল্পের অগ্রগতি কি আর জানিনা। স্ট্যাটাস দিয়ে জানতে চাইলাম, জালালাবাদ এসোসিয়েশনের কাজটা কি? সে সম্পর্কে যদি কারো ধারনা থাকে তাহলে জানালে বাধিত হব। অনেকেই নানা রঙের মন্তব্য করলেন কিন্তু সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারলেন না। অনেকে পরামর্শ দিলেন, জগলু ভাইসহ কর্তাব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। বুঝলাম এভাবে কাজ হবে না। যোগাযোগ করলাম আরেক বন্ধুর সাথে। জানালো কোন কাগজপত্র নেই, পেলে জানাবে।

যখন প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছি বন্ধুটির নিকট থেকে জালালাবাদ এসোসিয়েশন নামক খানাপিনা ক্লাবের তথ্যাদি প্রাপ্তির প্রত্যাশায় তখনই ফেইসবুকে সিলেটের কয়েকজন সংস্কৃতিকর্মীর সংক্ষুব্ধ স্ট্যাটাস দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ। যারা আন্তর্জাতিক সিলেট উৎসব নামে একটি মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছে তারা কি না সিলেটবাসীর গর্বিত সন্তানদের ব্যাপারে খোঁজ-খবরও রাখে না, নাম বিকৃতি ঘটায়। বিদিত লাল দাসের নাম লিখে বিজিৎ লাল, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নাম হিমাংশু বিশ্বাস, রামকানাই লিখে, রাম কানাই আর রাধারমণ দত্তের নাম লিখে রাধা রমন। এ কি রকম ধৃষ্টতা?

জালালাবাদ এসোসিয়েশন নামক খানাপিনা ক্লাবের অর্বাচীন আর অজ্ঞ কর্তাব্যক্তিদের ব্যাপারে কিছু বলার আগে নির্মাতা-স্থপতি বন্ধু শাকুর মজিদকে প্রশ্ন করতে চাই, তিনদিনেও কারো চোখে বিষয়টি না পড়ার কারণে তিনি তো বিস্ময় প্রকাশ করলেন, কিন্তু উনার চোখে পড়লো না কেন? এই তিনদিন তিনি কি করেছেন? তিনি তো এই খানাপিনা ক্লাবের সাথে দীর্ঘদিন যাবত জড়িত আছেন।

আরো যারা আমাদের প্রিয়জন, সিলেটের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রিয়জন তাঁদের প্রতিও আহ্বান থাকবে, জালালাবাদ এসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের বলুন যেন অমার্জনীয় এ অপরাধের জন্য ক্ষমা চান। আর যদি তা না করতে পারেন তাহলেও আপনারাও ওদের সঙ্গ ত্যাগ করুন। নতুবা সিলেটবাসী আপনাদেরকেও ক্ষমা করবে না।

জালালাবাদ এসোসিয়েশনের কর্তাব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা খানাপিনা নিয়ে ব্যস্ত আছেন, তাই থাকুন। মন্ত্রী-এমপিদের সাথে ডিনার খেয়ে, সংবর্ধনা দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিন। যত খুশি আন্তর্জাতিক হোন আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি আর গর্বিত উত্তরাধিকার নিয়ে মশকরা করতে আসবেন না। এটা আপনাদের কম্ম নয়। মনে রাখবেন, কাক যতই ময়ূরের মত পেখম মেলার চেষ্টা করুক না কেন, কাক কখনো ময়ূর হতে পারে না।

  • সুজাত মনসুর : যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত