সদেরা সুজন

০৯ মার্চ, ২০১৭ ১১:৫৯

শ্রদ্ধা, কিংবদন্তি শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য

২০১৩ সালে টরন্টো বঙ্গ সম্মেলনে শিল্পী কালিকাপ্রসাদের সঙ্গে লেখক সদেরা সুজন। ছবি দেশদিগন্ত

বিশিষ্ট কণ্ঠ শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য তাঁর দল ‘দোহার’ নিয়ে এসেছিলেন টরন্টোতে। বঙ্গ সম্মেলন উপলক্ষে ২০১৩ সালের ৭ জুলাই ‘মেট্রো টরন্টো কনভেশন সেন্টার’ এর বিশাল হলে হাজার হাজার দর্শক শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন তাদের কণ্ঠের যাদুতে। সেই অনুষ্ঠানে মিডিয়া কর্মী হিসেবে উপস্থিত থেকে ছবি-ভিডিও ধারণ করার সুযোগ আমার হয়েছিলো।

অনুষ্ঠান শেষে বেশ কিছুক্ষণ তাঁর সঙ্গে আলাপেরও সৌভাগ্য হয়েছিলো। আমার বাড়ি সিলেটে জানার পর একটু বেশীক্ষণই আলাপ করতে পেরেছিলাম।

গত ৭ মার্চ ২০১৭ আকস্মিক সড়ক দুর্ঘটনায় চলে গেছেন পরপারে। লক্ষ-কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে বড্ড অসময়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। যা ছিলো আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য-অকল্পনীয় এবং অচিন্তনীয়! তবুও বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয়।

তাঁর অকাল প্রয়াণে বাংলা গানের ভুবনে যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তা সহজে পূরণ হবার নয়। সংগীতের জগতে শুদ্ধ সাবলিল এবং দক্ষ মেধাসম্পন্ন কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য।

১৯৭১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর আসামের শিলচরে জন্ম তার। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৭ বছর। জন্ম শিলচরে হলেও তাঁর প্রাণটা ছিলো পূর্বপুরুষের জন্মমাটি সিলেটে।

তাঁর ধ্যানে-জ্ঞানে, সুরে সাধনায় ছিলো সিলেট। সিলেট লোক সংস্কৃতি বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের বাউল ও মরমী গান গুলোকে তিনি গণমানুষের খুব কাছে নিয়ে এসেছিলেন।

তিনি লালন, শেখ ভানু, শাহ আব্দুল করিম, দুরবিন শাহ, হাছন রাজা, আরকুম শাহ, উকিল মুন্সি, শিতালং, রাধারমণসহ দুই বাংলার বাউল-ফকিরকে খুঁজে খুঁজে বের করে তাঁদের লিরিক্স- শব্দসৃষ্টি ও সুরকে নিয়ে, লোকশিল্পী, সাহিত্যিকদের নিয়ে গবেষণা করতেন, গাইতেন গাওয়ার জন্য উৎসাহ দিতেন। প্রকৃত সুর ও বাণী তুলে ধরতেন। সুরে সুরে তা প্রকাশ করেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে।

সাহিত্যে উচ্চ শিক্ষা নিয়েও হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন মরমী কবিদেরকে। লালন, শাহনূর, দুরবিন শাহ, হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম কিংবা রাধারমণের গান গেয়ে গেয়ে ভারত বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের দেশে দেশে শহরে শহরে ঘুরেছেন। হাওর-বাওর, নদী-নালা, মাটি-মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে লালন করতেন। বাউল-ফকিরদের হারিয়ে যাওয়া শিকড়ের গানগুলোকে খুঁজে খুঁজে বের করে গেয়েছেন। নিজে গেয়েছেন এবং নতুন প্রজন্মকে উদ্দীপনা দিয়েছেন গাওয়ার জন্য।

তিনি ছিলেন রবীন্দ্র ভক্ত। রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নিত্যসঙ্গী করেছিলেন। তিনি লোক সংগীতের পাশাপাশি রবীন্দ্র সংগীতও গাইতেন তবে তাঁর মতো করে প্রাণের আকুলতা দিয়ে।

১৯৯৯ সালে গানের দল ‘দোহার’ জন্ম দেওয়ার পর তাদের দলের সহ-শিল্পীদেরকে নিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি (আমাদের জাতীয় সংগীত) সম্পূর্ণটি গেয়েছেন যা যে কেউ একবার শুনলে বার বার শুনতে ইচ্ছে করবে। তাদের দল ‘দোহার’ কণ্ঠে গাওয়া প্রতিটি রবীন্দ্র সংগীত অসাধারণ।

তাঁর অকাল প্রয়াণে আমরা শোকাহত, মর্মাহত। তাঁর অসময়ে চলে যাওয়াতে বাংলার শেকড়ের গানে যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তা বছরে বছরে কিংবা যুগে যুগে পূরণ হবে কিনা সন্দেহ। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ একজন ক্ষণজন্মা কিংবদন্তিতুল্য শিল্পীকে হারালো।

তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছি। যেখানেই থাকুন চির শান্তিতে থাকুন।

সেদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় ‘দোহার’ অন্যান্য সহ-শিল্পীরা যারা আহত হয়েছেন তাদের প্রতি রইলো সমবেদনা এবং দ্রুত আরোগ্য লাভ করে ফিরে আসবেন প্রিয় দলে আবারো গাইবেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ কিংবা ‘গাড়ি চলে না চলে না, চলে না রে, গাড়ি চলে না….’।

  • সদেরা সুজন: প্রধান নির্বাহী, সিবিএনএ, কানাডা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত