মো. আব্দুল মতিন

১৩ মার্চ, ২০১৭ ২০:২১

অাসাদ মিয়া স্যার : কিছু স্মৃতি অার কীর্তির অসমাপ্ত কথন

মানুষের জীবন 'মেলোড্রোমা' নয়। দুঃখ-বিপদের পর এখানে সর্বক্ষেত্রে নায়ক-নায়িকার মিলন হয় না। যৌবনের বাহাদুরি কাল-সিন্ধু নীরে ডুবে যাওয়াই জীবন। এই সময়কালেই আমরা কিছু করে যেতে চাই। কিছু করতে পারলেই আসে জীবনের সার্থকতা।

একই সঙ্গে সত্যিকারের গুণীকে স্মরণ করা, সম্মান জানানোও প্রয়োজন- জীবনেরই প্রয়োজন। সুন্দর আগামীর প্রয়োজনে। জীবনের তাগিদেই তাই মরহুম অাসাদ মিয়া স্যারকে নিয়ে অামার এই লেখা।

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। সন্ধ্যায় মেসে একাকিত্ব, হোমসিক অনুভব করছি। ভাবলাম পাশের গ্রামের বড় ভাই, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড পলিমার সায়েন্সের ছাত্র কায়সার (কবি টিএম কায়সার) ভাইয়ের বাসায়  গিয়ে একটু অাড্ডা মেরে অাসি, মনটা ভাল হবে। অার যেহেতু আমি সমাজ বিজ্ঞানে একই বিশ্ববিদ্যালয়েপড়ি ভাল ফলাফলের দিক নির্দেশনাও পাব। ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ে তাঁর বাসাতে সন্ধ্যায় গিয়ে নিরাশ হলাম। ভাই বাসায় নেই কখন ফিরবেন সে নিশ্চয়তাও নেই।

তবে সেদিন মুখে মৃদু হাসি নিয়ে কায়সার ভাইয়ের চাচা অাসাদ মিয়া স্যার  (রামকৃষ্ণ মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক)এসে অামাকে সময় দিলেন। অামার পড়াশুনার খোঁজ খবর নিলেন। তিনি অামার পরিচিত জন এবং কায়সার ভাই অার অামি ছাড়া শাবিতে তখন দক্ষিণ ছাতকের কেউ পড়ে না।

লক্ষ্য করলাম অাসাদস্যার আমার দিকে 'অন্তর্দৃষ্টি' দিয়ে কি যেন খুঁজছিলেন। সেদিন তা বুঝতে পারিনি। অামার ও উনার কাছে অনেক প্রশ্ন ছিল সাহস করে বলতে পারিনি! তিনি রুমে গেলেন। মনে হচ্ছিল উনার স্ত্রীকে ( যিনি নিজ গ্রাম পালপুর সরকারী প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক বর্তমানে প্রধান শিক্ষক) কে কিছু বলতে গেছেন; আর আমি বাসা থেকে বিদায় না হওয়ায় উনার কোথায় জানি 'কাজে তাড়া' অাছে। কায়সার ভাই অাসলেন রাত পৌনে অাটটার দিকে। অামাকে কুশলাদি জিজ্ঞেস করা মাত্র অাসাদ স্যার একটি দুঃ সংবাদ নিয়ে অাসলেন।

বললেন, নায়ক সালমান শাহ মারা গেছেন!
ছুটির দিনে ও রাতের বেলা তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজটির  তাড়া (অামার জানার অাগ্রহ ছিল) অাপাতত নেই।

অামরা স্তম্ভিত হলাম। ১৯৯৩সালে ২০মার্চ মুক্তি পাওয়া 'কেয়ামত থেকে কিয়ামত' ছবির জনপ্রিয় নায়কের মৃত্যু!  অামাকে স্যার বললেন, মতিন অাটটার খবর দেখে খেয়ে যেয়ো। সালমান শাহের মৃত্যু নিয়ে অালোচনান্তে রাতে খেয়ে বিদায় নিলাম। এর পর কতবার কায়সার ভাইয়ের খোঁজে তাঁর বাসায় গেছি; ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র  কায়সার ভাইয়ের সাথে কবিতা, গান, আড্ডায় উপভোগ করেছি। স্যারের সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে; অামার প্রতি তাঁর সেই দিনের 'অন্তর্দৃষ্টি' অার কাজের 'তাড়া'র বিষয়টি জানার অাগ্রহ ততবারই অন্তরে উঁকি দিয়েছে।

দীর্ঘ প্রায় প্রায় ১৭ বছর ধরে কায়সার ভাই অার অাসাদ স্যারের সাথে দেখা নাই। কায়সার ভাই ইংল্যান্ডে গেলেন উচ্চশিক্ষা নিতে আর আমি গ্রামের মানুষের শিক্ষার উন্নয়নে জগন্নাথপুরের কলকলিয়ায় শাহজালাল মহাবিদ্যালয়ে শুরু থেকে অদ্যাবধি শিক্ষকতার কাজ করে যাচ্ছি গ্রামীণ শত প্রতিকুলতা ঠেলে।

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার। ইংল্যান্ড থেকে এলাকার ছোট ভাই আহমেদ আবুল লেইস ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে একটি শোক সংবাদ নিয়ে। পড়তে গিয়ে অজান্তে অশ্রু এল। সেই ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর যিনি  নায়ক সালমান শাহের মৃত্যুসংবাদ প্রথম শুনিয়েছিলেন; যার 'অন্তর্দৃষ্টি'অার 'কাজের তাড়া'র কারণ আজো খুঁজি অবচেতন মনে সেই আসাদ স্যারের মৃত্যুর সংবাদটি দিয়েছে আবুল লেইস। তাঁকে নিয়ে কিছু লিখব মনস্থির করলাম। কায়সার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করলাম।

বললেন, শোকে পাথর হয়ে আছি মতিন,  ভাই আমার। আমি কায়সার আজ যতটুকুন তার  সবটুকুই আমার চাচার অবদান।

আমিও কান্নায় আছি কায়সার ভাই বুঝতে দিলাম না বরং তাঁকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে সেদিন বিদায় নিলাম আর বলে রাখলাম- আমি স্যারকে নিয়ে কিছু লিখতে চাই। কিন্তু এই কথা বলারপর আমার অজান্তে ভয় আসল, একে তো কায়সার ভাই নিজে কবি ও লেখক, অপরদিকে আমি কোন লেখক নই! তারপরেও যেহেতু সাহস নিয়ে বলেছি তো ভুলশুদ্ধ যাই হোক আমি লিখবোই। আমার এই দুঃসাহস ক্ষমাকরবেন কায়সার ভাই। এতটুকু ভেবেই ঘুমিয়ে পড়লাম সেদিন।

 এক সপ্তাহ পর আবার কায়সার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করলাম মেসেঞ্জারে। শুরু হলো আসাদ  স্যার এর জীবনের গল্প...।  

১৯৫৬ সালের ৭ জুলাই সুনামগঞ্জ জেলাধীন  ছাতক থানার দোলার বাজার ইউনিয়নের পালপুর গ্রামে জন্মগ্রহনকারী অাসাদ স্যার মঈনপূর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র এবং ১৯৭৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগ অর্জনকারী। এমসি কলেজ থেকে  বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি ও অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) অার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন এবং তিনি দক্ষিণ ছাতকের প্রথম অনার্সসহ মাস্টার্স ডিগ্রীধারী।

ব্যাংকার হিসেবে চাকরী জীবন শুরু করলে ও পরে সৌদি অারবে চলে যান। প্রবাস জীবনে তিনি সিদ্ধান্ত নেন দেশে ফিরে শিক্ষায় কাজ করবেন। ১৯৮৯ সালে প্রতিবেশী গ্রাম খুরমায় জুনিয়র স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। শিক্ষকতা হয়ে উঠে নেশা ও পেশা। ১৯৯২ সালে গ্রাম ছেড়ে সিলেটের রামকৃষ্ণ মিশন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত ভোলানন্দ নৈশবিদ্যালয়ের বিনা বেতনে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বও গ্রহণ করেন এবং মৃত্যুর অাগ পর্যন্ত অত্যন্ত সততা, দক্ষতা ও সেবার ব্রতে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেন।

ভোলানন্দ নৈশ বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালনে তিনি সমাজের দলীত, বঞ্চিত, অবহেলিত, পশ্চাৎপদ পরিবারের সন্তানদের সযত্নে শিক্ষার মূল স্রোতে নিয়ে অাসেন যাদের অনেকেই পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

২০১২ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভারসিটি ফেলোশিপ পেয়ে Teaching Excellent  and Achievement  programme এর মাধ্যম TEA Fellow,USA অর্জন করেন। ২০১৪-২০১৫ সালে তিনি ইংল্যান্ডের Harrogate এ আন্তর্জাতিক শিক্ষাসম্মেলনে যোগদান করেন এবং তাঁর শিক্ষকতা ও শিক্ষা দর্শনের জন্য ব্যাপক সমাদৃত হন। এ ছাড়া তিনি চীন দেশে বহুবার ভ্রমণ করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা  হয়তো তাঁর মনে পড়েছিল, 'অামি যদি গোটা ভারত বর্ষের জন্যকিছু  করতে না ও পারি,অামি শান্তি নিকেতনের জন্যকি কিছু করতে পারিনা '?

তখন আসাদ স্যার তাঁর নিজগ্রাম পালপুরে পালপুর উচ্চবিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হোন এবং ১৯৯৬ সালে পালপুর উচ্চ বিদ্যালয়  স্থাপিত হয় যেখানে তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়ে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন।

'বিরামহীন কাজের মধ্যে ছুটে চলাজীবন, ক্লান্তিহীন শিখিয়ে যাওয়া হচ্ছে শিক্ষকতা'-এই দর্শনটি তিনি প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন অামাদের মাঝে অতি সযতনে।

২১ বছর পরে অামার দিকে তাঁর অন্তর্দৃষ্টির অর্থটি যখন বুঝতে পারলাম,বুঝতে পারলাম ভোলানন্দ নৈশ স্কুলের দায়িত্বের জন্য সেদিন ছিল স্যারের তাড়া;  ঠিক তখন জাতীয় শিক্ষাসপ্তাহ ২০১৭ উপলক্ষে শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানে আমি হলাম জেলার শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ। একটু দেরীকরে যদি আপনার প্রস্থান হতো স্যার তাহলে বুক ফুলিয়ে গিয়ে বলতে পারতাম, অামি যে আপনার কথা বুঝেছি গুরু!  আপনার ৩৮ বছরের চলা পথই এখন চলার শক্তি। জানি না শ্বাপদ সংকুল পথ কতটা পারি দিয়ে এগোতে পারব?  
 
 পরিশেষে বলতে বড় ইচ্ছে করে সহস্র- নিযুত ঘরে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে আপাদমস্তক শিক্ষক হিসেবে যিনি সমাদৃত হয়েছেন তাঁর খবর কেন জান না হে রাষ্ট্র?  কত মানুষ জোরকরে কত পদক নিয়ে যায়, নীতিহীন মানুষেরাও হয়ে যায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদার মালিক!

হে রাষ্ট্র,নিরবে শিক্ষার জন্য কাজ করা আসাদ মিয়া স্যারকে অন্তত মরনের পরেও একটু বল, হে আসাদ সাহেব, সমাজ ও রাষ্ট্র বির্নিমাণে আপনার ঋণ অপরিসীম। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা আমাদের। আপনার পরিবারের প্রতি আমাদের সমবেদনা। এতে করে অারো অাসাদ স্যারেরা সোনার বাংলা গড়ার কাজে অনুপ্রেরণা পাবেন; যদিও অাসাদ স্যারেরা লোকদেখানো সম্মানের জন্য এসব করেন না।
স্যালুট আসাদ স্যার, অপারেও আপনার জয় হোক।

লেখক: মো.আব্দুল মতিন, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, শাহজালাল মহাবিদ্যালয়, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত